মুক্তিযোদ্ধাদের একজন সহযোগী ও শহীদ ভাগীরথী সাহা
ভাগীরথী সাহা (১৯৪০-১৯৭১) মুক্তিযোদ্ধাদের একজন সহযোগী ও শহীদ। বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলার দেবীপুর গ্রামে ১৯৪০ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম বসন্ত কুমার সাহা এবং মাতার নাম চারুবালা। বসন্ত কুমার সাহার তিন কন্যার মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন ভাগীরথী ভাগীরথীর পিতা পেশায় ছিলেন একজন মুড়ি বিক্রেতা। অভাবের সংসার বলে ভাগীরথী পড়াশোনা করতে পারেননি। ১৯৫৬ সালে তাঁর বিয়ে হয় পিরোজপুর জেলার কদমতলা ইউনিয়নের বাঘমারা গ্রামের প্রিয়নাথ সাহার সঙ্গে। তাঁর দুটি সন্তান কার্তিক সাহা এবং গণেশ সাহা। ১৯৬৭ সালে প্রিয়নাথ সাহা মারা গেলে ভাগীরথীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর শত্রুরা অন্যান্যদের সঙ্গে ভাগীরথীর বাড়িও লুট করে। ফলে দেশের মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে তিনি একাত্ম হয়ে পড়েন। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে তিনি পাকবাহিনীর গোপন সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব নেন। সারাদিন শহরে ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়িয়ে তিনি নানা খবর সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের পৌঁছে দিতেন। পরে তিনি পাকবাহিনীর ক্যাম্পে থালা-বাসন ধোয়ার কাজ নেন। সেখানে কাজের লোকের ছদ্মবেশে তিনি পাকবাহিনীর আলোচনা শুনতেন এবং তাদের কথাবার্তা মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে দিতেন। তাঁর দেয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে পাকবাহিনী আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে দুবার কদমতলায় হামলা চালায়। কিন্তু ভাগীরথী আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের সে খবর জানিয়ে দেয়ায় পাকবাহিনী সাফল্য অর্জন করতে পারেনি, বরং মুক্তিবাহিনীর পাল্টা আঘাতে তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়।
এ অভিযানের পর পাকবাহিনী ভাগীরথীকে সন্দেহ করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা বুঝতে পারে যে, ভাগীরথী অসত্য তথ্য দিয়ে তাদেরকে মুক্তিবাহিনীর মুখে ফেলছে। ফলে তারা ভীষণ ক্ষিপ্ত হয় এবং পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন এজাজ ভাগীরথীকে যে-কোনো মূল্যে ধরে আনার জন্য নির্দেশ দেয়। নির্দেশ মোতাবেক সুবেদার সেলিম ভাগীরথীকে ধরে আনার জন্য কয়েকজন সৈন্যকে নিয়োগ করে। ১৩ই সেপ্টেম্বর সকালে ভাগীরথী পিরোজপুর শহরে আসেন। শহরে প্রবেশের কিছুক্ষণ পর তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে বন্দি হন। তাঁকে নিয়ে আসা হয় সুবেদার সেলিমের কাছে। সুবেদার সেলিম তাঁকে নিয়ে যায় ক্যাপ্টেন এজাজের বাসভবনে। সেখানে ক্যাপ্টেন এজাজ ভাগীরথীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে এবং তা সবার সামনে কার্যকর করার আদেশ দেয়। আদেশ পেয়ে সুবেদার সেলিমের নির্দেশে ভাগীরথীর দুহাত দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়। দড়ির আরেক প্রান্ত বাঁধা হয় মোটর সাইকেলের সঙ্গে। সুবেদার সেলিম নিজেই মোটর সাইকেল চালায়। ক্যাপ্টেন এজাজের বাসভবন থেকে মোটর সাইকেল চলতে শুরু করে, আর ভাগীরথীকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে। রাস্তার সঙ্গে ঘর্ষণে ভাগীরথীর পরিধেয় বস্ত্র খুলে যায়, তাঁর সমস্ত শরীর রক্তাক্ত হয়ে যায় এবং মাংস খসে রাস্তায় পড়ে থাকে। তাঁকে টেনে শহরের কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে চৌরাস্তায় নিয়ে আসা হয়। প্রত্যক্ষদর্শী একজন মুচি লক্ষ্মীনারায়ণের ভাষ্যমতে ভাগীরথী তখনো জীবিত ছিলেন। সেখান থেকে তাঁকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় বলেশ্বর নদীর খেয়াঘাটের বধ্যভূমিতে। সুবেদার সেলিম ভাগীরথীর নিথর দেহাবশেষ গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয়। এরপর তাঁর দেহ নিক্ষেপ করা হয় বলেশ্বর নদীতে। তাঁর লাশ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভাগীরথীর নির্মম ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড পিরোজপুর শহরে ভীষণ আতঙ্ক সৃষ্টি করে। পিরোজপুর শত্রুমুক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সে আতঙ্ক কাটেনি। [মুহাম্মদ শাহীন রেজা]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড