ভোমরা যুদ্ধ (সাতক্ষীরা সদর)
ভোমরা যুদ্ধ (সাতক্ষীরা সদর) সংঘটিত হয় দুবার ২৯শে এপ্রিল ও ২৯শে মে। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বাংলাদেশ-ভারত ভোমরা সিমান্তে পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সংঘটিত এ-যুদ্ধে প্রথমবার নেতৃত্ব দেন সুবেদার আয়ুব এবং দ্বিতীয়বার নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন সালাহ্উদ্দিন ও এসডিপিও মাহাবুব উদ্দিন আহমেদ। ভোমরা কাস্টমস অফিসে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প ছিল। এ ক্যাম্প করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এম এ গফুর এমএনএ ও সুবেদার আয়ুব। অষ্টম ও নবম সেক্টরের প্রথম ক্যাম্প হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয় এবং অল্পদিনের মধ্যেই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যাম্পে পরিণত হয়। সাতক্ষীরার আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ এ ক্যাম্পে এসে যুদ্ধবিষয়ক বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। এছাড়া ইপিআর-এর সহায়তায় এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র প্ৰশিক্ষণ চলত।
২৯শে এপ্রিল সকালে স ম বাবর আলী, মুস্তাফিজুর রহমান, কামরুল ইসলাম খান, সালাম, ইউসুফসহ আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ইপিআর কমান্ডারের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ শেষ করে ক্যাম্প-সংলগ্ন পুকুরে গোসলের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় হঠাৎ পাকবাহিনী গুলি শুরু করে। আকস্মিক এ আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধরা প্রথমে হতচকিত হয়ে যান। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁরা পাকবাহিনীর ওপর প্রতি-আক্রমণ করেন। ইপিআর বাহিনী প্রথমে যুদ্ধ শুরু করে, পরে অন্য মুক্তিযোদ্ধারা যোগ দেন। প্রায় দুঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর পাকবাহিনী পিছু হটে সাতক্ষীরার দিকে চলে যায়। এ-যুদ্ধে নয় নম্বর সেক্টরের ইপিআর সদস্য ইফু মিয়া শহীদ হন।
প্রথমবারের যুদ্ধের পর ক্যাম্পের জনবল ও প্রশিক্ষণ বাড়ানো হয়। এ উপলক্ষে এখানে আসেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে ইপিআর-এর বিশেষ বাহিনী এবং ক্যাপ্টেন সালাহ্উদ্দিন ও এসডিপিও মাহাবুব উদ্দিন আহমেদ (এখান থেকেই তিনি ‘ক্যাপ্টেন’ র্যাঙ্ক পান)। যশোর থেকে বিশিষ্ট ছাত্রনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা এ এফ এম মুরাদ এখানে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন। ফলে এখানকার প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা আরো উন্নত হয়।
২৯শে মে-র যুদ্ধে দুই কোম্পানি ইপিআর, মুজাহিদ ও মুক্তিযোদ্ধারা অংশগ্রহণ করেন। পাকসেনারা ব্যাপক প্রস্তুতি ও সরঞ্জাম নিয়ে আক্রমণ চালালেও মুক্তিযোদ্ধারা দক্ষতার সঙ্গে তা মোকাবেলা করেন। এক পর্যায়ে ২২ এফএফ- বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন নিহত হলে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিশোধ গ্রহণে মরিয়া হয়ে ওঠেন। তাঁদের গুলিতে পাকবাহিনীর এক ক্যাপ্টেন নিহত হয়। ফলে হানাদারদের মনোবল ভেঙ্গে যায় এবং তারা পিছু হটতে শুরু করে। এমন সময় নিহত পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের লাশ হস্তগত করতে গিয়ে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে একজনের নাম জানা গেছে। তিনি হলেন সুবেদার শামসুল হক। তিনি হঠাৎ মাথা উঁচু করলে সঙ্গে-সঙ্গে শত্রুর বুলেটে তার মাথা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। এছাড়া সুবেদার আব্দুল জব্বারের পেটে গুলি লাগায় তিনি গুরুতর আহত হন, তবে যথাসময়ে চিকিৎসা পাওয়ায় তিনি সুস্থ হয়ে যান।
যুদ্ধে পাকবাহিনী অটোমেটিক রাইফেলসহ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। অপরদিকে, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান অস্ত্র ছিল ৩০৩ রাইফেল। ১৬-১৭ ঘণ্টা ব্যাপী এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের রণকৌশল ছিল উল্লেখ করার মতো। যুদ্ধে পাকবাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। অনুমান করা হয় যে, এদিন ২শ থেকে ৪শ পাকসেনা নিহত হয়। নিহতদের লাশ বহন করার জন্য পাকসেনাদের একাধিক ট্রাক ব্যবহার করতে হয়।
ভোমরা যুদ্ধে প্রায় তিনশ ইপিআর ও মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। ইপিআর-দের মধ্যে ছিলেন- সুবেদার আব্দুল জব্বার (আহত), সুবেদার হাসানউদ্দিন ফকির, সুবেদার আবদুল ওদুদ, নায়েব সুবেদার কাজী আলী মোস্তফা, জাবিউল, লুৎফর রহমান (আহত), নান্নু মিয়া, হাবিলদার তরিকুল্লাহ ওরফে শহীদ, দুদু মিয়া, মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দীন, মো. ইউনুস, আবদুল ওহিদ, মুজিবুর রহমান, হাবিলদার জব্বার, মহীউদ্দীন, সালেহ আহমেদ, বাচ্চু মিয়া, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন- স ম বাবর আলী, মুস্তাফিজুর রহমান, এ এফ এম মুরাদ, মোড়ল আব্দুস সালাম, কামরুল ইসলাম খান, হাবলু, আব্দুল মোমেন, এনামুল হক, রবিউল ইসলাম তিনু, কাজল, নাজমুল, মাসুদ, নারায়ণ, বনমালী, কামরুজ্জামান, শেখ জলিল, রশিদ, মনোরঞ্জন, খায়রুল বাসার প্ৰমুখ।
কলারোয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপও অংশ নিয়েছিল। এ গ্রুপের মোসলেম উদ্দীন ও আব্দুল গাফফারের নেতৃত্বে শাহজাহান আলী আহমেদ, এ জেড নজরুল ইসলাম, আয়ুব আলী, রেজাউল হক, ডা. আবু ইব্রাহিম, শামসুর রহমান, আব্দুল মাজেদ প্রমুখ অংশ নেন। অন্য মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন সাতক্ষীরা সদরের। [মিজানুর রহমান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড