You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে ভাঙ্গা উপজেলা (ফরিদপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে ভাঙ্গা উপজেলা (ফরিদপুর)

ভাঙ্গা উপজেলা (ফরিদপুর) পূর্ব থেকেই রাজনীতি সচেতন একটি এলাকা। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আমলে বৃহত্তর ফরিদপুর ও বরিশালে সংঘটিত সকল রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রভাব এ অঞ্চলেও পড়ে। এখানে অনেক বিপ্লবী ও সংগ্রামী মানুষের জন্ম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিSavedআন্দোলনে এ উপজেলার মানুষ অংশ নেয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ভাঙ্গা-সদরপুর-চরভদ্রাসন থেকে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ- প্রার্থী শামসুদ্দিন মোল্লা এবং ভাঙ্গা আসন থেকে প্রাদেশিক পরিষদে সৈয়দ হায়দার হোসেন বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। বরিশাল-ফরিদপুর-ঢাকা এবং ঢাকা-মাওয়া-খুলনা সড়ক ভাঙ্গার ওপর যাওয়ায় যোগাযোগের দিক থেকে এ উপজেলার গুরুত্ব অপরিসীম। মুক্তিযুদ্ধের সময় নৌ ও সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভাঙ্গার গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ছিল। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের তত্ত্বাবধানে ছাত্র-যুবকদের নিয়ে ভাঙ্গায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। স্থানীয়ভাবে ভাঙ্গা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়৷ এতে স্কুলের ক্যাডেট কোরের ডামি রাইফেল ব্যবহার করা হয়। ছুটিতে থাকা সেনাবাহিনীর সদস্য মোজাম্মেল হোসেন খসরু, এনায়েত খন্দকার, সেকেন্দার আলী প্রমুখের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ চলে। ১৯শে মার্চ অসহযোগ আন্দোলন-এর সময় থানা ঘেরাও করে অনেক আগ্নেয়াস্ত্র দখল করা হয়, যা প্রাথমিক প্রশিক্ষণ কাজে এবং পরবর্তীকালে যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। ভাঙ্গা থানার কিছু মুক্তিযোদ্ধা ভারত থেকেও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
ভাঙ্গা উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে শামসুদ্দিন মোল্লা এমএনএ, সৈয়দ হায়দার হোসেন এমপিএ, এস এম নুরুন্নবী (ফরিদপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক), এডভোকেট আসাদুজ্জামান, ডা. হাবিবুর রহমান, রমেশ চন্দ্র দত্ত, আ. হাই কুটি মিয়া, আবু নাসের ইয়ার মোহাম্মদ (বড় আবু), মিয়া আব্দুস সালাম, আ. জব্বার মাতুব্বর, এ কে এম জহিরুল হক (ছোট আবু) প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ভাঙ্গা থানায় মুজিব বাহিনীর প্রধান ছিলেন আব্দুল ওয়াদুদ। এ কে এম জহুরুল হক ছিলেন সহ-প্রধান।
১৯শে মার্চ সাধারণ জনতা ভাঙ্গা থানা আক্রমণ করে। মোজাম্মেল হোসেন খসরু, আবু নাসের ইয়ার মোহাম্মদ (বড় আবু), এ কে এম জহিরুল হক (ছোট আবু), মিয়া আব্দুস সালাম, আ. জব্বার মাতুব্বর, আব্দুস সামাদ, ছাত্রনেতা আব্দুল ওয়াদুদ, কিসলু, জুয়েল, হান্নান প্রমুখ একে-একে থানায় প্রবেশ করেন। মোজাম্মেল হোসেন খসরু ও আব্দুস সামাদ থানার সেন্ট্রির রাইফেল কেড়ে নেন এবং থানার ওসির রিভলভার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। এর মধ্যে শতাধিক ছাত্র-জনতা থানা ঘেরাও করে ফেলে। চারদিকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ওঠে। জনতা থানার লকারে ঢুকে অস্ত্র দখল করে। তারা থানা থেকে ৩৫টি রাইফেল ও ১০ পেটি গুলি, ১টি রিভালবার ও কয়েকটি বন্দুক হস্তগত করে। পাকবাহিনী ভাঙ্গায় প্রবেশ করার পূর্ব পর্যন্ত থানা মুক্তিকামী জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে ছিল।
২১শে এপ্রিল পাকবাহিনী ফরিদপুর শহরে প্রবেশ করে। পরের দিন ২২শে এপ্রিল তাদের একটি অংশ বরিশালের দিকে অগ্রসর হয়ে বিকেলে ভাঙ্গা থানায় প্রবেশ করে এবং থানা ভবনে ক্যাম্প স্থাপন করে। পরে তহশিল অফিস ও ডাকবাংলোয় তাদের ক্যাম্প স্থানান্তর করা হয়।
ভাঙ্গা উপজেলার কাপুড়িয়া সদরদী গ্রামের আক্তারুজ্জামান ওরফে মনু মিয়ার নেতৃত্বে এ এলাকার স্বাধীনতাবিরোধীরা সংগঠিত হয় এবং পর্যায়ক্রমে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন করে। এসব বাহিনীতে বেছে-বেছে কিছু দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী এবং ডাকাত প্রকৃতির মানুষকেও তারা অন্তর্ভুক্ত করে। মুন্নু মিয়া স্থানীয় সশস্ত্র বাহিনী ও পাকসেনাদের নিয়ে ভাঙ্গার গ্রামে-গঞ্জে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ব্যক্তিদের সংগঠিত করে। নওপাড়ার কাজী এমদাদ (হিঙ্গুল কাজী)-এর নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। নুরপুরের শাজাহান মাস্টার, বেলাল শিকদার ও লাল চানের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। রাজাকার ও পাকহানাদারদের নিয়ে মুন্নু মিয়া, হিঙ্গুল কাজী ও শাজাহান মাস্টার ভাঙ্গা থানার বিভিন্ন গ্রাম ও হাটে লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, নারীনির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালায়।
শান্তি কমিটির প্রধান মুন্নু মিয়ার নেতৃত্বে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় রাজাকার, আলবদর ও পাকসেনারা অগ্নিসংযোগ, নারীনির্যাতন ও গণহত্যা চালায়। রাজাকারদের হাতে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অনেকে নিহত হয়। সদরদী রায়পাড়ায় রাজাকাররা নগেন চন্দ্র শীল, লালু চান, রজনী মালো, সন্তোষ কুমার সাহা, ষষ্ঠী সাহা প্রমুখকে হত্যা করে। তারা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বিবিরশন্দার সাজাহান মুন্সী, রওশন মুন্সী ও মাতাহার লস্করকে নির্যাতনের পর হত্যা করে।
উপজেলা সদরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম চণ্ডিদাসদীতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর একাধিকবার হামলা হয়। এতে অনেকে শহীদ হন। চণ্ডিদাসদী গণহত্যায় ২০ জন মানুষ প্রাণ হারায়। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এ গ্রামের সকল বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
উপজেলা সদর থেকে ৩ কিমি দূরবর্তী গ্রাম জান্দী। পার্শ্ববর্তী নওপাড়া গ্রামের রাজাকার কমান্ডার হিঙ্গুল কাজীর নেতৃত্বে ২রা মে রাজাকার ও শতাধিক পাকসেনা জান্দী গণহত্যা চালায়। তারা হিন্দু অধ্যুষিত এ গ্রামে প্রবেশ করে গ্রামের ৪০ জন নিরীহ মানুষকে ধরে আনে। তারপর সবাইকে এক স্থানে জড়ো করে হত্যা করে।
ভাঙ্গা উপজেলার তহশিল অফিসের পার্শ্ববর্তী স্থানে প্রায় প্রতিদিন লোকজন ধরে এনে নির্যাতন ও হত্যা করা হতো। প্রতিরাতেই এখানে আর্ত চিৎকার শোনা যেতো। মাঝে-মধ্যে গুলির শব্দে এলাকার মানুষের ঘুম ভেঙ্গে যেতো। ফলে বৃদ্ধরা ব্যতীত এলাকার সকল নারী-পুরুষ প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।
ভাঙ্গা উপজেলায় একটি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। সেটি হলো ভাঙ্গা তহশিল অফিস বধ্যভূমি। এখানে কতজনকে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার পর তহশিল অফিসের অভ্যন্তর এবং পুকুর ও ডোবা থেকে অনেক মানুষের কংকাল উদ্ধার করে কবর দেয়া হয়৷
ভাঙ্গা উপজেলায় একটি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হয়— পাতরাইল যুদ্ধ। ৮ই ডিসেম্বর মাদারীপুর থেকে ফরিদপুর যাওয়ার পথে পাকসেনাদের ৫০ জনের একটি দল ভাঙ্গা থানার পাতরাইল গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। আক্রমণের মুখে তারাও পাল্টা-আক্রমণ করে। ফলে দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে ৩৯ জন পাকসেনা হতাহত হয় এবং বাকিরা আত্মসমর্পণ করে। অপরদিকে জাহাঙ্গীর নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৯ই ডিসেম্বর পাকবাহিনী ভাঙ্গা থেকে পালিয়ে ফরিদপুর গেলে ঐদিন থানাসহ অত্র এলাকা হানাদারমুক্ত হয়৷
ভাঙ্গা থানার দুজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় জানা গেছে। তাঁরা হলেন- মো. ফজলুর রহমান (পিতা সবদু হাজী, মহেশদ্দী; বন্দি অবস্থায় শহীদ) এবং আইয়ুব আলী খান (পিতা এয়াকুব আলী খান, গঙ্গাধরদী; ভেদরগঞ্জ যুদ্ধে শহীদ)। জান্দী গ্রামে নিহতদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। [মোসায়েদ হোসেন ঢালী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড