You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে ভাণ্ডারিয়া উপজেলা (পিরোজপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

ভাণ্ডারিয়া উপজেলা (পিরোজপুর)

ভাণ্ডারিয়া উপজেলা (পিরোজপুর) ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর অভূতপূর্ব বিজয় অর্জন বাঙালিদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণের সুযোগ এনে দেয়। কিন্তু অচিরেই পাকিস্তানি শাসক চক্রের চক্রান্তে সে স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হতে শুরু করে। তারা বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে। ৭১-এর ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মাধ্যমে সমগ্র বাঙালি জাতি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশনা পায়। পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়া উপজেলার মানুষের কাছেও তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তারা বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলন সহ সকল কর্মসূচিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে এবং আসন্ন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে।
২৫শে মার্চ রাতে ভাণ্ডারিয়ার নেতৃবৃন্দের নিকট বরিশাল থেকে নূরুল ইসলাম মঞ্জুর এমএনএ টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ দেন। এ সংবাদ পেয়ে ২৬শে মার্চ ভাণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খান এনায়েত করিমের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সংগ্রাম কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- কাঞ্চন আলী জমাদ্দার, সার্জেন্ট (হাবিলদার) আব্দুল আজিজ সিকদার, এডভোকেট আব্দুল হাকিম হাওলাদার, নুরুজ্জামান কাজী, মোফাজ্জল হোসেন চান মিয়া, মাহতাব উদ্দিন খান টুলু, আব্দুল লতিফ সিকদার, ফারুক হাওলাদার, পনু তালুকদার, এম ফরিদ উদ্দিন মনজু, ইয়াছিন উদ্দিন মোল্লা, নেজামুল হক নান্না, গোলাম মোস্তাফা বাচ্চু, ফারুক হাওলাদার, আলমগীর হোসেন সিকদার প্রমুখ। এ-সময় গোলাম রহমান বাচ্চু, ফারুক হাওলাদার প্রমুখকে নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
খান এনায়েত করিমকে মুক্তিযুদ্ধকালে ভাণ্ডারিয়া উপজেলার বেসামরিক প্রধান নিযুক্ত করা হয়। তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সৈনিক সার্জেন্ট আব্দুল আজিজ সিকদারকে একটি সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী গড়ার নির্দেশ দেন। ১০ই এপ্রিল আজিজ সিকদার ভাণ্ডারিয়া স্কুল মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করেন। তিনি সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ দেন। প্রশিক্ষণের জন্য তিনি ভাণ্ডারিয় থানা থেকে চারটি রাইফেল সংগ্রহ করেন। তাঁর সঙ্গে প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মাহবুবুল খন্দকার, মকবুল আলী, মান্নান সিকদার, আ. বারেক সিকদার, আ. হাসেম, আ. ছত্তার খলিফা, আজহার আলী বিশ্বাস প্রমুখ। এখানে ১০ দিন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলে। শান্তি কমিটির অত্যাচারে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা আজিজ সিকদারের নেতৃত্বে ৯নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার লে. জিয়াউদ্দিন আহমদের সঙ্গে দেখা করার জন্য সুন্দরবন চলে যান। লে. জিয়াউদ্দিন সুবেদার আব্দুল আজিজ সিকদারকে জোন কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দান করেন এবং সহযোদ্ধা হিসেবে ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা, ১৫টি রাইফেল ও ২০টি করে গুলি দিয়ে এ গ্রুপটিকে ভাণ্ডারিয়ায় প্রেরণ করেন।
১৩ই আগস্ট কমান্ডার আব্দুল আজিজ সিকদারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের এ দলটি ভাণ্ডারিয়া থানা আক্রমণ করে। এ আক্রমণের ফলে বেশ কয়েকজন পুলিশ ও আনসার সদস্য নিহত এবং অনেকে আহত হয়। এ-সময় মুক্তিযোদ্ধারা থানা থেকে বেশ কয়েকটি রাইফেল সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। থানা আক্রমণে আজিজ সিকদারের সঙ্গে অংশ নেন খান এনায়েত করিম, আব্দুল জলিল আকন, মকবুল আলী, আবুল কাসেম, আলতাফ মুন্সী, আব্দুল মান্নান বিশ্বাস, সোহরাব সিকদার, বারেক সিকদার, আজহার আলী বিশ্বাস, সাত্তার খলিফা প্রমুখ।
ভাণ্ডারিয়া উপজেলায় কয়েকজন নারী মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের মধ্যে আনোয়ারা বেগম (স্বামী আ. রশিদ খান, ভিটাবাড়িয়া), বিলকিস বেগম (স্বামী আ. কাদের হাওলাদার, সেনেরহাট), দেলওয়ারা বেগম (স্বামী মহসীন নকীব, আওরাবুনিয়া), রেনুকা চক্রবর্তী (স্বামী আশুতোষ চক্রবর্তী) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ভাণ্ডারিয়া অঞ্চলের কমান্ডার ছিলেন- হাবিলদার আব্দুল আজিজ সিকদার (মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ওয়ারেন্ট অফিসার পদে উন্নীত), হাবিলদার মকবুল হোসেন, আব্দুল জলিল আকন, আজহার আলী বিশ্বাস, আব্দুস সাত্তার খলিফা, নুরুজ্জামান মল্লিক ও আ. লতিফ মুন্সী।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পিরোজপুরে অনুপ্রবেশের পূর্বেই মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেন। পিরোজপুর থেকে হুলারহাট নদী বন্দর দিয়ে ১৪ই আগস্ট পাকবাহিনীর সদস্যরা একটি লঞ্চ নিয়ে ভাণ্ডারিয়ার দিকে রওনা দেয়। কিন্তু ভিটাবাড়িয়ায় নদীর দুই তীর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলিবর্ষণ শুরু করলে হানাদার বাহিনী পিরোজপুর ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
১৪ই আগস্ট পাকবাহিনী বাধাপ্রাপ্ত হলেও অচিরেই তারা আরো সৈন্য ও গোলাবারুদ নিয়ে ভাণ্ডারিয়ায় অনুপ্রবেশ করে। তারা ভাণ্ডারিয়া ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন মডেল স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে। এখান থেকে তারা আশপাশের এলাকায় অভিযান চালাত এবং মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন ধরে এনে এখানে নির্যাতন করত।
পাকিস্তানি বাহিনী ভাণ্ডারিয়ায় অনুপ্রবেশের পূর্বেই এখানে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান খান সাহেব আব্দুল মজিদ জমাদ্দার। তবে শান্তি কমিটি ও এর কর্মকাণ্ড দেখাশোনা করত তার ছেলে নুরুল হক জমাদ্দার। শান্তি কমিটির অন্য সদস্যরা হলো- আ. মজিদ (পিতা রাজা আলী, ভাণ্ডারিয়া; মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ১৯৭২ সালের ২৫শে জানুয়ারি আটক), মৌলভী ওবায়দুল হক (পিতা আফেল উদ্দিন মুন্সী, ভাণ্ডারিয়া; মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ১৯৭২ সালের ২৫শে জানুয়ারি আটক), গোলাম আলী ফিরোজী, মো. ইউনুস মাওলানা (পিতা হাজী ঈমান উদ্দিন, তেলিখালি; মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ১৯৭২ সালের ১৪ই জানুয়ারি আটক), হারুন খান, আমীর হোসেন, গণেশচন্দ্র রায় (পিতা সন্তুষ্টি রায়, ভিটাবাড়িয়া; মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ১৯৭২ সালের ১৫ই জানুয়ারি আটক) প্রমুখ। এদের সহায়তায় জামায়াতে ইসলামী নেজামে ইসলামী মুসলিম লীগ, ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর সদস্যরা ও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। উপজেলা সদর থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত শান্তি কমিটি বিস্তৃত ছিল। শান্তি কমিটি এবং রাজাকার বাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারীনির্যাতন চালায়। ভাণ্ডারিয়া থানাকে তারা ক্যাম্প এবং টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করত। উপজেলায় পাকবাহিনীর অন্য সহযোগীরা হলো- এ সালাম (মেদিরাবাদ), খয়রুদ্দিন (ভাণ্ডারিয়া), মীর আব্দুল কাদের (পশারিবুনিয়া), খন্দকার মোয়াজ্জেম হোসেন (হেতালিয়া), ফজলুল হক হাওলাদার (হেতালিয়া), মফিজউদ্দিন (ধাওয়া), সিদ্দিকুর রহমান হাওলাদার (বোথলা), আ. বারিক হাওলাদার (ধাওয়া), সাত্তার চৌকিদার (বোথলা), মোজাম্মেল হক ফরাজী (হরিপাগলা), আবদুস সাত্তার মল্লিক (লক্ষ্মীপুরা), মোতাহার উদ্দিন তালুকদার (ভিটাবাড়িয়া), হামেজউদ্দিন মোল্লা (ভিটাবাড়িয়া), মোখলেস উদ্দিন (জামিরতলা), হাজী আনসার উদ্দিন (ভাণ্ডারিয়া), চাঁদ মিয়া (শিয়ালকাঠী), নূর মোহাম্মদ হাওলাদার (শিয়ালকাঠী), আফজাল হোসেন (শিয়ালকাঠী), আ. হাকিম (ভিটাবাড়িয়া), আ. রহমান হাওলাদার (মাটিভাঙ্গা), মো. এনায়েত হোসেন ফরাজী (পশ্চিম পশারিবুনিয়া), আ. বারেক তালুকদার (গোলবুনিয়া), মো. সুলতান (ভিটাবাড়িয়া), আমির হোসেন (ভিটাবাড়িয়া), রহম আলী হাওলাদার (ভিটাবাড়িয়া), হাশেম মণ্ডল (রাজপাশা), আইয়ুব আলী (ভাণ্ডারিয়া), আব্দুল কাদের (হেতালিয়া), ফজলুল হক কাজী (হেতালিয়া), শাহাদাৎ হোসেন (হেতালিয়া), ইসহাক ফরাজী (নদমূলা), আ. মান্নান হাওলাদার (হেতালিয়া), আ. কাদের (পশারিবুনিয়া), নুরুল হক (পশারিবুনিয়া), আ. রশিদ তালুকদার (চৌয়ারিয়া), আবুল হাশেম (পশারিবুনিয়া), এ মজিদ হাওলাদার (ভিটাবাড়িয়া), আব্দুল হাশেম (পশারিবুনিয়া), মুশফিকুর রহমান (শিয়ালকাঠী), সোহরাব হোসেন (তেলিখালি), মো. ইসহাক (তেলিখালি), জাহাঙ্গীর হোসেন (ভিটাবাড়িয়া), আ. হাকিম (ভিটাবাড়িয়া), আ. বারিক (গোলবুনিয়া), রতন আলী হাওলাদার (ভিটাবাড়িয়া), মো. ইউসুফ মাতুব্বর (জুনিয়া), হাশেম মৃধা (রাজপাশা), আইয়ুব আলী (ভাণ্ডারিয়া), আলতাফ হোসেন (শ্রীপুর), আজাহার আলী (হেতালিয়া), আশরাফ আলি হাওলাদার (হেতালিয়া), মহিবুল্লাহ (চৌয়ারিয়া), মো. সিদ্দিকুর রহমান (হেতালিয়া), আব্দুস সোবহান হাওলাদার (ভিটাবাড়িয়া), আ. সাত্তার মিয়া (জামিরতলা), মকবুল হোসেন হাওলাদার (ভাণ্ডারিয়া), হাজী মুন্সীউদ্দিন আহমেদ (ভাণ্ডারিয়া), আবু তাহের (কুড়ালমারা), সুলতান মোহাম্মদ (গোলবুনিয়া), আ. বারী (হরিণপালা), আজাহার আলী (হেতালিয়া), আ. সাত্তার মিয়া (জামিরতলা), হাজী আনসার উদ্দিন (ভাণ্ডারিয়া), জাহাঙ্গীর হোসেন (ভিটাবাড়িয়া), আ. রহমান হাওলাদার (মাটিভাঙ্গা), মো. হোসেন আলী খান (ধাওয়া), রহমান আলী হাওলাদার। (ভিটাবাড়িয়া), আব্দুল কাদের (হেতালিয়া), আব্দুল হান্নান (হেতালিয়া), চাঁদখান (বোথলা), মো. সেলিম খান (উত্তর শিয়ালকাঠী), আলতাফ হোসেন (পূর্ব ভাণ্ডারিয়া), মো. মতিয়ার রহমান (শিয়ালকাঠী), এ হামিদ আজাদী (রাজপাশা), এ কে এম হারুনুর রশীদ (ভাণ্ডারিয়া), মোস্তাফিজুর রহমান (শিয়ালকাঠী), ফজলুল হক গাজী (হেতালিয়া) ও সামসুল হক (পশারিবুনিয়া)। ৭১-এর ডিসেম্বর থেকে ৭২-এর জানুয়ারি এ সময়ের মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এরা সকলে আটক হয়। একই অভিযোগে অন্য যেসব পাকিস্তানি সহযোগী গ্রেপ্তার হয়, তারা হলো- আনসার আলী মোল্লা এম এল (পিতা ওয়াজেদ আলী মোল্লা, চড়াইল; মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ১৯৭২ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি আটক), মো. আ. খালেক (পিতা সাহাজউদ্দিন, নদমুলা; মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ১৯৭২ সালের ৫ই মার্চ আটক), শামসুল হক (পিতা করিম উদ্দিন, গাজীপুর; মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ১৯৭২ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি আটক), আ. রব (পিতা আরফান উদ্দিন, গাজীপুর; মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ১৯৭২ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি আটক)।
উপজেলায় পাকিস্তানি বাহিনীকে বিভিন্নভাবে আরো যারা সহযোগিতা করে, তাদের মধ্যে- বাবুল তালুকদার (দক্ষিণ শিয়ালকাঠী), খান সাহেব আবদুল মজিদ জমাদ্দার (চেয়ারম্যান, ভাণ্ডারিয়া), হাচেন খাঁ (পশারিবুনিয়া), হাফেজ আমির হোসেন (দারুল হুদা), বাদশা মৃধা (পশ্চিম পশারিবুনিয়া), আসমত আলী সেপাই (পশ্চিম পশারিবুনিয়া), আজাহার আলি সেপাই (পশ্চিম পশারিবুনিয়া), আ. হক মাওলানা (সিংখালী), আশরাফ মাতুব্বর পশ্চিম পশারিবুনিয়া), ফরমান গাজী (সিংখালী), ছালাম সিকদার (পশ্চিম পশারিবুনিয়া), মন্নাফ (হেতালিয়া), মোসলেম মাস্টার (দারুল হুদা), গহর ফরাজী (ভাণ্ডারিয়া সদর), মোজাম্মেল হক জমাদ্দার (ভাণ্ডারিয়া সদর), তোতা তালুকদার (পৈকখালী), হারুন খান (শিয়ালকাঠী), আশরাফ তালুকদার (শিয়ালকাঠী), হাসিবউদ্দীন পেশকার (ভাণ্ডারিয়া সদর), ফরমান আলী মীর (ভাণ্ডারিয়া সদর), হুকুম আলী ডাক্তার (ভাণ্ডারিয়া সদর), ফজলু সিকদার (রাজপাশা), এসহাক আলি খলিফা (ইকরি), মুজিবর খাঁ (বাড়ৈখালি), হালিম শেখ (বাড়ৈখালি), রতন (বাড়ৈখালি), মকবুল খাঁ (বাড়ৈখালি), রহিম খাঁ (বাড়ৈখালি), মহারাজ সিকদার (পশ্চিম পশারিবুনিয়া), শহীদ বেপারী (পশারিবুনিয়া), আ. মান্নান (পশারিবুনিয়া) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য|
স্থানীয় রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীদের সহায়তায় পাকবাহিনী ভাণ্ডারিয়া উপজেলা ও এর আশেপাশে হত্যা, নির্যাতন ও লুটতরাজ চালায়। তারা কাপালিরহাটে আক্রমণ করে গণেশ বসু, সূর্য মজুমদার, কার্তিক সিকদার, অগ্নি কুমার বেপারীসহ অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করে। তারা বাজারের দোকানপাটে লুণ্ঠন শেষে অগ্নিসংযোগ করে। এ- সময় আ. সাত্তার হাওলাদারসহ অনেকে মারাত্মকভাবে আহত হয়। ভাণ্ডারিয়ায় জগা দাস, শামসুল হক কাজী, রোহানী পাল, নিপি ঘোষ, শান্তি সাহা, বিপদ সাহাসহ আরো অনেকে তাদের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। তাদের হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।
২৭শে অক্টোবর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় উপজেলার পশারিবুনিয়ায় নারকীয় গণহত্যা সংঘটিত করে। ঘটনার দিন ভোররাতে তারা পশারিবুনিয়া গ্রাম ঘেরাও করে ঘমুন্ত মানুষজনের ওপর গণহত্যা চলায়। এ-সময় তারা রাজবিহারি ডাক্তারের বাড়ি এবং আশপাশের বাড়িঘরে লুণ্ঠন এবং অগ্নিসংযোগ করে। এখানে গণহত্যার শিকার যাদের পরিচয় জানা গেছে, তারা হলেন- বিজয় সিকদার (পিতা শশী সিকদার, পশারিবুনিয়া), সতীশ সিকদার (নদমুলা), উপেন্দ্রনাথ কুলু (শৌলা, মঠবাড়িয়া), চন্দ্র কান্ত হালদার (পিতা গুরুদেব হালদার, বোথলা), সত্যরঞ্জন হালদার (পিতা সারদা হালদার, বোথলা), রসিক চন্দ্র ঘরামী (পিতা মহিমা ঘরামী, পশারিবুনিয়া), প্রতাপ ঘরামী (শৌলা, মঠবাড়িয়া) ও বিভা রানী (মিরুখালী, মঠবাড়িয়া)।
ভাণ্ডারিয়া ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন মডেল স্কুল ক্যাম্প ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর বন্দিশিবির ও নির্যাতন কেন্দ্র। তারা উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে স্থানীয় রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীদের সহায়তায় মানুষজন ধরে এনে এ ক্যাম্পে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাত।
ভাণ্ডারিয়া সরকারি হাসপাতাল সংলগ্ন বধ্যভূমি উপজেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি হিসেবে বিবেচিত। মুক্তিযুদ্ধকালে এখানে অর্ধশতাধিক মানুষকে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। তাদের অধিকাংশের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ইকরি ইউনিয়নের একটি হিন্দু বাড়ি ছিল হানাদার বাহিনীর আরেকটি বধ্যভূমি। এখানে প্রায় ৩০ জন নারী- -পুরষকে হত্যা করা হয়।
উপজেলায় কোনো গণকবর নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা নদী বা খালের তীরে হত্যাযজ্ঞ চালাত। ফলে অধিকাংশ মৃতদেহ পানিতে ভেসে যায় ১৭ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এদিন কমান্ডার আজিজ সিকদার ও খান এনায়েত করিমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ভাণ্ডারিয়া ইউনিয়ন পরিষদে অবস্থিত পাকবাহিনীর ক্যাম্প দখলের জন্য আক্রমণ চালায়। তখন ছিল ভোরবেলা এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের শারীরিক প্রশিক্ষণ চলছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। পাকবাহিনীও পাল্টা মর্টার হামলা চালায়। কিন্তু নিরাপদ দূরত্বে থাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পরের দিন পাকবাহিনীর একটি দল গানবোটে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তুমুল আক্রমণের ফলে পাকবাহিনী পিছু হটে। এ-যুদ্ধে একজন মেজরসহ বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। ভাণ্ডারিয়া উপজেলা ১৩ই ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয়। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. আবুল কাসেম, বীর বিক্রম (পিতা আবদুল ছোমেদ, রাধানগর), এ এস এম এ খালেক, বীর প্রতীক (পিতা সোনামউদ্দিন, শিয়ালকাঠী) ও আলী আকবর আকন, বীর প্রতীক (পিতা আসমত আলী আকন, গৌরীপুর)।
উপজেলায় পাকিস্তানি বাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের শিকার তারুমনি মিস্ত্রী বীরাঙ্গনা হিসেবে পরিচিত।
ভাণ্ডারিয়া উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাঁদের নাম জানা গেছে, তাঁরা হলেন- ইপিআর সদস্য নায়েক মো. আবুল কাসেম (২১শে নভেম্বর হাকিমপুর যুদ্ধে শহীদ), ক্যাপ্টেন নূরুল আলম (পিতা মোসলেম উদ্দিন মল্লিক, লক্ষ্মীপুর), গণেশ চন্দ্র বসু (পিতা আনন্দ চন্দ্র বসু, ভিটাবাড়িয়া) ও টিপু সুলতান (পিতা আবদুর রশিদ সওদাগর, পৈকখালী, গৌরীপুর)।
ভাণ্ডারিয়া উপজেলায় ‘স্বাধীনতার বিজয়স্তম্ভ’ নামে একটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে ভাণ্ডারিয়া সরকারি হাসপাতল সংলগ্ন বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজ চলছে। [মনিরুজ্জামান শাহীন ও মুহাম্মদ শাহীন রেজা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড