You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভাদেরটেক যুদ্ধ (বিশ্বম্ভরপুর, সুনামগঞ্জ)

ভাদেরটেক যুদ্ধ (বিশ্বম্ভরপুর, সুনামগঞ্জ) সংঘটিত হয় তিনবার – ২৭শে আগস্ট, ৯ই সেপ্টেম্বর ও ২৬শে নভেম্বর। এতে ২৬ জন পাকসেনা ও ৩ জন রাজাকার নিহত হয়। অপরদিকে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ-যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভাদেরটেক মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।
সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বৃহত্তম গ্রাম ভাদেরটেক। জেলা শহর থেকে ২ কিমি উত্তর-পশ্চিমে এর অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রামটি ৫নং সেক্টরের বালাট সাব- সেক্টরের অধীনে ছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এখানে একটি শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করে। এখানে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় মানুষের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন চালাত। তারা গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করত। এ সংবাদ বালাট সাব-সেক্টরে পৌঁছলে কমান্ডার আক্রমণের নির্দেশ দেন। মুক্তিবাহিনী ভাদেরটেক গ্রামের পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণের পরিকল্পনা করে। অধিনায়ক পাণ্ডব চন্দ্র দাশের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এখানে অবস্থান নেন এবং পাকিস্তানি হানাদারদের ওপর আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। প্রথম পর্যায়ে ২৭শে আগস্ট রাত আনুমানিক ৩টায় ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ভাদেরটেক অভিমুখে যাত্রা করেন। ভোর ৫টায় পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ করা হয়। একটি ছোট নদীতে হাঁটুজলে নেমে মুক্তিযোদ্ধারা এক ঘণ্টা যুদ্ধ করেন। সকাল ৬টার দিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। ভাদেরটেকের দখল চলে আসে মুক্তিযোদ্ধারে হাতে। এ-যুদ্ধে একজন পাকসেনা ও ৩ জন রাজাকার নিহত হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ে ভাদেরটেক প্রতিরোধ যুদ্ধে গ্রামবাসীর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ভাদেরটেকে তাঁদের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে অবস্থান গড়ে তুলেছিলেন। এ গ্রামের ৫২ জন যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। গ্রামের নারী-পুরুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন বালাট সাব- সেক্টরের দায়িত্ব নিয়ে ডিফেন্স পুনর্বিন্যাস করেন। ইপিআর হাবিলদার আব্দুল গনির নেতৃত্বে এক কোম্পানি সৈন্য ভাদেরটেক গ্রামে নিয়োগ করেন। তৎকালীন ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ ও ছুটিতে আসা কিংবা অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের নিয়ে এ কোম্পানি গঠিত হয়েছিল। কিন্তু এ কোম্পানির বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন ২৭ জন সদস্যসহ হাবিলদার গনিকে গ্রেফতার করে সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সে পাঠিয়ে দেন। ৯ই সেপ্টেম্বর ভোর ৫টার দিকে সুনামগঞ্জ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল ভারী অস্ত্রসহ দুদিক থেকে ভাদেরটেকে মুক্তিযোদ্ধা ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। এক দল গানবোট থেকে মর্টার ও মেশিনগান দিয়ে গুলি ছুড়তে থাকে। অপর দলটি গজারিয়া নদী দিয়ে বেদেপল্লি হয়ে দক্ষিণ ভাদেরটেক গ্রামে প্রবেশ করে। গানবোট ও পদাতিক বাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা উত্তর দিকে সরে যেতে বাধ্য হন। ভাদেরটেকে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিভিন্ন এলাকায় এমনকি সুনামগঞ্জ শহরেও নির্যাতন, গণহত্যা ও লুটতরাজ চালাত। শহরের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় স্থানটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাই মুক্তিযোদ্ধারা এ স্থানটিকে আবার নিজেদের অধিকারে নেয়ার জন্য পরিকল্পনা করেন। তাই তৃতীয় পর্যায়ে ২৬শে নভেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী ভাদেরটেকে পাকিস্তানি ঘাঁটি আক্রমণ করে। ফলে দুপক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের দেশপ্রেম ও আত্মবিশ্বাস তাঁদের পাকিস্তানিদের নিকট অপ্রতিরোধ্য করে তোলে। যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং ২৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। অপরদিকে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অবশেষে ভাদেরটেক মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসে। [তপন পালিত]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!