You dont have javascript enabled! Please enable it! ভবেরচর ব্রিজ গণহত্যা (গজারিয়া, মুন্সীগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

ভবেরচর ব্রিজ গণহত্যা (গজারিয়া, মুন্সীগঞ্জ)

ভবেরচর ব্রিজ গণহত্যা (গজারিয়া, মুন্সীগঞ্জ) দেখুন ভবেরচর ব্রিজ অপারেশন (গজারিয়া, মুন্সীগঞ্জ)
ভয়রা বধ্যভূমি (ইটনা, কিশোরগঞ্জ) কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলায় অবস্থিত। ইটনা শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দক্ষিণে হাওরবেষ্টিত গ্রাম ভয়রা। এ গ্রাম জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের অন্তর্গত এবং হিন্দু অধ্যুষিত। গ্রামের এক প্রান্তে একটি বিশাল বটগাছ। এই বট গাছের নিচে একটি ছোট কুটিরে বাস করতেন ৮০ বছরের এক সন্ন্যাসিনী। এটি ছিল সাধু রাজচন্দ্র বৈরাগীর আশ্রম। ভয়রা গ্রামের পাশে মুসলমান অধ্যুষিত গ্রাম নয়ানগর। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এ গ্রামের কিছু লোভী মানুষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণের গুজব রটাত, যাতে ভয়রা গ্রামের হিন্দুরা প্রাণ বাঁচানোর জন্য তাদের সহায়-সম্বল ফেলে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। এদের এ কৌশল প্রয়োগ এবং পার্শ্ববর্তী কিছু গ্রামে পাকসেনাদের আক্রমণের কারণে ভয়রা গ্রামের অনেকে বাড়ি ও সম্পদ ফেলে নিরাপদ জায়গায় চলে যায়। এ সুযোগে নয়ানগরের কিছু লোক গ্রামটিতে লুটপাট চালায়। তারা ধান, চাল, গরু-বাছুর, এমনকি আসবাবপত্র পর্যন্ত নিয়ে যায়। এক সময় বটগাছের নিচের আশ্রমটিও বিরান এলাকায় পরিণত হয়।
২৬শে আগস্ট পাকিস্তানি সৈন্যরা ইটনায় আসার পর এ বটমূলে পাহারাচৌকি বসায় এবং আশ্রম সংলগ্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে ক্যাম্প স্থাপন করে। এ এলাকার লোকজনদের আশ্রয়ের জন্য ভারতের মেঘালয়ে যেতে ভয়রার পার্শ্ববর্তী হাওর পাড়ি দিতে হতো। পাকিস্তানিদের কাছে দ্রুতগামী স্পিড বোট, দূরপাল্লার বাইনোকুলার এবং সার্চলাইট ছিল। এখান থেকে তারা চারদিকের হাওর পর্যবেক্ষণ করত। ইটনার ডাকবাংলোতে আরেকটি ঘূর্ণায়মান সার্চলাইট ছিল। সার্চলাইটের তীব্র আলোতে রাতে হাওর আলোকিত হয়ে উঠত। ফলে বাইনোকুলারের মাধ্যমে শরণার্থীদের বহনকারী দূরের নৌকাগুলো দেখা যেত। দেখামাত্র স্পিড বোট নিয়ে পাকিস্তানিরা তাদের ধরে ভয়রায় নিয়ে আসত। এভাবে ভয়রার বটমূলে নিয়ে এসে প্রথমে তারা শরণার্থীদের অর্থ, স্বর্ণালংকার ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিস কেড়ে নিত। পরে কম বয়সী মেয়েদের রেখে অন্যদের হত্যা করত। আগস্টের শেষদিকে এ এলাকায় পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের দোসরদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ভারতের মেঘালয় যাওয়ার ঘটনা বাড়তে থাকে। ফলে টহলদারী সৈন্যদের হাতে শরণার্থী-নৌকা বেশি সংখ্যায় ধরা পড়তে থাকে। এভাবে ইটনার হাওর এবং ভয়রার বটমূল শরণার্থীদের জন্য এক ভয়াল মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় মিঠামইন উপজেলার ছত্রিশঢালা, ধোবাজোড়া এবং বোরনপুর গ্রামের অসংখ্য নারী-পুরুষ ও শিশু- -বৃদ্ধকে হাওর থেকে ধরে এনে এ বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নরসিংদী জেলারও বহু মানুষ এ পথে ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করে এখানে প্রাণ হারান। ভয়রার সেই বটগাছ হত্যাযজ্ঞের নীরব সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে।
বিভিন্ন সময় এ বধ্যভূমিতে যাদের হত্যা করা হয়, তাদের সবার পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে কিছু নিহত ব্যক্তির পরিচয় জানা গেছে। এখানে ৩রা সেপ্টেম্বর মিঠামইন উপজেলার ধোবাজোড়া গ্রামের যাদের হত্যা করা হয়, তারা হলেন— আ. মান্নান ভূঞা এমএ, এমএড (পিতা আ. আজিজ ভূঞা), রুকনুজ্জামান ভূঞা এমএসসি (পিতা আ. আজিজ ভূঞা), আ. মজিদ ভূঞা (পিতা সওদাগর ভূঞা), আ. মতিন ভূঞা বিএ (পিতা আ. মজিদ ভূঞা), আ. রাশিদ ভূঞা (পিতা আ. মজিদ ভূঞা), আ. গণি ভূঞা (পিতা নাসির উদ্দিন ভূঞা, সাবেক চেয়ারম্যান), আ. রউফ ভূঞা (পিতা আ. গণি ভূঞা), জহির উদ্দিন ভূঞা (পিতা শুকুর মামুদ ভূঞা), রমিজ উদ্দিন ভূঞা (পিতা শুকুর মামুদ ভূঞা), আ. লতিফ ভূঞা (পিতা শবদর আলী ভূঞা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক), সিদ্দিকুর রহমান ভূঞা (পিতা আ. লতিফ ভূঞা; প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক), রমজান আলী ভূঞা (পিতা আমজত আলী ভূঞা), বুধু ভূঞা (পিতা আমজত আলী ভূঞা), নূর আলী ভূঞা (পিতা আমজত আলী ভূঞা), চাঁন মিয়া (পিতা আ. করিম), সুরুজ মিয়া (পিতা আ. করিম), আবু জামাল (পিতা রাজা মিয়া), আনোয়ার আলী (পিতা আ. ফকির) ও বাদশা মিয়া। এ বধ্যভূমিতে ১৫ই সেপ্টেম্বর মিঠামইন উপজেলার ঢালাছত্রিশ গ্রামের যাদের হত্যা করা হয়, তারা হলেন- মোরারী চৌধুরী (পিতা মনা চৌধুরী), কামিনী চৌধুরী (পিতা হৃদয় চৌধুরী), ধীরেন্দ্র চৌধুরী (পিতা হৃদয় চৌধুরী), ক্ষেত্রমোহন চৌধুরী (পিতা হৃদয় চৌধুরী), ভোলা চৌধুরী (পিতা ধীরেন্দ্র চৌধুরী), পতৃক চৌধুরী (পিতা রাজ কুমার চৌধুরী), বেবুল চৌধুরী (পিতা রাজ কুমার চৌধুরী), রমেশ চৌধুরী (পিতা গোবিন্দ চৌধুরী), প্রাণেশ চৌধুরী (পিতা গোবিন্দ চৌধুরী), মুকুন্দ চৌধুরী (পিতা গোবিন্দ চৌধুরী), জয়দেব চৌধুরী (পিতা ক্ষেতলাল চৌধুরী), ভূদেব চৌধুরী (পিতা ক্ষেতলাল চৌধুরী), সুদেব চৌধুরী (পিতা ক্ষেতলাল চৌধুরী), কার্তিক দাস (পিতা ভীম দাস), মাখন দাস (পিতা ভীম দাস), মদন দাস (পিতা অৰ্জুন দাস), কালাচান দাস (পিতা রমাকান্ত দাস), ধনঞ্জয় দাস (পিতা দুখাই দাস), প্রেম চরণ দাস, নিবাস চন্দ্র দাস প্রমুখ। [মো. রওশন আলী রুশো]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড