You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে ভেদরগঞ্জ উপজেলা (শরীয়তপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে ভেদরগঞ্জ উপজেলা (শরীয়তপুর)

ভেদরগঞ্জ উপজেলা (শরীয়তপুর) রাজনীতি-সচেতন একটি এলাকা। ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের গণ- অভ্যুত্থান-এ এ উপজেলার ছাত্র ও যুবসমাজ অংশগ্রহণ করে। এছাড়া প্রগতিশীল ও বামপন্থী আন্দোলনেও এ উপজেলার মানুষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে ভেদরগঞ্জ-গোসাইরহাট থেকে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবিদুর রেজা খান বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। নির্বাচনের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলনে ভেদরগঞ্জের মানুষও অংশগ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর ভেদরগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র পর্বের প্রস্তুতি শুরু হয়। ২৬শে মার্চ থেকে ভেদরগঞ্জ থানার বিভিন্ন ইউনিয়নের মানুষ পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধে রাস্তায় নেমে পড়ে। ছাত্র, শিক্ষক, যুবক, কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুরসহ সকল স্তরের মানুষ ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘পিন্ডি না ঢাকা – ঢাকা ঢাকা’ ইত্যাদি গগণবিদারী স্লোগান দিয়ে এবং লাটিসোঁটা, তীর-ধনুকসহ মিছিলে অংশ নিয়ে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে।
২৭শে মার্চের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অন্যান্য দলের নেতাদের নিয়ে ভেদরগঞ্জে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির উদ্যোগে অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য, পুলিশ, আনসার, ছুটিতে আসা সেনা সদস্যদের সহায়তায় স্থানীয় যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হয়। ভেদরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে আগত ছাত্র-যুবক ও শ্রমিক-কৃষকরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।
ছয়গাঁও গ্রামের খান বাহাদুর খলিলুর রহমান শিকদারের বাড়িতে সেনাসদস্য মীর মহিউদ্দিন, আমিনুর রহমান মোল্লা সিরাজ ভূঁইয়া ও নিজাম উদ্দিন আকনের পরিচালনায় এবং বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুর রহমান চুন্নু শিকদার, আজিজুর রহমান হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুর রব শিকদার, আবুল কাসেম খান (শিক্ষক) শেখ জাফর আহমেদ, আলতামাস আকন্দ, কাজী মাসুদুর রহমান কালাম, আবদুল লতিফ খান বাচ্চু, আলতাফুর রহমান শিকদার, আজাদুর রহমান শিকদার, এস এম রফিকুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম শিকদার, পল্টু ভূঁইয়া, খোকা শিকদার প্রমুখের সক্রিয় সহযোগিতা ও অংশগ্রহণে প্রায় একশ প্রশিক্ষণার্থীকে দৈনিক প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। অনুরূপভাবে মহিষার, সাজনপুর, মহিষার সাজনপুর ভেদ গৈড্যা, দারুল আমান, রামভদ্রপুর, সখিপুরসহ অন্য চরাঞ্চলেও প্ৰশিক্ষণ চলত।
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে মাদারীপুর থেকে ছাত্রনেতা মাহবুব সাঈদ প্রশিক্ষণার্থী নির্বাচনের জন্য ভেদরগঞ্জ আসেন। তাঁর উপস্থিতিতে গৈড্যা স্কুল মাঠে শতশত মুক্তিযোদ্ধার প্রশিক্ষণের মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। এ মহড়া সেদিন এ অঞ্চলের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করে।
মাহবুব সাঈদ সেদিন প্রত্যেক থানা থেকে ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নির্বাচন করে মাদারীপুর পাঠানোর আহ্বান জানান। ভেদরগঞ্জ থেকে প্রথম ব্যাচে যাওয়া ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে আ. মান্নান রাঢ়ি, আকবর মাস্টার, আনিসুদ্দিন (মাস্টার), লাল শরীফ (নারায়ণপুর), আকবর (নারায়ণপুর), এলাহী (রামভদ্রপুর), আবুল বাসার (রামভদ্রপুর), আ. রহিম বেপারী (রামভদ্রপুর), জয়নাল আকন্দ, (সাজনপুর), রাজা সরদার (পম), শামসুল হক, আলী আজম ফরিদী, শেখ আবদুর রশিদ (গৈড্যা), খালেকুজ্জামান হাওলাদার (গৈড্যা) প্রমুখ ছিলেন। ভেদরগঞ্জ থেকে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে প্রেরণ করা হয়।
ভারতের অমপি নগরে পরিচালিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভেদরগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে অংশ নেন। জুন মাসে আ. মান্নান রাঢ়ি-কে দলপতি করে ২৫ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ১৮ জনকে একটি স্টেনগান, তিনটি ম্যাগাজিন এবং প্রত্যেককে দুটি করে মোট ৩৬টি হ্যান্ড গ্রেনেড দিয়ে দেশে পাঠানো হয়। এসব মুক্তিযোদ্ধা দেশের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
ভেদরগঞ্জ সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি আ. হাই মাস্টার, সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন খান, লাকার্তার আমিনুর রহমান শিকদার (চুন্নু মিয়া), সাজনপুরের সরদার মিজানুর রহমান, তফাজ্জল হোসেন মোড়ল, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আবদুর রব শিকদার, মাস্টার আবুল কাসেম, শেখ জাফর আহমেদ, আলতামাস আকন্দ, জৈনদ্দিন আকন্দ, আজিজুল হক মল্লিক প্রমুখ সংগ্রাম কমিটির সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে ভেদরগঞ্জে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
ভেদরগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে বিভিন্ন পর্যায়ে কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁরা হলেন— থানা কমান্ডার (এফএফ- বাহিনী) আবদুল মান্নান রাঢ়ি, গ্রুপ কমান্ডার মো. ইউসুফ খান (নারায়ণপুর), জাহান উল্লাহ হাওলাদার (কাঁচিকাটা); প্লাটুন কমান্ডার আবদুল জব্বার সরকার, নাছির পাইক, মাস্টার আলী আকবর; ক্যাম্প ইনচার্জ মোসলেম মাস্টার (গৈড্যা বোর্ড), কাজী আ. রশিদ (মহিষার গাঙ্গুলী বাড়ি), লুৎফর রহমান সরকার (সখিপুর তহসিল অফিস); মুজিব বাহিনী- থানা কমান্ডার শাজাহান মুন্সী, ডেপুটি কমান্ডার মফিজুল ইসলাম টুলু ও তোফাজ্জল হোসেন মোড়ল।
ভেদরগঞ্জে প্রাথমিকভাবে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়নি। সমগ্র ভেদরগঞ্জ উপজেলা অঞ্চলে পাকবাহিনী কোনো ক্যাম্প স্থাপন করেনি। পাকবাহিনী মাদারীপুর থেকে এসে ভেদরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করত। এ উপজেলায় শহীদ আক্কাসের নামানুসারে ‘আক্কাস বাহিনী’ নামে একটি বাহিনী গড়ে উঠেছিল। এ বাহিনী ভেদরগঞ্জ থানায় দুবার অপারেশন চালায়। এছাড়া এ বাহিনী পালং, নড়িয়া ও ডামুড্যার বিভিন্ন যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করে। আক্কাস বাহিনীতে ইপিআর ও সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার ও সিপাহির সংখ্যাধিক্য ছিল। আক্কাস বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার জয়নাল আবেদীন। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন— জয়নুল হক শিকদার, সুবেদার আলী আহমদ, হাবিলদার আবদুর রশিদ, হাবিলদার হাফিজুর রহমান, হাবিলদার ইউসুফ আলী মোল্লা, হাবিলদার আবদুল মান্নান, নায়েক আবুল কালাম, নায়েক হাফিজ উদ্দিন রাঢ়ি, সিপাহি আবদুল মান্নান রাঢ়ি, সিপাহি সামসুল হক তরফদার, সিপাহি আবদুর রশিদ মাঝি, আবদুল খালেক রাঢ়ি, এস এম ওসমান মাদবর, সিপাহি গোলাম মোহাম্মদ, সিপাহি আবুল হাসেম লাকী, সিপাহি আজগর আলী হালদার, এস এম আবদুল মালেক মোল্লা, এসএম আবদুল হামিদ ছৈয়াল, নায়েক আবদুল মান্নান মেলকার, আবু তাহের (ভেদরগঞ্জ), সিপাহি সামসুদ্দিন মাঝি, হাবিব ঢালী, সিপাহি আলাউদ্দিন মাঝি, আবু বাকার, হাবিবুর রহমান হাওলাদার, সিপাহি আহমদ আলী হাওলাদার, সিপাহি সফদর আলী ছৈয়াল, সিপাহি আবদুর রব মাঝি, আলী আজম শিকদার, নাছির মাস্টার, আরজুব আলী দপ্তরী, ডাক্তার কাঞ্চন, আক্কাস আলী চৌকিদার, আমির হোসেন চেয়ারম্যান, হাসু খলিফা প্রমুখ।
মাদারীপুর মহকুমা শান্তি কমিটির সদস্য ইউসুফ বালা (তারাবুনিয়া) ও আইয়ুব আলী সরদার (রামভদ্রপুর) ভেরদগঞ্জে পাকবাহিনীর প্রধান সমর্থক ছিল। এছাড়া নূর মোহাম্মদ বাবুর্চি, তৈয়ব আলী সরদার, রমিজ খান, তমিজ খান, আলী বক্স তফাদার, আ. করিম মোল্লা (মহিষার), আবদুর রশিদ ফকির, আবদুর রশিদ চৌকিদার, রফিজ উদ্দিন ঢালী, জয়নাল আবেদীন খান, মকবুল হোসেন মোল্লা, চুন্নু হাওলাদার, সোলায়মান উকিল, নজরুল ইসলাম সরদার, ইয়াকুব আলী সরদার, হাবিবউল্লাহ চোকদার প্রমুখ উপজেলা শান্তি কমিটির সদস্য ছিল। এদের কেউ-কেউ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য বা স্থানীয় প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত ছিল। এরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সকল তৎপরতা চালাত।
সমগ্র উপজেলায় রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের প্রভূত ক্ষতিসাধন করে। উপজেলার কুখ্যাত রাজাকাররা হলো- আবদুর রশিদ ফকির (সাজনপুর), আবদুর রশিদ ঢালী (সাজনপুর), হাফেজী (চন্ডালকান্দি), মান্নান মোল্লা (মহিষার), রশিদ চৌকিদার (সাজনপুর) ও শাজাহান হাওলাদার (মহিষার)। এরা পাকবাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন গ্রামের হিন্দুদের ও মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি দেখিয়ে দেয়া এবং হত্যা-লুণ্ঠন-অগ্নিসংযোগে সব ধরনের সহযোগিতা করত।
মে মাস থেকে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা ভেদরগঞ্জ থানার বিভিন্ন এলাকায় অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করে। পাকবাহিনী ও রাজাকাররা ১২ই জুন আকস্মিকভাবে ভেদরগঞ্জ বাজারে এসে অগ্নিসংযোগ ও গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এ সময় তারা বাড়ৈ বাড়ি, মমিন আলী বেপারীর বাড়ি, বড়বাড়ি ও চোকদার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
জুন মাসে সাজনপুর বাজারে এসে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা অগ্নিসংযোগ করে এবং মহিষার গ্রামে লুটপাট শেষে বহু বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়।
পাকবাহিনী সাজনপুর/পুটিজুরীতে অগ্নিসংযোগ করে। এখানে দেবীদাস ঘোষাল, বান্দু দাস, শংকর চন্দ্র দাস, মাধব শীল প্রমুখের বাড়ি লুটপাট করে। নারায়ণপুরে জমিদার বাড়ি ও ইউনুস খাঁর বাড়িতে লুণ্ঠনের পর আগুন ধরিয়ে দেয়।
ভেদরগঞ্জ উপজেলার মহিষার গ্রামে ১৫ই অক্টোবর ডামুড্যা বাজার যুদ্ধএ (দ্রষ্টব্য ডামুড্যা উপজেলা) শহীদ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধি রয়েছে। তাঁরা গোপালগঞ্জ থেকে ক্যাপ্টেন বাবুলের নেতৃত্বে ডামুড্যা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং শহীদ হন।
পালং-এর মধ্যপাড়া হত্যাযজ্ঞ ও নড়িয়া হত্যাকাণ্ডের পর সিরাজ সরদারের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা ভেদরগঞ্জ থানার সাজনপুর বাজারে কুখ্যাত রাজাকার রশিদ ফকিরের ওপর আক্রমণ চালায় এবং সে নিহত হয়। এ অপারেশনের ফলে এলাকার মুক্তিকামী মানুষের মনোবল বৃদ্ধি পায়।
জুলাই মাসে ভেদরগঞ্জ থানার ডিবি দারোগাকে সিরাজ শিকদার সমর্থক বাহিনী রাতে ধরে নিয়ে হত্যা করে লাশ “নদীতে ভাসিয়ে দেয়।
১১ই জুলাই পালং থেকে ১৫ জন রাজাকার নৌকাযোগে ভেদরগঞ্জ যাওয়ার সময় সাজনপুর বাজারের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আ. মান্নান রাঢ়ি এ আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। তিনি রাজাকারদের ধরার জন্য ৭-৮ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে সাজনপুর বাজারের কাছে খালের পাড়ে ওঁৎ পেতে থাকেন। রাজাকারদের নৌকা মুক্তিযোদ্ধাদের আওতার মধ্যে আসার সঙ্গে-সঙ্গে তাদের আটক করা হয় এবং কার্তিকপুর লঞ্চঘাটে নিয়ে তাদের হত্যা করা হয়।
১৯শে জুলাই সকালে মাদারীপুরের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি স্টুয়ার্ড মুজিবের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল ভেদরগঞ্জ থানা যুদ্ধ করে। শত্রুরা পাল্টা আক্রমণ করলে দুই পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়। থানা আক্রমণে কমান্ডার আ. মান্নান রাঢ়ি এবং পূর্ব মাদারীপুরের আঞ্চলিক কমান্ডার ইউনুস আলী খান মিতালীর নেতৃত্বে এস এম কামালউদ্দিন মন্টুসহ ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দলও যোগ দেয়। ৪ ঘণ্টা স্থায়ী যুদ্ধে আ. রশিদ কাজীসহ কয়েকজন গুরুতরভাবে আহত হন। এ-যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্কাস আলী মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। তাঁর মৃতদেহ বহন করে আনেন ছয়গাঁও-এর মুক্তিযোদ্ধা আমিনুর রহমান মোল্লা। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ১০ই অক্টোবর মান্নান রাঢ়ির নেতৃত্বে ১০০ জন, জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে ৫০ জন এবং ফরিদপুর জেলা মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক ও আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি ক্যাপ্টেন নুর মোহাম্মদ বাবুলের নেতৃত্বে ফরিদপুর-গোপালগঞ্জ অঞ্চল থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধাদের এক বিশাল বাহিনী যৌথভাবে আবার ভেদরগঞ্জ থানা আক্রমণ করে। প্রথমে ভেদরগঞ্জ থানার উত্তর দিক, পরে পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। যুদ্ধের কৌশল হিসেবে দক্ষিণ দিক খোলা রাখা হয় এবং দক্ষিণ দিকে থানা থেকে প্রায় অর্ধ কিলোমিটার দূরে এম্বুশরত দলকে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়। ভোর ৫-টায় যুদ্ধ শুরু হয়। সারাদিন যুদ্ধ চলার পর থানার বড় দারোগা একটি এলএমজি এবং একটি পিস্তলসহ থানা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় এম্বুশরত দলের গুলিতে নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে পাক-দোসরদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হয়। ফলে কয়েকজন ইপিআর সদস্য আত্মসমর্পণ করে। রাত প্রায় বারোটার দিকে ভেদরগঞ্জ থানা সম্পূর্ণভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। ভেদরগঞ্জ থানা অপারেশনে পুলিশ ও স্থানীয় বেশ কয়েকজন রাজাকারসহ ৮৫ জন নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা থানা থেকে দুটি এলএমজি-সহ অন্যান্য অস্ত্র এবং গোলাবারুদ দখল করেন। এ অপারেশনের সময় ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও কয়েকজন আহত হন। স্থানীয় জনসাধারণের অংশ নেয়া এ-যুদ্ধে বিজয়ের ফলে ভেদরগঞ্জে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলিত হয়। ১০ই অক্টোবর ভেদরগঞ্জ থানা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- মো. খলিলুর রহমান, বীর প্রতীক (পিতা মো. খবির উদ্দিন আহমেদ, কুড়ালতলি)। ভেদরগঞ্জের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আক্কাস আলী (পিতা সুবেদার অব. আরব আলী, মহিষার), সরদার মহিউদ্দিন (পিতা মঙ্গল সরদার, পম), সরদার শহিদুল্লাহ (পিতা লাল শরিফ সরদার, পম), আব্দুল মান্নান সরদার (পিতা মঙ্গল সরদার, ইকরকান্দি), আলী আহাম্মদ ছৈয়াল (পিতা রমিজ উদ্দিন ছৈয়াল, ছয়গাঁও), জয়নাল আবেদীন (পিতা জালাল বেপারী, রামভদ্রপুর), আশ্রাব আলী দেওয়ান শহিদ (পিতা আলী মুদ্দিন দেওয়ান), আ. আজিজ পাজুরী (পিতা লাল শরীফ পাজুরী, রামভদ্রপুর), আক্কেল আলী মীর (পিতা নোয়াব আলী মীর, রামভদ্রপুর), জয়নাল আবেদীন (পিতা আইয়ূব আলী মীর মালত, সত্যপুর), ছায়েদুর রহমান (পিতা আ. মজিদ মাঝি, বাঐকান্দি), আফসার উদ্দিন মীর মালত (পিতা আমান উদ্দিন মীর মালত, রামভদ্রপুর), বিলাল মাদবর (মহিষার), আনিছ উদ্দিন সরদার (৪ নং ওয়ার্ড গৈড্যা) এবং চুন্নু মিয়া হাওলাদার (গৈড্যা)।
থানার মহিষার গ্রামে ডামুড্যা যুদ্ধে শহীদ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার কবর রয়েছে। কবরে তাঁদের নাম লেখা রয়েছে। [আবদুর রব শিকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড