ভেদরগঞ্জ থানা যুদ্ধ (ভেদরগঞ্জ, শরীয়তপুর)
ভেদরগঞ্জ থানা যুদ্ধ (ভেদরগঞ্জ, শরীয়তপুর) সংঘটিত হয় দুবার – ১৯শে জুলাই ও ১০ই অক্টোবর। দ্বিতীয়বারের যুদ্ধে পুলিশ, ইপিআর ও রাজাকারসহ শত্রুপক্ষের ৮৫ জন নিহত হয় এবং থানা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। এখানে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
পদ্মা-মেঘনা উপকূলের বিস্তীর্ণ চর এলাকা নিয়ে গঠিত ভেদরগঞ্জ থানা দখলে রাখতে পাকবাহিনী এখানে রাজাকার, পাকিস্তানপন্থী ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তোলে। থানা সদর থেকে তারা সমগ্র এলাকায় পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। থানাকে শত্রুমুক্ত করতে মাদারীপুর অঞ্চলের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা – আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে ১৯শে জুলাই ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল অতর্কিতে থানা আক্রমণ করে। সেদিন থানায় অবস্থানরত পুলিশের প্রচণ্ড গুলির মুখে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। এ অপারেশনে বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্কাস আলী শহীদ হন।
এরপর অক্টোবর মাসে চতুর্দিকে যখন বিভিন্ন অপারেশনে মুক্তিবাহিনী বিজয় অর্জন করছিল এবং যখন পালং-নড়িয়া থানার বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্রায় শত্রুমুক্ত, তখন মুক্তিযোদ্ধারা ভেদরগঞ্জ থানা আক্রমণ করার জন্য ৮ই অক্টোবর নড়িয়া থানাধীন পঞ্চপল্লী স্কুলে একটি জরুরি বৈঠক করেন। এ বৈঠকে শরীয়তপুর জেলা অঞ্চলের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ইউনুস আলী মিতালী, ভেদরগঞ্জ থানা কমান্ডার আ. মান্নান রাড়ি, নড়িয়া থানা কমান্ডার এস এম কামালউদ্দিন মন্টু, ডেপুটি কমান্ডার জেমস বাবুল, মুক্তিযোদ্ধা জয়নুল হক শিকদার, পালং থানা কমান্ডার মাস্টার ইদ্রিস আলী, আক্কাস বাহিনীর প্রধান সুবেদার জয়নাল আবেদীন, আবুল কাশেম মৃধা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ১৯শে জুলাই ভেদরগঞ্জ থানা অপারেশনের ব্যর্থতার কারণ বিশ্লেষণ এবং নতুন আক্রমণ পরিচালনা করে ভেদরগঞ্জ এলাকা শত্রুমুক্ত করার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা শেষে পরিকল্পনা নেয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভেদরগঞ্জ থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল মান্নান রাড়ির নেতৃত্বে ১০০ জন, জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে ৫০ জন, ফরিদপুর জেলা মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক ও আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি ক্যাপ্টেন নূর মোহাম্মদ বাবুলের নেতৃত্বে ফরিদপুর-গোপালগঞ্জ অঞ্চল থেকে আগত একটি বড় দল (যারা সাজনপুর হাইস্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে অবস্থান করেছিলেন)-সহ প্রায় ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা যৌথভাবে ভেদরগঞ্জ থানা আক্রমণ করেন। জয়নুল হক শিকদার (বর্তমানে শিল্পপতি, শিকদার মেডিকেল কলেজার প্রতিষ্ঠাতা)-সহ অনেক স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা এ-যুদ্ধে অংশ নেন। প্রথমে থানার উত্তর দিকে, পরে পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। কৌশলগত কারণে দক্ষিণ দিক খোলা রেখে প্রায় অর্ধকিলোমিটার দূরে এম্বুশ দলকে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়।
১০ই অক্টোবর ভোরে যুদ্ধ শুরু হয় থানা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ করে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও পরিস্থিতি ধীরে-ধীরে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে আসতে থাকে। এ অবস্থায় থানার বড় দারোগা রাতের অন্ধকারে এলএমজি এবং পিস্তল-সহ থানা থেকে পালিয়ে যায়। তবে নিকটবর্তী স্থানে ওঁৎ পেতে থাকা এম্বুশ পার্টির গুলিতে সে নিহত হয়। এক সময় মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে থানায় অবস্থানরত পুলিশ, ইপিআর ও রাজাকারদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হয়। ফলে কয়েকজন ইপিআর সদস্য আত্মসমর্পণ করে। রাত ১২-টার দিকে ভেদরগঞ্জ থানা সম্পূর্ণভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। ভয়ংকর এ-যুদ্ধে পুলিশ এবং স্থানীয় বেশ কয়েকজন রাজাকারসহ ৮৫ জন নিহত হয়। থানা থেকে দুটি এলএমজি-সহ অন্যান্য অস্ত্র এবং প্রচুর গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।
এ-যুদ্ধে সরদার মহিউদ্দিন, আ. মান্নান সরদার এবং সামসুদ্দিন মাঝি এ ৩ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এছাড়া বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। এ-যুদ্ধে জয় লাভের পর ভেদরগঞ্জ থানা অঞ্চল সম্পূর্ণভাবে শত্রুমুক্ত হয়। [আবদুর রব শিকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড