You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভাষা-আন্দোলন

ভাষা-আন্দোলন পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে গড়ে ওঠা বাঙালিদের আন্দোলন। এর ছিল দুটি পর্যায় বা পর্ব। প্রথম পর্ব ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। এ পর্বে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি কেবল বিতর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের রূপ নেয়। জিন্নাহর ঢাকা ঘোষণা ও এর বিরুদ্ধে ছাত্রদের প্রতিবাদ ছিল এ পর্বের মুখ্য ঘটনা। দ্বিতীয় বা চূড়ান্ত পর্যায় ১৯৫২ সাল। এ সময়ে সংঘটিত হয় রক্তাক্ত একুশের ঘটনা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের উদ্যোগ নেয়। বাঙালিদের দাবি ছিল উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হোক। পাকিস্তান রাষ্ট্রে জনসংখ্যায় বাঙালিরা ছিল শতকরা ৫৬ ভাগ, অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ। তবে তারা তাদের ভাষা বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেনি। অতএব বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার তাদের দাবি ছিল খুবই ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর মনোভাব ছিল অনমনীয়। তাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ভাষার প্রশ্ন আন্দোলনের রূপ নেয়। উর্দু বনাম বাংলা বিতর্ক, অন্য কথায়, উর্দুর পক্ষে অবাঙালি মুসলিম নেতৃত্বের অবস্থান নতুন কোনো ঘটনা ছিল না। পাকিস্তান সৃষ্টির বহু পূর্ব থেকেই বাঙালি-অবাঙালি মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যে এ বিষয়ে বিতর্ক দেখা দেয়।
১৯০৬ সালে ঢাকায় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে সেখানে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনেও এ ধরনের বিতর্ক ওঠে। ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে দলের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে গ্রহণের উদ্যোগ নেন। কিন্তু শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে বাঙালি প্রতিনিধিবর্গের বিরোধিতার কারণে সেদিনের উদ্যোগ সফল হয়নি। বিশ শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশক জুড়ে কলকাতার উর্দুভাষী অবাঙালি মুসলিম ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষাভাষী কারো চাকরি পাওয়া-না-পাওয়ার প্রশ্নে ভাষা- প্রসঙ্গ বারবার আলোচনায় আসে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে তা আরও স্পষ্ট রূপ নেয়। ১৯৪৭ সালের মে মাসে হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠিত উর্দু সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের নেতা চৌধুরী খলিকুজ্জামান ঘোষণা করেন, “উর্দু হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা’। জুলাই মাসে (১৯৪৭) আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুর পক্ষে অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেন। একই সময় বিশিষ্ট বাঙালি ভাষাতাত্ত্বিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘আমাদের ভাষা সমস্যা’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে ড. জিয়াউদ্দিনের বক্তব্য খণ্ডন করে বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করেন। মুসলিম লীগ-এর অবাঙালি নেতৃবৃন্দ ও উর্দুভাষী বুদ্ধিজীবিগণ যে উর্দুকে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের পক্ষে থাকবেন, তা পূর্বেই স্পষ্টত ধারণা করা যাচ্ছিল। তাই ভারত বিভক্তি ও পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সেক্রেটারি জেনারেল আবুল হাশিম ও তাঁর অনুসারীরা এ ব্যাপারে বাঙালিদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন।
আন্দোলনের প্রথম পর্ব বস্তুত ভাষা-বিতর্ক নিয়েই পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। তারই ধারাবাহিকতায় নতুন রাষ্ট্রের রাজধানী করাচিতে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হয়। এমতাবস্থায় ১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে পূর্ববাংলার অন্যতম সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকেও পরিষদের ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে গ্রহণের প্রথম আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু তাঁর সে দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়। এর বিরুদ্ধে পূর্ব ছাত্র-ধর্মঘট, বাংলায় বিক্ষোভ-সমাবেশ, আইন পরিষদ ঘেরাও ইত্যাদি কর্মসূচি পালিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে এসব আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র।
ভাষা-আন্দোলনের প্রাথমিক পর্বে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বাঙালি-বিদ্বেষ, উর্দুর প্রতি পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ভাষানীতি ও রাজনৈতিক আচরণের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই পূর্ববাংলার ছাত্র, যুবক, রাজনৈতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। দ্রুত প্রতিষ্ঠা লাভ করে বিভিন্ন সংগঠন। এর মধ্যে কামরুদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক করে গঠিত গণ-আজাদী লীগ (জুলাই ১৯৪৭), তসাদ্দক আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক যুবলীগ (সেপ্টেম্বর ১৯৪৭), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে গঠিত তমদ্দুন মজলিস (সেপ্টেম্বর ১৯৪৭), একই বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়াকে (পরবর্তীকালে শামসুল আলম) আহ্বায়ক করে গঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ (অক্টোবর ১৯৪৭) এবং নঈমউদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক করে তখনকার প্রতিশ্রুতিশীল যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (৪ঠা জানুয়ারি ১৯৪৮) বিশেষভাবে উল্লেখ্য। ভাষা-আন্দোলনের এ পর্যায়ে এসব সংগঠন বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে।
এদিকে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা সফর উপলক্ষে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের দাবিতে গড়ে ওঠা বাঙালিদের আন্দোলন- বিক্ষোভ আরো জোরদার হতে থাকে। ২৬শে ফেব্রুয়ারি (১৯৪৮) সাধারণ ছাত্র ধর্মঘট, ১১ই মার্চ বিক্ষোভ ও সাধারণ ধর্মঘটের মাধ্যমে ‘বাংলাভাষা দাবি দিবস’ এবং ১৩ই মার্চ ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ১১ই মার্চের ধর্মঘট পালনকালে ঢাকার রাজপথে পিকেটিংরত অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদসহ অনেকে গ্রেপ্তার হন। জিন্নাহর সফরের প্রাক্কালে এরূপ আন্দোলন-বিক্ষোভে উদ্বিগ্ন পূর্ববাংলার নাজিমুদ্দীন সরকার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ১৫ই মার্চ একটি চুক্তিতে উপনীত হয়। উদ্দেশ্য, উত্তপ্ত পরিস্থিতি সামাল দিয়ে জিন্নাহর সফরকে নির্বিঘ্ন করা। মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে স্বাক্ষরিত ৮-দফা চুক্তির প্রধান দিকগুলো ছিল: গ্রেপ্তারকৃতদের অবিলম্বে মুক্তিদান, এপ্রিলের (১৯৪৮) প্রথম সপ্তাহের মধ্যে পূর্ববাংলা সরকার কর্তৃক প্রাদেশিক পরিষদে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দান ও পাকিস্তান গণপরিষদের ব্যাবহারিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ, কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষাদিতে বাংলাকে উর্দুর সমমর্যাদা দান ও পূর্ববাংলায় শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা এ মর্মে প্রস্তাব গ্রহণ, সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ইত্যাদি
১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক জনসভায় ভাষণ দানকালে জিন্নাহ ঘোষণা করেন, ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে জিন্নাহর এ ঘোষণা বাঙালিদের হতাশ করে। তাই তাঁর এ ঘোষণার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ ওঠে। এরপর ২৪শে মার্চ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত তাঁর পূর্ব ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করলে সেখানেও প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়।
আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব জিন্নাহর ঢাকা সফরকালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সম্বন্ধে উর্দুর পক্ষে তাঁর ঘোষণা এবং এর তাৎক্ষণিক প্রতিবাদের পর ধারণা করা হচ্ছিল যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এ ব্যাপারে আরো সতর্ক ও বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৫১ সালে আততায়ীর গুলিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান নিহত হলে খাজা নাজিমুদ্দীন তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। পূর্ববাংলার ভাষা-আন্দোলনকারীদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত (১৫ই মার্চ ১৯৪৮) চুক্তি ভঙ্গ করে ১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকার পল্টন ময়দানের এক জনসভায় উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার নতুন ঘোষণা দেন। তাঁর এ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় আন্দোলনের দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত পর্ব|
৩১শে জানুয়ারি (১৯৫২) ঢাকা বার লাইব্রেরিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী-র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিদের এক সভায় কাজী গোলাম মাহবুবকে (তখন তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সহ- সভাপতি) আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ (কর্ম পরিষদ নামেও পরিচিত) গঠিত হয়। এরও পূর্বে ১৯৫০ সালের ১১ই মার্চ আবদুল মতিনকে (‘ভাষা মতিন নামে খ্যাত) আহ্বায়ক করে গঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) ঢাকায় সাধারণ ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘট চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সম্মুখস্থ স্থান) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত ছাত্র সমাবেশ থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতির দাবিতে সমগ্র পূর্ববাংলায় সাধারণ ধর্মঘট ও সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠানের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদও এ কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। কিন্তু ঐ দিনের সভা-সমাবেশের ওপর সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা নিয়ে প্রবীণ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ছাত্র-তরুণদের মতপার্থক্য দেখা দেয়। ছাত্র ও তরুণ সমাজের অধিকাংশ ছিল নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের পক্ষে। একই সময় পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে ১৯৪৯ সাল থেকে দীর্ঘ ২ বছর ৩ মাস একটানা কারাবন্দি তরুণ জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সহ-রাজবন্দি মহিউদ্দিন আহমেদ ফরিদপুর কারাগারে আমরণ অনশন শুরু করেন, যা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। উল্লেখ্য, বন্দি অবস্থায় চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হলে সেখানে সাক্ষাৎ করতে আসা ছাত্রলীগ ও যুব নেতৃবৃন্দকে ২১শে ফেব্রুয়ারি যে-কোনো মূল্যে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের জন্য বঙ্গবন্ধু তাদের নির্দেশ দেন। একই সময় তাঁর নিজের আমরণ অনশন শুরু করার সিদ্ধান্ত তাদের অবহিত করেন। এরপর তাঁকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়।
২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজস্থ তৎকালীন ক্যাম্পাস) বিভিন্ন স্থান থেকে ছাত্ররা এসে সমবেত হতে থাকে। বেলা ১১টায় শুরু হয় সভা। সে-সভা থেকে ছোট- ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ছাত্ররা মিছিল আকারে রাস্তায় বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। পুলিশের বাধা, কাঁদানে গ্যাস ও লাঠিচার্জ উপেক্ষা করে ছাত্রদের একটি মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান জগন্নাথ হলের সম্মুখস্থ গেইট সংলগ্ন পূর্ববাংলার প্রাদেশিক পরিষদ ভবনের (বর্তমানে যেখানে ‘অক্টোবর স্মৃতিভবন’ নির্মিত হয়েছে) দিকে অগ্রসর হতে থাকলে পুলিশ ও সরকারের অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাদের ওপর গুলি চালায়। শহীদ হন বরকত, জব্বার, রফিক ও সালাম। আরো অনেকে আহত হন। বাঙালির জাতীয় ইতিহাসে রচিত হয় এক রক্তাক্ত অধ্যায়। পরের দিন ২২শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় নিহতদের গায়েবানা জানাযা শেষে বিশাল শোকর্যালি বের হয়। সেদিনও লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। শফিউর রহমান নামে একজন শহীদ হন এবং অনেকে আহত ও গ্রেপ্তার হন। অতঃপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৬ সালের সংবিধানে তা স্বীকৃত হয়।
ভাষা-আন্দোলন ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিদের প্রথম বিদ্রোহ। বাঙালির জাতীয় ইতিহাসে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। ভাষা-আন্দোলন বাঙালির চেতনামূলে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয়। তখন থেকে প্রতিবছর সর্বস্তরের বাঙালিরা যথাযোগ্য মর্যাদায় ২১শে ফেব্রুয়ারি পালন করে আসছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ সংলগ্ন যে-স্থানে পুলিশের গুলিতে ঐদিন ছাত্র ও অন্যরা শহীদ হয়েছিলেন, সেখানে নির্মিত হয় স্মৃতিস্তম্ভ তথা বাঙালির জাতীয় জাগরণের প্রতীক শহীদ মিনার। দেশের সর্বত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে নির্মিত হয় অনুরূপ স্মৃতিস্তম্ভ। কবি, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি-কর্মীদের চিত্তে সৃষ্টি হয় গভীর আলোড়ন। আবদুল গাফফার চৌধুরীর কথায় ও আলতাফ মাহমুদের সুরে রচিত হয় বাঙালির মর্মস্পর্শী ও কালজয়ী ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো… ‘ একুশের গান।
ভাষা-আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গ যুক্তফ্রন্ট হয়ে ‘৫৪-র নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটায়। ভাষা- আন্দোলন জিন্নাহর ধর্মভিত্তিক তথাকথিত দ্বিজাতিতত্ত্বের স্থলে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনা বা স্বতন্ত্র জাতিসত্তা বিকাশের ভিত্তিভূমি রচনা করে, যা দিনে-দিনে প্রবল হয়ে ‘৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশে রূপ নেয়।
ভাষা-আন্দোলনের তাৎপর্য শুধু বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তা আজ বিশ্বজুড়ে পরিব্যাপ্ত। ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেসকো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে ২১শে ফেব্রুয়ারি আজ বিশ্বের সকল ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অধিকার সংরক্ষণের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত। [হারুন-অর-রশিদ]
সহায়ক গ্রন্থ: শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ঢাকা, ইউপিএল ২০১৩; অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-১৯৭৫, ঢাকা ২০০৪; Harun-or-Rashid, The Foreshadowing of Bangladesh : Bengal Muslim League and Muslim Politics, 1906-1947, Dhaka,
UPL ২০১৩; হারুন-অর-রশিদ, বঙ্গীয় মুসলিম লীগ : পাকিস্তান আন্দোলন, বাঙালির রাষ্ট্রভাবনা ও বঙ্গবন্ধু, ঢাকা, অন্যপ্রকাশ ২০১৮; হারুন-অর-রশিদ, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পুনর্পাঠ, ঢাকা, ইউপিএল ২০১৩; বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা-আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, ১ম খণ্ড, ঢাকা ১৯৭০

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!