You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে ভুরুঙ্গামারী উপজেলা (কুড়িগ্রাম)

ভুরুঙ্গামারী উপজেলা (কুড়িগ্রাম) বাংলাদেশের উত্তর- পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের সীমান্ত বেষ্টিত এ উপজেলা ভারত থেকে নেমে আসা বাঁশজানী, গদাধর, মোঘলকাটা, দুধকুমার, সংকোশ ও ফুলকুমার নদ-নদী বিধৌত। শিলখুড়ি, পাথরডুবি, তিলাই, চরভুরুঙ্গামারী, আন্ধারীরঝাঁড়, জয়মনিরহাট, বঙ্গসোনাহাট, বলদিয়া, পাইকেরছড়া ও ভুরুঙ্গামারী সদর ইউনিয়ন নিয়ে ভুরুঙ্গামারী থানা গঠিত।
৫২-র ভাষা-আন্দোলন, ৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২-র শিক্ষা অন্দোলন, ৬৬-র ৬ দফা আন্দোলন, ৬৮-র ১১ দফা আন্দোলন, ৭০-এর নির্বাচন এবং ৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন-এ ভুরুঙ্গামারীর মানুষ সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। এসব আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- কর্তৃক ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষিত হলে ভুরুঙ্গামারীর সর্বস্তরের মানুষ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভুরুঙ্গামারীতে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্বে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন- (মতিয়া ও মেনন) নিয়ে থানা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর), ন্যাপ (ভাসানী) ও অন্যান্য দল নিয়ে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি এবং সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও ছাত্র-যুবকদের সমন্বয়ে বেসরকারি কমান্ড গঠিত হয়। এ কমান্ডের নেতৃত্বে ২৩টি ইপিআর ক্যাম্পের অবাঙালিদের নিরস্ত্রীকরণ, বাঙালি ইপিআর, আনসারসহ অন্যদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন, খাদ্য ও অস্ত্র সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ দান এবং প্রতিরোধ যুদ্ধে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য ও ছাত্র-যুবকদের সম্পৃক্ত করা হয়।
ভুরুঙ্গামারী থানার সামরিক-বেসামরিক শক্তির মিলিত চেষ্টায় ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। সীমান্তবর্তী বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থান এবং শামসুল হক চৌধুরী এমপিএ, ক্যাপ্টেন নওয়াজিস উদ্দিন, আখতারুজ্জামান মণ্ডলসহ রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃবৃন্দের যোগ্য নির্দেশনা ও নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে ভুরুঙ্গামারীর জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। এক সময় সাহেগঞ্জ সাব- সেক্টরের সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ভুরুঙ্গামারী। শামসুল হক চৌধুরী এমপিএ-এর নেতৃত্বে ১লা মার্চের পর প্রায় প্রতিদিন ভুরুঙ্গামারীতে মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী ১০ই মার্চ কুড়িগ্রাম মহকুমা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মহকুমার সকল থানায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। ভুরুঙ্গামারীতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি হয়। শামসুল হক চৌধুরী এমপিএ-কে প্রধান করে অধ্যাপক হায়দার আলী মিয়া, ডাক্তার জোনাব আলী, ডাক্তার নিয়ামত আলী, পশির উদ্দিন আহমেদ, আব্দর রহমান মণ্ডল, নিজাম উদ্দিন মণ্ডল, কাজিম উদ্দিন মণ্ডল, নজরুল ইসলাম, আব্দুর জব্বার সরকার, মজিবর রহমান, মান্নান মিয়া, আব্দুল খালেক খলিফা, আব্দুল হাকিম মাস্টার ও ভাসানী ন্যাপের আনোয়ার হোসেন এবং ছাত্রলীগ নেতা আখতারুজ্জামান মণ্ডল, সোনাউল্ল্যা, এ টি এম শাজাহান মানিক, জয়নুল আবেদীন, হায়দার আলী, মহিউদ্দিন আহমেদ, গিয়াস উদ্দিন, জালাল উদ্দিন প্রমুখকে সদস্য করা হয়। ছাত্রনেতা আখতারুজ্জামান মণ্ডলের নেতৃত্বে থানা ও মহকুমায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে ছাত্ররা মুখ্য ভূমিকা
পালন করে।
ভুরুঙ্গামারীর সোনাহাট ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এখানে প্রশিক্ষক ছিলেন ইপিআর-এর হাবিলদার সোনাউল্ল্যা, হাবিলদার কলিমুদ্দিন, ল্যান্স নায়েক জালাল উদ্দিন মোল্লা, আব্দুল বাতেন, সুলতান হোসেন, হাশেম আলী, আব্দুল খালেক প্রমুখ। সোনাহাটের আব্দুর রহমান মণ্ডলের নেতৃত্বে ভারত থেকে ৪৭টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, ৩৬টি গ্রেনেড, ২ ইঞ্চি মর্টার ও গোলাবারুদ আনা হয় প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য। ভুরুঙ্গামারী কলেজেও একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। এখানে প্রশিক্ষক ছিলেন আমজাদ হেসেন, মকবুল হেসেন, উমর আলী, অসির উদ্দিন, আব্দুস সোবহান, বজলুর রহমান, মজিবর রহমান প্রমুখ আনসার সদস্য। ক্যাম্পগুলোর সার্বিক সামরিক নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন, সুবেদার আরব আলী ও সুবেদার বোরহান উদ্দিন। এছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নাজিরহাট যুবশিবির, বামনহাট যুবশিবির, ঝাউকুটি যুবশিবির, টাপুরহাট-আটিয়াবাড়ী যুবশিবির, দার্জিলিং মুজিব ক্যাম্প, কার্শিয়াং ভাসানী ক্যাম্প, শিলিগুড়ি, চাকুলিয়া প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকেও ভুরঙ্গামারীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
২৭শে মে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধরলা নদী অতিক্রম করে কুড়িগ্রামের পাটেশ্বরীতে প্রবেশ করলে মুক্তিবাহিনী তাদের প্রতিরোধ করার জন্য সোনাহাট রেলওয়ে ব্রিজের একটি স্প্যান বিস্ফোরক দিয়ে ভেঙ্গে ফেলে। এর ফলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে ভুরুঙ্গামারী ও নাগেশ্বরী থানার পূর্বাঞ্চলের প্রায় ১০টি ইউনিয়ন ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তাঞ্চাল ছিল। পাকিস্তান বাহিনী ব্যাপক শক্তি নিয়ে ধরলা নদী
অতিক্রম করে ২৭শে মে ভুরুঙ্গামারী দখল করে। ২৮শে মে মর্টার শেল চার্জ করে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে। ভুরুঙ্গামারী থানা, কলেজ ও সিও অফিসে তারা স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে।
শহীদ লে. আবু মঈন মোহাম্মদ আশফাকুশ সামাদ, লে. মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, লে. তাজ, সুবেদার মেজর আরব আলী, সুবেদার বোরহান উদ্দিন, সুবেদার মাজহারুল হক, সুবেদার আব্দুল ওহাব, বদরুজ্জামান মিয়া, মাহবুবার রহমান, রওশন উল বারী রঞ্জু, সিরাজুল ইসলাম, মো. আকরাম হোসেন, মো. আব্দুল হাই সরকার, মুহম্মদ শামসুল হক, আব্দুল কুদ্দুস নান্নু এঁরা সকলে কোনো-না-কোনো কোম্পানির কমান্ডিং-এর দায়িত্বে ছিলেন। এ থানায় অনেক প্লাটুন কমান্ডারও ছিলেন। যেমন হাবিলদার সোনাউল্ল্যা মিয়া, হাবিলদার সোনা মিয়া, হাবিলদার আনিস মোল্লা, নায়েক আব্দুল মজিদ, ক্যাপ্টেন আব্দুল আজিজ (মুজাহিদ বাহিনী), আব্দুল করিম ভেকু, (গণমুক্তিফৌজ), লুৎফর রহমান, আব্দুল গনি ফুড প্রমুখ। সমগ্র দেশ ১১টি সেক্টরে বিভক্ত হলে ৬ নম্বর সেক্টরের অধীনে ভুরুঙ্গামারী সাব-সেক্টর প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সাব-সেক্টরের হেডকোয়াটার্স ছিল সাহেবগঞ্জে। অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন নওয়াজিস উদ্দিন। এ এলাকার সিভিল প্রশাসনের দায়িত্ব পান আব্দুল হালিম (উপ আঞ্চলিক প্রশাসক, গীতালদহ-সাহেবগঞ্জ, ঝাউকুটি, ফুলবাড়ী), ডা. আব্দুল মজিদ (নাগেশ্বরী-ভুরুঙ্গামারী, উত্তর-পশ্চিম মুক্তাঞ্চল), হেলাল উদ্দিন (ম্যাজিস্ট্রেট, নাগেশ্বরী-ভুরুঙ্গামারীর পুর্বাঞ্চলীয় মুক্তাঞ্চল), আব্দুল লতিফ (ম্যাজিস্ট্রেট, রৌমারী-চিলমারী মুক্তাঞ্চল) প্রমুখ। এছাড়া ভুরুঙ্গামারীর রণাঙ্গনে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর অনেক সেনা কর্মকর্তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। এসব কর্মকর্তা হলেন- ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩৩ কোরের অধিনায়ক লে. জেনারেল থাপা, ৬ নম্বর সেক্টরের মিত্রবাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জোসি (৬ মাউন্টেন : ডিভিশন), বিএসএফ ৭৮ ব্যাটালিয়ন কমান্ডিং অফিসার কর্নেল আর দাস, মেজর সুকর্ণ, মেজর জেমস, মেজর গুরুদয়াল সিং, মেজর ছাতোয়াল সিং, মেজর সিনহা, বালা রেড্ডি, ক্যাপ্টেন শম্ভু, ক্যাপ্টেন মেহেদী, ক্যাপ্টেন যাদব, ক্যাপ্টেন মিত্র, ক্যাপ্টেন সিনহা, ক্যাপ্টেন ব্যানার্জ্জী, সুবেদার রবীন মেহেরা, হাবিলদার এল দত্ত প্রমুখ। এঁদের মধ্যে মেজর জেমস মাইন বিস্ফোরণে শহীদ হন। এ এলাকায় কোনো ব্যক্তির নামে মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ বাহিনী বা একক কোনো বাহিনী গড়ে ওঠেনি|
ভুরুঙ্গামারী উপজেলায় স্বাধীনতাবিরোধীদের মধ্যে মওলানা আব্দুল লতিফ, বশির উদ্দিন, মওলানা মোবারক আলী, মওলানা আব্দুল কাদের, কাজী আবেদ আলী, আশেক আলী, শাজাহান আলী, আব্দুল খালেক মন্ডল, ধীর মামুদ মন্ডল, কসিম উদ্দিন (মঙ্গা), গোলজার হোসেন, সাইফুর রহমান, শামসুল হক খন্দকার (জামায়াত নেতা), গিয়াস উদ্দিন মেম্বার, একাব্বর আলী, বেলাল উদ্দিন, আন্ধারীরঝাড়ের দুদু ও শহীদুল্লাহ, পাইকেরছড়ার খলিলুর রহমান, ভালুক দফাদার, জয়নাল আবেদীন (নাগেশ্বরী), মো. আব্দুল বারী ফাকু (পিতা বাবু বানিয়া, খলিলগঞ্জ, কুড়িগ্রাম সদর) প্রিন্সিপাল কমর উদ্দিন, আহাম্মদ হোসেন মার্চেন্ট, জালাল উদ্দিন, জয়েন উদ্দিন, সালেহ বাচ্চু, আব্দুল আজিজ, ইসমাইল হোসেন বাচ্চু, খোকা প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এদের কয়েকজনের বাড়ি ভুরুঙ্গামারীর বাইরে হলেও তারা এ থানায়ও স্বাধীনতাবিরোধী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। স্বাধীনতার পর তাদের অনেকে যেমন প্রিন্সিপাল কমর উদ্দিন, আহাম্মদ হোসেন মার্চেন্ট, জালাল উদ্দিন, জয়েন উদ্দিন, সালেহ বাচ্চু, মওলানা আব্দুল আজিজ, ইসমাইল হোসেন বাচ্চু ও খোকা দালাল আইনে আটক হয়।
পাকসেনা ও তাদের সহযোগী শান্তি কমিটির দালাল, রাজাকারআলবদরআলশামস এবং ইস্ট পাকিস্তান ক্যাভালরি আর্মড ফোর্স (ইপিক্যাফ) ভুরুঙ্গামারী- কুড়িগ্রাম সড়ক, ভুরুঙ্গামারী-সোনাহাট সড়ক ও ভুরুঙ্গামারী- বাঘভান্ডার সড়কের দুপাশের অসংখ্য বাড়ি, দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ করে। তারা আওয়ামী লীগ নেতা শামসুল হক চৌধুরী এমপিএ, কাজিম উদ্দিন চেয়ারম্যান ও তমেজ উদ্দিন মণ্ডল মেম্বারসহ কয়েকশ নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করে। তারা আওয়ামী লীগ অফিস, ভুরুঙ্গামারী বাজারের সাহাপট্টি ও দেবোত্তর মন্দির লুঠ করে। ভুরুঙ্গামারী কলেজের অংশবিশেষ ধ্বংস করে।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা ভুরুঙ্গামারীতে অনেক নারী নির্যাতিত হন। বীরাঙ্গনা সাজিরণ বেগম পাকসেনাদের অত্যাচারে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। অপর এক নারীকে পাকিস্তানি ক্যাম্পের মেজরসহ অন্য সৈন্যরা উপর্যপুরি নির্যাতন করে। পরে তিনিও মানসিক স্থিতি হারিয়ে ফেলেন। ১৪ই নভেম্বর ভুরুঙ্গামারী মুক্ত করার সময় সিও অফিসে পাকিস্তানিদের বিধ্বস্ত বাঙ্কারে পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন আতাউল্ল্যা খাঁনের লাশের পাশে নির্যাতিতা বাঙালি তরুণীদের লাশ পাওয়া যায়। মুক্তিযোদ্ধারা সিও-র বাসভবন থেকে ৪ জন নারীকে উদ্ধার করেন। অন্তরীণ থাকা অবস্থায় বন্দিশালার দেয়ালের গায়ে নিজের রক্ত দিয়ে একজন বীরাঙ্গনা লিখেছিলেন, ‘জ…বা’ (নিজের নাম জবা অথবা ‘জয় বাংলা’)। ঐদিন মুক্তিবাহিনী ভুরুঙ্গমারী হাইস্কুল ক্যাম্প থেকে ১৬ জন ও কলেজ থেকে ২০ জন বীরাঙ্গনাকে উদ্ধার করে।
দেওয়ানের খামারের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। তাঁকে চলন্ত জিপের পেছনে বেঁধে দৌড়ে যেতে বাধ্য করে। এক পর্যায়ে তিনি মাটিতে ছেঁচড়ে যান। শেষে পাকসেনারা তাঁর হাত ও পা টুকরো- টুকরো করে গরম পানিতে চুবিয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হককে পাকসেনারা জিপের পিছনে বেঁধে টেনে হেঁচড়ে কুড়িগ্রাম নিয়ে যায়। এরপর তাঁকে আর পাওয়া যায়নি। একজন ভারতীয় সৈনিককে আটক করে পাকবাহিনী তাঁর পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলে।
এখানকার ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষদের সকলে শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়নি। অনেকে নিজ বাড়ি পরিত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিল।
এ এলাকার নারীরা মুক্তিযোদ্ধা এবং আশ্রিত শরণার্থীদের খাওয়ানো, চিকিৎসা ও আবাসনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। তাদের একজন ছিলেন ছবি বেগম (পিতা আব্দুল আজিজ)। তিনি ও অন্য নারীরা ইয়ুথ ক্যাম্পে নার্সিং করাসহ নানাভাবে অবদান রাখেন।
ভুরুঙ্গামারীতে পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল সিও অফিস, থানা, ভুরুঙ্গামারী কলেজ, ভুরুঙ্গামারী হাইস্কুল ও জয়মনিরহাট ডাকবাংলা এবং তাদের কয়েকটি তাবু ক্যাম্প। এসব জায়গায় প্রধানত পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আতাউল্লা খানের নেতৃত্বে খোকা দালাল, কাদের মৌলভী, মোবারক আলী ও অন্য দালালরাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে ধরে এনে তথ্য আদায়ের জন্য প্রথমে . নির্যাতন এবং পরে হত্যা করত। মেয়েদের ওপর চলত পাশবিক অত্যাচার।
ভুরুঙ্গামারী থানায় অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়। নিহতদের অনেকের লাশ পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা বিভিন্ন জায়গায় গণকবর দেয়। গণকবরলো হলো— ভুরুঙ্গামারী সিও অফিস গণকবর, ভুরুঙ্গামারী কলেজ মোড় গণকবর, দেওয়ানের খামার গণকবর, ভুরুঙ্গামারী বাস স্ট্যান্ড গণকবর, ভুরুঙ্গামারী পাইলট স্কুল গণকবর ভুরুঙ্গামারী আফতাব মোল্লার বাড়ি গণকবর, ভুরুঙ্গামারী বিমল মেম্বারের বাড়ি গণকবর ও জয়মনিরহাট হাইস্কুল গণকবর।
ভুরুঙ্গামারী থানার বঙ্গসোনাহাটে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়, যা বঙ্গসোনাহাট যুদ্ধ নামে পরিচিত। সেসব যুদ্ধের একটিতে ৪০ জন পাকসেনা নিহত ও অনেকে আহত হয় এবং অপর একটি যুদ্ধে ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
বাঘভাণ্ডারে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কমপক্ষে ২৫টি ছোট-বড় যুদ্ধ হয়। ২৫শে মার্চের পর থেকে মধ্য- অক্টোবর পর্যন্ত এ যুদ্ধগুলো হয়। বাঘভাণ্ডার যুদ্ধএ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়।
জয়মনিরহাটে পাকবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। এ ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনাদের একাধিক যুদ্ধ হয়। সেসব যুদ্ধে অনেক পাকসেনা নিহত হয়। সর্বশেষ ১৪ই নভেম্বর জয়মনিরহাট যুদ্ধএ পাকবাহিনী পরাজিত হলে এখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধারা ১২ই জুলাই ফুলকুমার নদী পার হয়ে বাঘভান্ডারে পাকসেনাদের অক্রমণ করেন। এতে ৬ জন পাকসৈন্য নিহত হয়। দুজনকে আটক করে সাব-সেক্টর সাহেবগঞ্জে এনে ভারতীয়দের হাতে তুলে দেয়া হয়।
২৪শে জুলাই মুক্তিযোদ্ধাদের পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে ১১ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১৭ই নভেম্বর আন্ধারীরঝাড় এলাকায় মুক্তিবাহিনী ও পাকসেনাদের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়। এতে পাকবাহিনী পরাজিত হয় এবং আন্ধারীরঝাড় হানাদার মুক্ত হয়। আন্ধারীরঝাড় যুদ্ধ এ এলাকার মুক্তিযুদ্ধে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
৭ই আগস্ট বাউসমারী শিংঝাড়ের যুদ্ধে পাকসেনাদের এলএমজি-র গুলিতে অধ্যাপক আব্দুল ওহাব তালুকদার শহীদ হন। এ-যুদ্ধে ডা. মজিবর আহত হন। অধ্যাপক আব্দুল ওহাব তালুকদারের লাশ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে উদ্ধার করে ভারতের কালমাটিতে সমাধিস্থ করা হয়।
আব্দুল কুদ্দুস নান্নুর নেতৃত্বে ৮ই আগস্ট পাটেশ্বরী রেল স্টেশন যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে কুড়িগ্রাম কলেজের বিএসসি পরীক্ষার্থী রাজারহাটের মহসীন আলী, নাজিম খাঁ, উলিপুরের ছাত্র আব্দুল আজিজ ও মকবুল হোসেন শহীদ হন। প্রথম ৩ জনের লাশ সোনাহাট হাইস্কুলে সমাধিস্থ করা হয়। শহীদ মকবুল হোসেনের মৃতদেহ দুধকুমার নদীতে ভেসে গেলে হেলডাঙ্গা গ্রামের মানুষ উদ্ধার করে ঐ গ্রামেই কবর দেয়। অক্টোবর মাসে আক্তারুজ্জামান মণ্ডলের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধা দল ভুরুঙ্গামারী কলেজ আক্রমণ করে। এ আক্রমণে পাকবাহিনীর একজন মেজরসহ ২০ জন সৈন্য নিহত ও ১২ জন আহত হয়। বাকিরা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যায়। ভুরুঙ্গামারী কলেজ আক্রমণে পাকবাহিনীর প্রাণহানি ছাড়াও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং এ ঘটনা মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বহু গুণ বৃদ্ধি করে।
সেক্টর কমান্ডার মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার-এর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী ১২ই নভেম্বর ভুরুঙ্গামারীতে পাকিস্তানিদের ওপর বিমান আক্রমণ করে। এ আক্রমণের ফলে পাকবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা বুঝতে পারে যে, ভুরুঙ্গামারী থেকে পিছু না হটে তাদের আর কোনো উপায় নেই।
ভুরুঙ্গামারী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক যুদ্ধ হয়। যুদ্ধগুলো সেপ্টেম্বর থেকে মধ্যনভেম্বর পর্যন্ত সংঘটিত হয়। ভুরুঙ্গামারী যুদ্ধএ উভয় পক্ষে হতাহতের ঘাঁSaved
১৪ই নভেম্বর বিকেলে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল যখন জয়মনিরহাট যাচ্ছিল, তখন তাঁরা এক দল পাকিস্তানি সৈন্যের সম্মুখীন হন। মুক্তিযোদ্ধা হারুন অর রশীদ লালের হাতে একজন বেলুচ সৈন্য আটক হয়। তাকে এবং পূর্বে আটককৃত পাকসেনাদের সাহেবগঞ্জ হেডকোয়ার্টার্সে পাঠানো হয়। জয়মনিরহাট একদিনেই মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ যুদ্ধগুলোর একটি রায়গঞ্জ যুদ্ধ। লে. সামাদ ও লে. আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে আরব আলীর কোম্পানি এ-যুদ্ধে অংশ নেয়। মিত্রবাহিনী বিশেষভাবে সহযোগিতা করে। লে. সামাদ শত্রুর রেঞ্জে পড়লে তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করেও অন্য সহযোদ্ধাদের রক্ষায় আক্রমণ চালিয়ে যান। তিনি এ-যুদ্ধে শহীদ হন, তবে পাকিস্তানিদের পরাজয় নিশ্চিত করেন।
সামগ্রিকভাবে এ এলাকার যুদ্ধ পরিচালনায় ভারতীয় বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও অস্ত্র-গোলাবারুদ-আশ্রয়-খাদ্য সরবরাহ করেন। মিত্রবাহিনীর অনেকে যুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ ও আহত হন। এছাড়া ভারতের স্থানীয় রাজনীতিকদের অনেকে, যেমন ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা কমল গুহ, দীপক সেন গুপ্ত, আব্দুল জলিল, ত্রিগুণা সেন, আসামের নীলকান্ত সরকার, গোলকগঞ্জের প্রভাত দে, দিনহাটার রাজেন চ্যাটার্জী, কবীর রায়, সূর্য বাবু, বিমল বাবু, শান্তি বাবু, কুচবিহারের অরুণ বাবু, মাথাভাঙ্গার মানু বাবু, কলকাতার অশোক ঘোষ, অজয় মুখার্জী, অজিত পাঁজা, অনিতা গুহ, তুফানগঞ্জের জীবন দে, ধুবরীর মহকুমা প্রশাসক ও মহকুমা পুলিশ শাসক, কুচবিহার ও গোয়ালপাড়ার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার নানাভাবে সহযোগিতা করেন। সংবাদপত্র জগতের, বিশেষ করে গৌহাটির দৈনিক দঅহম, কলকাতার দৈনিক যুগান্তর ও দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা যুদ্ধের খবর, ছবি, নিবন্ধ ছেপে সহযোগিতা করে।
মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর ব্যাপক আক্রমণে নভেম্বর মাসে পাকবাহিনী ভুরুঙ্গামারী থেকে পিছু হটে নাগেশ্বরী থানার রায়গঞ্জে অবস্থান নেয়। ১৪ই নভেম্বর ভুরুঙ্গামারী থানা সম্পূর্ণভাবে পাকহানাদারমুক্ত হয়। এদিন সকাল ১১টায় ভুরুঙ্গামারীতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন মুজিব বাহিনীর অন্যতম নেতা আখতারুজ্জামান মণ্ডল।
ভুরুঙ্গামারীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যাঁদের নাম জানা যায়, তাঁরা হলেন— লে. আবু মঈন মোহাম্মদ আসফাকুস সামাদ (পিতা আজিজুস সামাদ, করিমগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ), নায়েব আলী প্রামাণিক (পিতা ছবি প্রামাণিক, দক্ষিণ গোপালপুর), জাফর আহমেদ (পিতা আবুল কাশেম, পাইকের ছড়া), ফরহাদ আলী (পিতা আলীমুদ্দিন, শিংঝাড়), আ. মান্নান (পিতা ছমির উদ্দিন, ভোটহাট), মোস্তাফিজুর রহমান (পিতা আব্দুল মজিদ সরকার, কামাতাঙ্গারিয়া), বছির উদ্দিন (পিতা রহিম বক্স), ঈশ্বর বড়ুয়া, আকবর আলী (পিতা আয়েজ উদ্দিন, পাথরডুবি), আব্দুল আজিজ (পিতা সৈয়দ আলী, শিংঝাড়), জয়নাল আবেদীন (পিতা আলিমুদ্দিন, ভোটহাট), আজিজার রহমান (পিতা মসির উদ্দিন, গণহিরকুটি, সোনাহাট), হায়দার আলী (পিতা হোসেন আলী, শিংঝাড়), আব্দুল খালেক (পিতা আদির ফকির, পরশুরামের কুঠি, বলদিয়া), হাবিবুর রহমান, ফজলুল হক, আবুল কালাম আজাদ, আবু বক্কর, সরবেশ আলী, তমছের আলী ও মকবুল হোসেন।
ভুরুঙ্গামারীতে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বেশকিছু স্মৃতিফলক নির্মাণ এবং অনেক রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। যেমন, ভুরুঙ্গামারী বাসস্ট্যান্ড মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ, মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিফলক (দেওয়ানের খামার), শহীদ আজিজার রহমান সড়ক (দেওয়ানের খামার), শহীদ মোস্তাফিজার রহমান সড়ক (গৌড় ডাক্তারের মোড় থেকে মতি কমান্ডারের বাসার মোড় পর্যন্ত), সামাদ নগর স্মৃতিফলক (জয়মনিরহাট), লে. সামাদ, বীর উত্তম উচ্চ বিদ্যালয় (জয়মনিরহাট), লে. সামাদ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও লে. সামাদ কারিগরি মহাবিদ্যালয় (সামাদ নগর, জয়মনিরহাট), শহীদ মহসিন বাজার (বানুরকুটি), শহীদ আকবর সড়ক (কামাতাঙ্গারিয়া থেকে গৌড় ডাক্তারের মোড় পর্যন্ত), শহীদ মান্নান সড়ক (জামতলা মোড় থেকে ইউপি অফিস পর্যন্ত), শহীদ আলী সড়ক (কাজী নিজামের বাড়ি থেকে লাকী সিনেমা হল পর্যন্ত), শহীদ আ. খালেক সড়ক (জামতলা থেকে বাসটার্মিনাল পর্যন্ত), শহীদ প্রফেসর ওহাব তালুকদার সড়ক (বাসস্ট্যান্ড থেকে জয়মনিরহাট পর্যন্ত), শহীদ আবুল কালাম সড়ক (জলিল প্রিন্সিপালের বাড়ি থেকে কেজি স্কুল পর্যন্ত), শহীদ আ. আজিজ সড়ক (পোস্ট অফিস থেকে সিনিয়র মাদ্রাসা পর্যন্ত), শহীদ জয়নাল আবেদীন সড়ক (হাবিবুরের বাড়ি থেকে কুদ্দুসের বাড়ি পর্যন্ত), শহীদ জব্বার সড়ক (ইসলামুলের চাতাল থেকে ফকিরের হাট পর্যন্ত), শহীদ তমেজ কমান্ডার সড়ক (গৌড় ডাক্তারের মোড় থেকে সাহা পাড়া পর্যন্ত), শহীদ হাতেম আলী সড়ক (গৌড় ডাক্তারের মোড় থেকে চিত্ত মাস্টারের বাড়ি পর্যন্ত), শহীদ জাফর আলী সড়ক (হাবিবুরের বাড়ি থেকে লাকী সিনোমা হল পর্যন্ত), শহীদ বছির উদ্দিন সড়ক (বাসস্ট্যান্ড থেকে কেজি স্কুল পর্যন্ত), শহীদ ইদ্রিস আলী সড়ক (সাহা পাড়া থেকে কামতি মাদ্রাসা পর্যন্ত), শহীদ মহসিন সড়ক (বাসস্ট্যান্ড থেকে সোনাহাট ব্রিজ পর্যন্ত), শহীদ স্মৃতি নামফলক (বজলার রহমান মোল্লার দোকানের সামনে পাকা রাস্তার তেমাথায়) এবং বঙ্গবন্ধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। [এস এম হারুন অর রশীদ লাল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!