ভায়াডাঙ্গা ক্যাম্প অপারেশন (শ্রীবর্দী, শেরপুর)
ভায়াডাঙ্গা ক্যাম্প অপারেশন (শ্রীবর্দী, শেরপুর) সংঘটিত হয় ১লা নভেম্বর। এ-যুদ্ধে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ও ৫ জন সাধারণ মানুষ শহীদ ও ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। অপরদিকে কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়।
শেরপুর জেলার শ্রীবর্দী উপজেলার ভায়াডাঙ্গা বাজারে ট্যাংগরপাড়া হাইস্কুলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একটি শক্তিশালী ক্যাম্প স্থাপন করে। ভারত সীমান্তে স্থাপিত পুরাখাসিয়া মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প থেকে হানাদার বাহিনীর এ ক্যাম্পটির দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার এবং শ্রীবর্দী থেকে ভায়াডাঙ্গা ক্যাম্পের দূরত্ব প্রায় ৭ কিলোমিটার। পাকবাহিনীর এ ক্যাম্পটির পতন ঘটানোর দায়িত্ব অর্পিত হয় ১১ নম্বর সেক্টরের পুরাখাসিয়া সাব-সেক্টর কমান্ডার কে এম শামসুল আলমের ওপর। কমান্ডার কে এম শামসুল আলম বিএসএফ ক্যাপ্টেন বি কে মুখার্জী, একজন জাঠ রেজিমেন্ট কমান্ডার ও একজন মেজরের সঙ্গে পরামর্শ করে ভায়াডাঙ্গা ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা হয় সাপোর্টিং বাহিনী, কার্ট অফ বাহিনী, কমান্ডো বাহিনী ও এসল্ট বাহিনী এই চারটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ভায়াডাঙ্গা হানাদার ক্যাম্পে আক্রমণ চালাবেন। অতঃপর তিনি ২৭ ও ২৮শে অক্টোবর রেকি সম্পন্ন করে ১লা নভেম্বর ভোর ৪টা ১ মিনিটে ভায়াডাঙ্গা ক্যাম্প আক্রমণের তারিখ ও সময় চূড়ান্ত করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভায়াডাঙ্গা ক্যাম্প আক্রমণের জন্য বিএসএফ ক্যাপ্টেন বি কে মুখার্জীর নেতৃত্বে বিএসএফ জওয়ানরা সাপোর্টিং বাহিনী হিসেবে ক্যাম্পে প্রথমে মর্টার শেল নিক্ষেপ করবে। ভায়াডাঙ্গা ক্যাম্প থেকে ৪-৫শ গজ দূরে ভায়াডাঙ্গা-শ্রীবর্দী রাস্তায় কোম্পানি কমান্ডার রুহুল আমিন ও আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে কার্ট অফ বাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হয় যাতে শ্রীবর্দী থেকে হানাদাররা ভায়াডাঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থানরত হানাদারদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে না পারে। এছাড়াও ভায়াডাঙ্গা-শ্রীবর্দীর মাঝে ঠাকুরবাড়ি থেকে শ্রীবর্দীর দিকে সরে ভায়াডাঙ্গা বাজার থেকে দেড় কিলোমিটার দূর পর্যন্ত কাট অফ বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। কমান্ডো বাহিনীর নেতৃত্ব দেবেন সাব-সেক্টর কমান্ডার কে এম শামসুল আলম। এসল্ট বাহিনীর দায়িত্বে কাদেরিয়া বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার আনোয়ার হোসেন এবং তাঁর টু-আই-সি হিসেবে থাকবেন আনোয়ার হোসেন (পুলিশ সদস্য, রূপের বয়ড়া, ঘাটাইল, টাঙ্গাইল)। এসল্ট বাহিনীর ওপর নির্দেশ থাকে ভায়াডাঙ্গা বাজারের পূর্বপাশে হাঁসধরা গ্রামের সম্মুখ দিয়ে যে রাস্তাটি তেঁতুলিয়া- হাতিবাধার দিকে চলে গিয়েছে সেখানে তাঁরা পজিশন নেবেন। একই সঙ্গে তাঁদের আরেক সেকশন মুক্তিযোদ্ধাকে হাঁসধরা গ্রামের পাশ দিয়ে বকশীগঞ্জ এবং ধানুয়া-কামালপুর থেকে পায়ে চলার যে রাস্তাটি এসেছে সে রাস্তার মাথায় এম্বুশে রাখবেন, যাতে বকশীগঞ্জ এবং ধানুয়া-কামালপুর থেকে হানাদার বাহিনীর কোনো গ্রুপ এসে ভায়াডাঙ্গা ক্যাম্পের হানাদার বাহিনীকে সাহায্য করতে না পারে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী সর্বশেষ ব্রিফিং শেষে ৩১শে অক্টোবর রাত ১০টায় মুক্তিযোদ্ধাদের একের পর এক কোম্পানি প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ ভায়াডাঙ্গার উদ্দেশে রওনা হয় এবং রাত ১টার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা যাঁর-যাঁর পজিশনে চলে যান। ১লা নভেম্বর ভোর ৪টা ১ মিনিটে ক্যাপ্টেন বি কে মুখার্জীর নেতৃত্বে সাপোর্টিং বাহিনী শেল নিক্ষেপ শুরু করে। তবে প্রথম শেলটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে এসল্ট বাহিনীর পাশেই বিস্ফোরিত হয়। এতে ছানোয়ার হোসেন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা মারাত্মক আহত হন। তারপর সঠিক নিশানায় সাপোর্টিং বাহিনী অনবরত শেল নিক্ষেপের পর এসল্ট বাহিনীকে হানাদার ক্যাম্প আক্রমণের সংকেত পাঠায়। দিনের আলোতে মুক্তিযোদ্ধারা ফায়ার করতে-করতে ক্যাম্পের সীমানায় চলে যান। এদিকে পাকবাহিনী নিরাপত্তার জন্য ক্যাম্পের চারদিকে বাঁশের অগ্রভাগ সরু করে পুঁতে রেখেছিল। কমান্ডো ও এসল্ট বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা সেগুলো উঠিয়ে অগ্রসর হন এবং বাংকারে গ্রেনেড চার্জ করেন। হানাদাররাও পাল্টা গুলি ছুড়তে থাকে। এমন সময় শ্রীবর্দী থেকে হানাদারদের সাহায্যে তাদের একটি গ্রুপ ভায়াডাঙ্গার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। কাট অফ বাহিনী হানাদারদের প্রতিরোধ না করেই সরে পড়ে। তারপরও মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ইতোমধ্যে ফকিরের টিলা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি গ্রুপ এসল্ট বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। একই সময় শ্রীবর্দী থেকে হানাদারদের সাহায্যে আসা গ্রুপটি ভায়াডাঙ্গা ক্যাম্পে প্রবেশ করেই বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। সকাল ৮টা পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলে। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে টিকে থাকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। এ-যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়। অপরদিকে পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৪ জন আহত হন।
ভায়াডাঙ্গা যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আবু তাহের (পিতা আবদুল আজিজ, মীরকুটিয়া, নাগরপুর, টাঙ্গাইল), আবদুল বারেক ভূঁইয়া (পিতা পাঞ্জু ভূঁইয়া, পাঁচতারা, নাগরপুর, টাঙ্গাইল), আবদুল গণি (পিতা চানমিয়া বেপারী, মীরকুটিয়া, নাগরপুর, টাঙ্গাইল), তোফাজ্জল হোসেন (পিতা বাকাত আলী, বণগ্রাম, নাগরপুর, টাঙ্গাইল) ও সাইকুল ইসলাম (পিতা মোখলেসুর রহমান, নাচনমহুরী, ঝিনাইগাতী, শেরপুর)। আহতরা হলেন- আনোয়ার হোসেন (পিতা জিন্নত আলী, রূপের বয়ড়া, ঘাটাইল, টাঙ্গাইল), সোনা মিয়া (হালুয়াহাটি, শ্রীবর্দী, শেরপুর), ছানোয়ার হোসেন (পাঁচতারা, নাগরপুর, টাঙ্গাইল) ও বেলাল উদ্দিন (পাঁচতারা, নাগরপুর, টাঙ্গাইল)।
ভায়াডাঙ্গা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কে এম শামসুল আলম (সাব-সেক্টর কমান্ডার), শফিউদ্দিন (পুলিশ সদস্য, ধোপাকান্দি, গোপালপুর, টাঙ্গাইল), গোলাম রসুল (পুলিশ সদস্য, ধোপাকান্দি, গোপালপুর, টাঙ্গাইল), শাহাদত হোসেন (পুলিশ সদস্য, নাগরপুর, টাঙ্গাইল), শরিফুল ইসলাম (পুলিশ সদস্য, যশোর), চিত্তরঞ্জন (পুলিশ সদস্য, ফরিদপুর), দিলীপ বাবু (পুলিশ সদস্য, ফরিদপুর), মোশাররফ হোসেন (পুলিশ সদস্য, যশোর), হাবিবুর রহমান তালুকদার (ভাররা, নাগরপুর, টাঙ্গাইল), সিরাজুল ইসলাম (আনসার সদস্য, কুমিল্লা), আমিনুর রহমান (মারমা, নাগরপুর, টাঙ্গাইল), মোকাদ্দেস আলী (সিংজোড়া, নাগরপুর, টাঙ্গাইল), আবু তালেব (সিংজোড়া, নাগরপুর, টাঙ্গাইল), সাইদুর রহমান (ভায়াডাঙ্গা, শ্রীবর্দী, শেরপুর), আবদুল হক (হাতিবাধা, ঝিনাইগাতী, শেরপুর), সুরুজ মিয়া (নকলা, শেরপুর), শামসুল হক (শেরপুর), শহীদ (ময়মনসিংহ), রোস্তম আলী (জারিয়া-জাঞ্জাইল, নেত্রকোণা), জামির উদ্দিন (জারিয়া-জাঞ্জাইল, নেত্রকোণা), ওসমান আলী (জারিয়া-জাঞ্জাইল, নেত্রকোণা), দয়াল (জারিয়া-জাঞ্জাইল, নেত্রকোণা), মোবারক হোসেন (জারিয়া-জাঞ্জাইল নেত্রকোণা), আবদুল খালেক তালুকদার, বাদশা, পাশা, জামাল হোসেন, আবদুল মতিন প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে ভায়াডাঙ্গা গ্রামের ৫ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। তাঁরা হলেন- ইয়াদ আলী, আবুল হোসেন, আবদুল হামেদ হেমা, মহর উদ্দিন ও সাইফুল ইসলাম তুতা মিয়া। [শফিউদ্দিন তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড