You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভোলা ওয়াপদা ক্যাম্প নির্যাতনকেন্দ্র (ভোলা সদর)

ভোলা ওয়াপদা ক্যাম্প নির্যাতনকেন্দ্র (ভোলা সদর) কলেজ রোডের পূর্বপাশে এবং ভকেশনাল রোডের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ যোগীরঘোল মোড়ে এর অবস্থান। ভোলার দক্ষিণের সবগুলো থানা সদরের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র রাস্তাটি ওয়াপদা কলোনির পাশ দিয়ে চলে গেছে। ওয়াপদার পশ্চিম দিকে মূল গেট। ১৯৭১ সালে ওয়াপদায় নির্বাহী প্রকৌশলীর একতলা ভবন, রেস্ট হাউজ, বিশাল টিনশেড ঘর, মসজিদ ও তিনটি বাসভবন ছিল। ওয়াপদার পূর্বদিকের সীমানা প্রাচীরের বাইরের স্থানটি যোগীরঘোল বধ্যভূমি ও গণকবর হিসেবে পরিচিত|
১৯৭১ সালের ৬ই মে সকালে ক্যাপ্টেন কায়ানি ও সুবেদার নওয়াব হোসেনের নেতৃত্বে পাকবাহিনী ভোলা খেয়াঘাটে উপস্থিত হয়। সেখানে ভোলা মহকুমা শান্তি কমিটি-মুসলিম লীগ-এর সদস্যরা তাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে ভোলা ওয়াপদায় নিয়ে যায়। জুন মাসে কায়ানি ও নওয়াব হোসেনকে বদলি করে ক্যাপ্টেন মনির হোসেন ও সুবেদার ছিদ্দিককে ভোলায় পাঠানো হয়। পরবর্তীতে মেজর জাহানজেব খান এবং ক্যাপ্টেন আলতাফ ও তারেক ভোলায় আসে।
৬ই মে পাকবাহিনী ওয়াপদায় পৌছে ওয়াপদা গেটে বাংকার খনন করে সশস্ত্র পাহারাসহ বরিশাইল্লা দালানের সামনে ও অন্যান্য স্থানে পাহারা বসায়। পরবর্তীতে তারা ওয়াপদার পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণের দেয়ালে পাকা বাংকার করে এবং ভবনের ছাদে দুটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার বসায়। ঐসব বাংকার ও পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে ব্যাপক অস্ত্র মজুদ করা হয়। ওয়াপদার রেস্ট হাউজকে তারা বিনোদন কেন্দ্র, টিনের ঘরকে ব্যারাক এবং পূর্বদিকের দুটি দ্বিতল আবাসিক ভবনকে বন্দিশালা, নির্যাতনকেন্দ্র ও গোপন পরামর্শ স্থান হিসেবে ব্যবহার করে।
৬ই মে থেকে ১০ই ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত পাকবাহিনী ভোলায় অবস্থান করে। ভোলায় পৌঁছেই তারা ওয়াপদার কর্মকর্তাদের অন্তরীণ করে এবং মহকুমা শহরে কর্মরত অন্যান্য কর্মকর্তাদের ওপর কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা নেয়।
বিভিন্ন ইউনিয়নে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলশামস বাহিনী গঠন করে এবং এসব বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণসহ থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে। এরপর তাদের মধ্যে বিভিন্ন থানার দায়িত্ব বণ্টন করে দেয়। এক পর্যায়ে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, হত্যা, নারীনির্যাতনসহ বিভিন্ন প্রকার অমানবিক কাজ শুরু করে। ক্রমান্বয়ে তাদের এ পৈশাচিক কাজের মাত্রা বাড়তে থাকে।
১৯৭১ সালের ১লা জুন টিক্কা খান ভোলা শহরে এসে ওয়াপদায় পাকবাহিনী ও শান্তি কমিটির সঙ্গে বৈঠক করে তাদের নীলনকশার কথা বলে যায়। সে ভোলা ত্যাগ করার পরপরই বিভিন্ন থানার পুলিশ, রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা পাকবাহিনীর নির্দেশ অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়া লোকদের পরিবার, আওয়ামী লীগ নেতাদের পরিবার, হিন্দু পরিবার, স্বাধীনতার পক্ষের লোকজন, শহরত্যাগী ব্যক্তি ও পরিবার, আশ্রয়দাতাদের পরিবার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করার অভিযান শুরু করে। এ- সময় তারা পরিচয় পত্র প্রদানের নামে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে। পাকবাহিনী ওয়াপদা থেকে এ কাজের তদারক করত। পাকদোসররা পাকবিরোধীদের তালিকা ওয়াপদায় দাখিল করে। অতঃপর উক্ত তালিকা অনুযায়ী পাকবাহিনী ভোলা শহরসহ বিভিন্ন স্থানে ধ্বংসাত্মক অভিযান শুরু করে। তারা তালিকা অনুযায়ী বিভিন্ন থানা থেকে স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের গ্রেফতার করে ওয়াপদায় পাঠানোসহ প্রয়োজনে হত্যার নির্দেশ দেয়। সে নির্দেশ অনুযায়ী তারা বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, গ্রেফতার, নির্যাতন ও হত্যার মাত্রা ক্রমশই বাড়তে থাকে। বিভিন্ন স্থান থেকে নারীদের বন্দি করে ওয়াপদায় পাঠানো হতো। অভিযানের সময় লুণ্ঠিত মালামাল ওয়াপদায় এনে বণ্টন করা হতো। শান্তি কমিটির ঊর্ধ্বতন সদস্যদের লুণ্ঠিত মালামাল উপঢৌকন হিসেবে ন্যদের দেয়া হতো।
বিভিন্ন স্থান থেকে বন্দিদের ওয়াপদায় নিয়ে আসার পর প্রথমে বন্দিশালায় আটকে রাখা হতো। অতঃপর পাশের নির্যাতন কক্ষে নিয়ে বিভিন্ন কায়দায় অমানুষিক নির্যাতন করা হতো। নির্যাতন কক্ষে লোহার বড়-বড় সুই, মরিচ, দড়ি, মুখ বাঁধার কাপড়, লাঠিসহ নির্যাতনের বিভিন্ন উপকরণ ছিল। নির্যাতিতদের কোনো খাবারও দেয়া হতো না। দালালরা বন্দিদের কাছে টাকা ও নারী দাবি করত। যে কোনোটাই দিতে পারত না, তাকে হত্যা করা হতো। টাকা দিয়ে দালালদের সন্তুষ্ট করে কেউ-কেউ মুক্তি পেয়েছে। আবার টাকা দেয়ার পরেও কাউকে-কাউকে হত্যা করা হয়েছে।
ওয়াপদা থেকে অনেক বন্দিকে ভোলা থানায় প্রেরণ করা হতো। আবার অনেককে ওয়াপদায় হত্যা করে পাশের গণকবরে লাশ মাটিচাপা দেয়া হতো। অনেক সময় ওয়াপদা ও থানা থেকে বন্দিদের হাত-মুখ বেঁধে গভীর রাতে গাড়িতে করে ভোলা খেয়াঘাটে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো এবং লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হতো। পাকবাহিনী প্রায় রাতেই ওয়াপদা ও খেয়াঘাটে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে।
পাকবাহিনীর ওয়াপদা ক্যাম্প শুধু মানুষের জীবন ও সম্পদই কেড়ে নেয়নি, নিয়েছে ভোলার অনেক মা-বোনের সম্ভ্রমও। ওয়াপদা রেস্ট হাউজ ছিল নারীনির্যাতনের মূলকেন্দ্র। মেজর জাহানজেব খান ভোলার দায়িত্ব গ্রহণের পর নারীনির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। নারী সরবরাহের দায়িত্ব পালন করে কয়েকজন পাকদোসর। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সাধনা রাণী দত্ত (নির্যাতিত), দুলাল ড্রাইভার, নুরু দফাদার, আবদুল্লাহ মৌলভী, মোহাম্মদ টনি (পরে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত), ইউনুছ, জয়নাল মাতব্বর, সৈয়দ দালাল (পরে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত), মোতাহার দালাল পরে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত) প্রমুখ। এরা বিভিন্ন স্থান থেকে নারীদের এনে দিত। আবার অনেক নারীকে বন্দি করে ওয়াপদায় নিয়ে আসা হতো। কয়েকজন নারী মেজর জাহানজেব খানকে সন্তুষ্ট করার জন্য নিয়মিত ওয়াপদায় যেতে বাধ্য হন। আবার জাহানজেব স্বয়ং শহরের দু-একজন নারীর বাসায় নিয়মিত যাতায়াত করত। ওয়াপদায় নির্যাতিত হয়ে দু-একজন নারী আত্মহত্যাও করেছেন। কেউ-কেউ ধর্ষণকালে মারা গেছেন, আবার ধর্ষণের পর কাউকে-কাউকে হত্যা করা হয়েছে। অনেক নারীকে নিয়মিত ধর্ষণের জন্য ওয়াপদায় বন্দি করে রাখা হয়েছিল। এভাবে নারীনির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ভোলা শহর থেকে নারী ও যুবতীরা অন্যত্র পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। বিভিন্ন স্থানে অভিযানের সময়ও নারীনির্যাতনের ঘটনা ঘটে।
পাকবাহিনীর মনোরঞ্জনের জন্য পাকদোসররা মাঝে-মাঝে ওয়াপদায় নাচগানের আয়োজন করত। এখানকার নির্যাতনকেন্দ্রে কত নারী নির্যাতিত হয়েছেন তার সঠিক হিসাব পাওয়া কঠিন। সামাজিক কারণে অনেকে নির্যাতিত নারীদের তথ্য দিতে সম্মত হয়নি। বহু চেষ্টা করে কয়েকজনের নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। তারা হলেন- মালতী রাণী, শোভা রাণী, শেফালী পাল, কাজল ব্যানার্জী, চন্দনা, মায়া, মিলনি, শামসুন্নাহার মাহমুদ, মাধবী, লুৎফা, ডেইজী, সাধনা রাণী দত্ত, লাভলী, অলকা রাণী পাল, আলো রাণী, জ্যোৎস্না রাণী প্রমুখ। ১০ই ডিসেম্বর ভোলা মুক্ত হবার দিন ওয়াপদার পূর্বদিকের একটি ভবনের বন্দিশালার নীচতলার একটি তালাবদ্ধ কক্ষ থেকে ১৭ জন নারীকে উদ্ধার করা হয়।
পাকবাহিনী কত লোককে বন্দি করেছিল এবং কত লোককে হত্যা করেছিল, তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে তাদের মধ্যে মুক্তি পাওয়া কয়েকজন হলেন- ডা. ফজলি হোসেন ওরফে চুন্নু মিয়া, অধ্যক্ষ কারুফুর রহমান, প্রশান্ত করণজাই, সিরাজ মিয়া, সুরেশ ডাক্তার, মো. শফিকুল ইসলাম, আজিজুল ইসলাম মিয়া, কাদির বেপারী, এলাহি বক্স, বিষ্ণু ব্যানার্জী, সুকোমল কর্মকার, আবু তাহের, মোখলেছুর রহমান, অজিত কুমার খলিফা, অতুল চন্দ্ৰ সাহা, খালেক কমান্ডার, অনুজ কাহানী, আলম, আ ন ম বজলুর রশীদ, কবির তালুকদার, কর্পোরেল হানিফ মিয়া, ছাদেক আহম্মদ বেপারী, কাজল, দেলোয়ার হোসেন, কেলু মিয়া, আবুল বাশার, আকছার উদ্দিন বাবুল, এডভোকেট শাজাহান, তরিকুল ইসলাম, আল্লাদ চান, তপন, মতিলাল দে, শামছুল হক মাতব্বর, রস্তুম মাঝি এবং এডভোকেট মোস্তফা কামাল।
নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে পাকবাহিনীর কার্যক্রম ভোলা শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা ভোলা শহরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে চোরা গোপ্তা হামলা চালিয়ে পাকবাহিনীকে শঙ্কিত করে তোলেন। এ অবস্থায় পাকদোসররা আত্মগোপন করতে থাকে। কেউ-কেউ ধরাও পড়ে। ১০ই ডিসেম্বর সকালে শান্তি কমিটির মো. ইলিয়াছ মিয়া মাস্টার, কুখ্যাত রাজাকার মোহাম্মদ টনি ও আবুল কাসেম তালুকদারসহ পাকবাহিনী গোলাবর্ষণ করতে-করতে ভোলা ত্যাগ করে। হাইকমান্ড ছিদ্দিক মিয়া সহযোদ্ধাদের নিয়ে ওয়াপদায় অবস্থান নেন। ওয়াপদাসহ ভোলা পাকিস্তানি নরপশুদের দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত হয়। [মো. রফিকুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!