You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভাঙ্গামোড় এম্বুশ (সাঘাটা, গাইবান্ধা)

ভাঙ্গামোড় এম্বুশ (সাঘাটা, গাইবান্ধা) রচিত হয় ১৭ই সেপ্টেম্বর। এতে এক মেজরসহ দুজন পাকসেনা নিহত হয়। গাইবান্ধা রণাঙ্গনে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে রোস্তম কোম্পানির অনেক দুঃসাহসী অভিযানের মধ্যে ভাঙ্গামোড়ের এম্বুশ অন্যতম। এ অভিযানে নিজেদের সামান্যতম ক্ষতি ছাড়াই পাকিস্তানি বাহিনীর কুখ্যাত মেজর শের খানসহ অপর এক সেনা সদস্য নিহত হয়। একটি চাইনিজ রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
গলনারচরের গোপন আস্তানায় থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট বিশ্বস্ত সূত্রে খবর আসে যে, ১৮ই সেপ্টেম্বর সকাল ১১টার মধ্যে একজন মেজরের নেতৃত্বে অতিরিক্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে গাইবান্ধা ক্যাম্প থেকে একটি বড় কনভয় ফুলছড়ি সেনা ক্যাম্পে আসবে। এ খবর শোনার পর রোস্তম কোম্পানি কনভয়ে আক্রমণের পারিকল্পনা করে ১৬ই সেপ্টেম্বর রাতে রাস্তার পাশের ভাঙ্গামোড় গ্রামে এসে অবস্থান নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা গাইবান্ধা-ফুলছড়ি সড়কের এই ভাঙ্গামোড় নামক স্থানে এম্বুশ রচনা করার চূড়ান্ত স্থান নির্ধারণ করেন। একই সঙ্গে একশন কাটঅফ ও রিজার্ভ পার্টির পজিশন নেয়ার স্থানও নির্ধারণ করা হয়।
১৮ই সেপ্টম্বর ছিল পবিত্র শবে মেরাজ। সবাই এদিন রোজা রাখার নিয়ত করে ভোররাতে সেরি খেয়ে ২২ জনের দল এম্বুশ স্থলে আসার পূর্বেই অভিযানের উদ্দেশ্যসহ বিস্তারিত ব্রিফিং দেন কোম্পানি কমান্ডার রোস্তম আলী খন্দকার। ভোর ৪টার মধ্যে পুরো দল রাস্তা-সংলগ্ন পূর্বনির্ধারিত ৩টি স্থানে অবস্থান নেয়। অভিযানে মুক্তিযোদ্ধাদের ১টি এলএমজি, ১টি ২” মর্টার, ৩টি এসএমজি, ৪টি এসএলআর ও ১৩টি ৩০৩ রাইফেল ব্যবহৃত হয়েছিল। সবার কোমরে ১টি করে ৩৬টি সক্রিয় হ্যান্ড গ্রেনেড ছিল। ভোর চারটা থেকে অভিযান শুরুর পূর্বে সবার অস্ত্রে গুলি লোড করা হয়। ভোর থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত সড়কে অনেক পথচারী যাওয়া-আসা করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের বিষয়ে কেউ কিছু জানতে পারেনি। পৌনে এগারোটার কিছু পূর্বে উত্তর দিক থেকে মোটর গাড়ির আওয়াজে সবাই সতর্ক হয়ে যান। নিজ-নিজ অস্ত্রের সেফটি কেইস অন করে ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে অপেক্ষা করতে থাকেন। দুই-তিন মিনিটের মধ্যেই ১টি জিপ ও ২টি পিক-আপের কনভয় মুক্তিযোদ্ধাদের এম্বুশ এলাকায় ঢোকামাত্র কমান্ডারের সংকেত ফায়ারের সঙ্গে-সঙ্গে ১৬টি অস্ত্র কনভয়ের ওপর গর্জে ওঠে। সঙ্গে-সঙ্গে কনভয় থেমে যায়। শত্রুসেনারা দ্রুত কনভয় থেকে নেমে রাস্তায় অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলি ছুড়তে শুরু করে। সামনের জিপ থেকে নামার সময় মেজর শের খান গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় ঢলে পড়ে। দুজন পাকসেনা তাকে ধরে গাড়ির পেছনে উঠায়। আরো এক সেনা গুলিবিদ্ধ হয় ও তার অস্ত্রটি ছিটকে পড়ে। ইতিমধ্যে কাট অফ পার্টিও শত্রুর পেছন দিক থেকে গুলি ছুড়তে শুরু করে। ক্রস ফায়ারে পড়ে শত্রুসেনারা ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় দ্রুত পজিশন থেকে উঠে পূর্বে স্টার্ট দিয়ে রাখা জিপ ও পিক-আপে চড়ে দ্রুত ফুলছড়ির দিকে যেতে শুরু করে। শত্রুসেনাদের পিক-আপে উঠতে দেখে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান থেকে উঠে গুলি ছুড়তে-ছুড়তে রাস্তায় উঠে আসেন এবং শত্রুদের ধাওয়া করেন। শত্রু কনভয় গুলির আওতার বাইরে চলে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা রাস্তায় একত্রিত হন। দ্রুত তাঁরা ঐ স্থান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ ওয়ারলেসে খবর পান পাকসেনারা গাইবান্ধা, বোনারপাড়া ও ফুলছড়ি থেকে বিশাল শক্তি সঞ্চয় করে ঘটনাস্থলে আসতে পারে। সে অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা ভাঙ্গামোড় থেকে মাঠের মাঝ দিয়ে পশ্চিম দিকে যাওয়া শুরু করেন এবং চকদাতেয়া গ্রামের মিয়া বাড়িতে যাত্রা বিরতি করেন। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে তিনদিক থেকে প্রায় দুই শতাধিক পাকিস্তানি সেনা ঘটনাস্থল ভাঙ্গামোড়ে আসে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে না পেয়ে কয়েকজন গ্রামবাসীকে মারপিট করে ও কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ফিরে যায়। [গৌতম চন্দ্ৰ মোদক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!