You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভাইবোনছড়া অপারেশন (খাগড়াছড়ি সদর)

ভাইবোনছড়া অপারেশন (খাগড়াছড়ি সদর) পরিচালিত হয় দুদফায়- অক্টোব/নভেম্বর মাসে প্রথম এবং ৬ই ডিসেম্বর দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত পর্যায়ে। এতে ক্যাপ্টেন অশোক দাশগুপ্ত ওরফে বাবুল চৌধুরীর নেতৃত্বে একাধিক মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ অংশগ্রহণ করে। পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে রাজাকার ও মিজোবাহিনীর সদস্যরা ছিল। উভয় যুদ্ধে হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের অনেকে হতাহত হয়। দ্বিতীয়বার আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিত্রবাহিনীর সদস্যরাও ছিলেন। হানাদাররা টিকতে না পেরে পিছু হটে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ক্যাম্প দখল করে নেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী খাগড়াছড়ি দখলে নেয়ার পর খাগড়াছড়ির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকিস্তানিদের সঙ্গে মিজোবাহিনী ও স্থানীয় রাজাকার, শান্তি কমিটি ও হিলরাজ বাহিনীর সদস্যরাও ছিল। ১নং সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলামের নির্দেশে ভাইবোনছড়া আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। অক্টোবর/নভেম্বরের দিকে প্রথম ক্যাম্পে আক্রমণ চালানো হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থান ছিল ভাইবোনছড়ার একটি চালের খালি গোডাউনে। ওখানে আনুমানিক এক প্লাটুন বা ৪০ জনের মতো পাকিস্তানি সৈন্য ছিল। ক্যাম্পে রাজাকার ও কিছু মিজো সদস্যরাও ছিল। অক্টোবর/নভেম্বর মাসে মুক্তিযোদ্ধা দলটি ভারত থেকে সকাল বেলা মার্চ করে সন্ধ্যার সময় এখানে পৌঁছে। ইপিআর নায়েক সুবেদার খায়রুজ্জামান, খলিলুর রহমান, কাবিল মিয়া, আবদুল মান্নান, আবুল হোসেন, মো. আলী-১, মো. আলী-২ প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা দলে ছিলেন। দলে বেশির ভাগ ছিলেন ইপিআর সদস্য। সংখ্যায় তাঁরা প্রায় ৫০ জনের মতো হবেন। ভাইবোনছড়ার পশ্চিমে নদীর পাড়ে পাহাড়ের ওপর অবস্থান নেন মুক্তিযোদ্ধারা। আর শত্রুবাহিনীর ক্যাম্প ছিল নদীর পূর্ব পাড়ে।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের বেলায় মুক্তিযোদ্ধারা দুই ইঞ্চি মর্টার আর ক্ষুদ্র অস্ত্র নিয়ে শত্রুবাহিনীর ক্যাম্প লক্ষ করে আক্রমণ শুরু করেন। শত্রুসৈন্যরা ক্যাম্পের মধ্যেই ছিল। হঠাৎ আক্রমণে তারা হতভম্ব হয়ে পড়ে। ক্যাম্পের ভেতর থেকে প্রচণ্ড আর্তনাদ আর চিৎকারের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর ক্যাম্প থেকেও মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ করে গুলি ছোড়া হয়। শুরু হয় প্রচণ্ড গোলাগুলি। ত্রিশ মিনিটের মতো চলে গোলাগুলি। যুদ্ধে বেশকিছু শত্রুসৈন্য হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা কমলাবাগান দিয়ে প্রায় ১৬-১৭ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে তবলছড়ি ফিরে যান। সেখান থেকে যান ভারতের শিলাছড়ি ক্যাম্পে।
ডিসেম্বরের ৬ তারিখ আবারো ভাইবোনছড়া ক্যাম্পে আক্রমণ চালান মুক্তিযোদ্ধারা। ক্যাপ্টেন অশোক দাশগুপ্ত বিভিন্ন গ্রুপ নিয়ে অপারেশনে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন সেনাবাহিনীর হাবিলদার মোস্তাফিজুর রহমান, ইপিআর নায়েক সুবেদার খায়রুজ্জামান, পুলিশ বাহিনীর মো. মোস্তফা, ২০৯নং প্লাটুন কমান্ডার কাবিল মিয়া এবং ৯৩নং প্লাটুন কমান্ডার (শার্লি কোম্পানি) আলী আশরাফ। তাঁদের প্রত্যেকের গ্রুপে গড়ে ২৫-৩০ জন করে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ইউনুস মিয়া, রফিকুল ইসলাম, আবদুল বারেক, আবদুল কাদের, হাবিল মিয়া, আবদুল মান্নান, রুস্তম আলী, আবু তাহের, মোবারক হোসেন, মো. আলী-১, মো. আলী-২, শরবত আলী, মোমিন, কালা মিয়া, শিশু মিয়া, সিরাজ, শেখ আহমদ, আবদুস সোবহান, ইদ্রিস মিয়া, নোয়াব আলী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
এখানকার অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে — মিত্রবাহিনী যোগ দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রসর হচ্ছেন আর শত্রুসৈন্যরা পিছু হটছে। এমনি অবস্থায় বেলছড়ি ক্যাম্প আক্রমণ করে মিত্রবাহিনীর একটি দল দীঘিনালা থেকে ভাইবোনছড়া আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয়। ভোররাতে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী চার ইঞ্চি মর্টার দিয়ে শত্রুদের ভাইবোনছড়া ক্যাম্প আক্রমণ করে। শত্রুপক্ষও পাল্টা আক্রমণ চালায়। শুরু হয় প্রচণ্ড গোলাগুলি। প্রায় এক ঘণ্টা গোলাগুলি চলে। এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে। সকালে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প দখল করেন। ৫০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা ভাইবোনছড়া ক্যাম্পে থেকে যান। বাকিরা সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকেন। এ-যুদ্ধে শত্রুবাহিনীর অনেকে হতাহত হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হননি। [ইয়াছিন রানা সোহেল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!