মুক্তিযুদ্ধে ভূঞাপুর উপজেলা (টাঙ্গাইল)
ভূঞাপুর উপজেলা (টাঙ্গাইল) ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারা দেশবাসীর মতো ভূঞাপুরের ছাত্র-জনতাও উপলব্ধি করতে পারে যে, মুক্তিযুদ্ধ অত্যাসন্ন। ২৫শে মার্চ ঢাকায় পাকবাহিনীর নির্মম গণহত্যার পর তারা নিশ্চিত হয় যে, যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তাই ২৬শে মার্চ টাঙ্গাইল জেলা স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ গঠিত হয়। এরপর ২৮শে মার্চ – ভূঞাপুর কলেজের কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে ছাত্রনেতা সৈয়দ জিয়াউল হককে আহ্বায়ক ও আব্দুল আলীম তালুকদারকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে ভূঞাপুর সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সেদিনই সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ ভূঞাপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ভূঞাপুর ডাকবাংলোতে সংগ্রাম কমিটির অফিস স্থাপিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতিস্বরূপ ভূঞাপুর কলেজ মাঠে শুরু হয় বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণের কমান্ডার ছিলেন এ ছুটিতে আসা বাঙালি সেনাসদস্য আকবর হোসেন চকদার ও নওয়াব আলী গেরিলা। সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আরো জোরদার হয়। কলেজ মাঠ ছাড়াও ডাকবাংলো মাঠ, ভূঞাপুর চৌধুরী বাড়ি, গোবিন্দাসী ইউনিয়ন বোর্ড মাঠ, বলরামপুর হাইস্কুল মাঠ এবং , বামনহাটা হাটখোলা মাঠে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপিত হয়। ল কিছুদিন পরে মাটিকাটা, সিরাজকান্দি, নলছিয়া, কালিগঞ্জ, থ বামনহাটা, অর্জুনা, ভরুয়া প্রভৃতি ঘাট থেকে নৌপথে টাঙ্গাইল জেলার ছাত্র-যুবকরা প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা ট্রেনিং সেন্টারসহ বিভিন্ন ট্রেনিং সেন্টারে যেতে ল থাকেন। ট্রেনিংশেষে অস্ত্র ও গোলা-বারুদসহ দেশে ফিরে তাঁরা পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আলবদর ও আলশামস-এর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেন। ন মুক্তিযুদ্ধের সময় ভূঞাপুর ডাকবাংলোটি ছিল কাদেরিয়া বাহিনী-র উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের হেডকোয়ার্টার্স। ভূঞাপুর থেকেই সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কালিহাতী, ঘাটাইল, গোপালপুর প্রভৃতি অঞ্চলে যুদ্ধের কৌশল ও পরিকল্পনা নির্ধারিত হতো। উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃস্থানীয় সংগঠকরা হলেন- হাতেম আলী তালুকদার এমএনএ (গোপালপুর), বদিউজ্জামান খান এমপিএ (বিরামদী; টাঙ্গাইল জেলা স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদের চেয়ারম্যান), সৈয়দ জিয়াউল হক (ভারই), আব্দুল আলীম তালুকদার (শিয়ালকোল), খন্দকার হাবিবুর রহমান (বামনহাটা; কোম্পানি কমান্ডার), আসাদুজ্জামান আরজু (বলরামপুর; কোম্পানি কমান্ডার), আব্দুল কদ্দুস (ছাব্বিশা; পরবর্তীতে ভূঞাপুর যুদ্ধে শহীদ), শামসুল হক মিঞা (বাগবাড়ি), খোদা বখশ মিঞা (সাফলকুড়া), আজিজুর রহমান তরফদার ওরফে আজিজ বাঙ্গাল (ভূঞাপুর), মাসুদুল হক মাসুদ (বাগবাড়ি), শামছুল হক তালুকদার (মাদারিয়া), আব্দুল হামিদ ভোলা (ভারই), মোতাহের আলী মিঞা (ভারই) প্রমুখ।
১৪ই আগস্ট পাকবাহিনী ভূঞাপুরে প্রবেশ করে ভূঞাপুর হাইস্কুল হোস্টেল, গালর্স হাইস্কুল ও নিকরাইল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। তবে তাদের এই ক্যাম্প দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ৮ই অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে এসব ক্যাম্পের পতন ঘটে।
ভূঞাপুরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের মধ্যে আশরাফ মাওলানা ও আব্দুল্লাহ হেল ওয়াছেক শীর্ষস্থানীয়। আশরাফ মাওলানার বাড়ি নিকরাইলে। সে রাজাকারের কমান্ডার ছিল। ১৯৭০ সালে জামায়াতে ইসলামী-র মনোনয়নে জাতীয় পরিষদে নির্বাচন করে। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর দোসর হিসেবে হত্যাকাণ্ড, নারীধর্ষণ ও লুটপাটের হোতা ছিল সে। তার আদেশে এলাকার বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ রাজাকারের খাতায় নাম লেখায়। আশরাফ মাওলানা নিকরাইল পলশিয়া রাণী দিনমণি উচ্চ বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে চাকরি করত। বেশ কয়েক বছর আগে অবসর নেয় ৷ সে জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় নেতা ছিল।
আব্দুল্লাহ হেল ওয়াছেকও রাজাকার কমান্ডার ছিল। তার বাড়ি নিকলা দড়িপাড়ায়। বর্তমানে সে টাঙ্গাইলের আকুরটাকুরপাড়ায় বসবাস করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে নারী সরবরাহ এবং জোরপূর্বক হিন্দুদের ধর্মান্তরকরণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজাকার আইনে সে ৭ মাস কারাবরণ করে সাধারণ ক্ষমায় ছাড়া পায়।
১৭ই নভেম্বর স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনী ছাব্বিশা গ্রামে এক ভয়াবহ গণহত্যা চালায়, যা ছাব্বিশা গণহত্যা নামে পরিচিত। এখানে শিশু ও নারীসহ ৩২ জন গ্রামবাসী শহীদ হন এবং অর্ধশতাধিক আহত হন। নিহতদের যেখানে কবর দেয়া হয় তা ছাব্বিশা গণকবর নামে খ্যাত।
১৩ই আগস্ট পাকবাহিনী ভূঞাপুর সাবরেজিস্ট্রার অফিসসহ বাজারের উত্তর সারির প্রায় সবগুলো দোকান পুড়িয়ে দেয়। এছাড়া পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রাম ও পাড়ার ৩০-৩৫টি বাড়িতে আগুন দেয়। ভূঞাপুরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাম হচ্ছে ছাব্বিশা। ১৭ই নভেম্বর হানাদার বাহিনী পুরো গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়। এতে তিন শতাধিক ঘরবাড়ি সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হয়।
ভূঞাপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। সেসবের মধ্যে জাহাজমারা যুদ্ধ, ভূঞাপুর যুদ্ধ ও ছাব্বিশা যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১১ই আগস্ট জাহাজমারা যুদ্ধে পাকবাহিনীর দুটি জাহাজ ধ্বংস হয় এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। ৮ই অক্টোবর ভূঞাপুর যুদ্ধে পাকবাহিনী পালিয়ে যায় এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন ও ১০৮ জন রাজাকার বন্দি হয়। ১৭ই নভেম্বর ছাব্বিশা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলগত কারণে পশ্চাদপসরণ করেন। এছাড়া ১৮ই নভেম্বর ভূঞাপুরের অদূরে লৌহজং নদীতে পাকসেনাদের পাঁচটি গানবোটে আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেন|
এতে নেতৃত্ব দেন কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম। ৮ই অক্টোবর ভূঞাপুর উপজেলা শত্রুমুক্ত হয়।
ভূঞাপুরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুল কদ্দুস (পিতা মুন্সি নয়ান উদ্দিন, ছাব্বিশা), আমীর আলী (পিতা ছাবেদ আলী, তেঘরী), মোতালেব হোসেন তরফদার রকেট (পিতা তোতা তরফদার, পশ্চিম ভূঞাপুর), মহিউদ্দিন আহমেদ (পিতা হাজি বয়ান উল্লাহ, জিগাতলা), হাসানুজ্জামান লেবু (পিতা হোসেন আলী, রুহুলী), গাজিয়ার রহমান (পিতা জনাব আলী মণ্ডল, রুহুলী), আশরাফ হোসেন খান বাদশা (পিতা আকবর আলী খাঁ, অর্জুনা), জহুরুল ইসলাম (পিতা ওয়াজেদ আলী, ফলদা), হাফিজ উদ্দিন (পিতা নওজেস আলী, ফলদা), আকবর আলী (পিতা পাগু শেখ, জগৎপুরা), শামছুল হক (পিতা মোতাহের হোসেন, চিতুলিয়াপাড়া), আব্দুল হামিদ (পিতা আর্শিবাদ মণ্ডল, চিতুলিয়াপাড়া), নিজাম উদ্দিন (পিতা এলাহী বকস, চিতুলিয়াপাড়া), আমজাদ হোসেন (পিতা ইন্তাজ আলী, আমুলা), আব্দুল ওয়াহাব (পিতা আব্দুস সাত্তার মিঞা, চরনিকলা), আব্দুল করিম (পিতা আব্দুল আজিজ, গাড়াবাড়ি), হাবিবুর রহমান (পিতা খোরশেদ আলী জমাদ্দার, রামপুর), বাহাজ উদ্দিন (পিতা তালেব আলী, শিয়ালকোল), আজিজুল মামুন মিন্টু (পিতা এডভোকেট আব্দুল হাই, টেপিবাড়ি), জয়নুল আবেদীন (পিতা কাদের আলী, আগতেরিল্যা), আব্দুল গফুর (পিতা হাজী হোসেন আলী, আগতেরিল্যা), রফিকুল আলম (পিতা কাজিম উদ্দিন, পাছতেরিল্যা), আব্দুল মতিন (পিতা বুজরত আলী, মাদারিয়া), হযরত আলী (পিতা ছামান আলী, জিগাতলা) এবং জালাল উদ্দিন (পিতা মুন্সি আজগর আলী, কালিগঞ্জ)।
ভূঞাপুরে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে অনেক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে ভূঞাপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নির্মিত হয় একটি স্মৃতিসৌধ। ১৯৯৪ সালে গঠিত হয় ভূঞাপুর মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা পরিষদ। ১৯৯৫ সালের অক্টোবরে ভূঞাপুর ইবরাহীম খাঁ কলেজ প্রাঙ্গণে নির্মিত হয় বঙ্গবন্ধু তোরণ। একই স্থানে ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে নির্মিত হয় শহীদ আবদুল কদ্দুস ভবন। ২০০৫ সালে ভূঞাপুর বাসস্ট্যান্ডে নির্মিত হয় মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট। ২০০৬ সালের অক্টোবরে নির্মিত হয় ছাব্বিশা গণহত্যায় শহীদদের নামফলক। একই বছর নলুয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য স্বতন্ত্র কবরস্থান প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত করা হয়। ২০০৮ সালে নির্মিত হয় ভূঞাপুর স্বাধীনতা কমপ্লেক্স। ২০১০ সালের অক্টোবরে ভূঞাপুর লোকমান ফকির মহিলা কলেজ প্রাঙ্গণে নির্মিত হয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুজিবনগর সরকারের অর্থসচিব খন্দকার আসাদুজ্জামানের নামে খন্দকার আসাদুজ্জামান তোরণ। ২০১১ সালের নভেম্বরে একই স্থানে নির্মিত হয় ‘স্মৃতিস্তম্ভ ৫২-৭১’। ২০১২ সালে বাগবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নির্মিত হয় মুক্তিযোদ্ধা মাসুদুল হক মাসুদ মঞ্চ। ২০১৩ সালে মোবারক মাহমুদ উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নির্মিত হয় খন্দকার আসাদুজ্জামান মঞ্চ। ২০১৪ সালে নির্মিত হয় জাহাজমারা যুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ। এছাড়া দুজন শহীদের নামে দুটি সড়কের নামকরণ করা হয়। সড়ক দুটি হলো— শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেন সড়ক (নিকরাইল, ২০০৫) এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্রনাথ পাল সড়ক (কয়েড়া, ২০০৬)। এছাড়া যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেতু, সেতুর পূর্ব প্রান্তে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, বঙ্গবন্ধু ক্যান্টনমেন্ট, ভূঞাপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পাশে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স এবং উপজেলা পরিষদ ভবনের সামনে বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল নির্মিত হয়েছে। [শফিউদ্দিন তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড