মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা থেকে এডভোকেট আলী আজম জাতীয় পরিষদে এবং লুৎফুল হাই সাচ্চু প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁদের নেতৃত্বে এখানে মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩রা মার্চ ঢাকায় আহুত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টিকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এদেশের জনগণ বুঝতে পারে যে, পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সঙ্গে আলোচনায় কোনো লাভ হবে না। আন্দোলন করেই বাঙালির অধিকার আদায় করতে হবে। তাই বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সারা দেশে পাকিস্তানি শাসন-শোষণ ও নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সকল স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেয়।
২রা মার্চ থেকে প্রতিদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সভা-সমাবেশ ও মিছিলের আয়োজন করা হয়। সর্বত্র সর্বাত্মক হরতাল-ধর্মঘট চলতে থাকে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় এখানে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়। এর আড়াই হাজারের মতো সদস্য ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মহকুমা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান এডভোকেট হামিদুর রহমান এবং উপ-প্রধান কাজী আখতারুজ্জামনের নেতৃত্বে প্রতিটি থানা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড বা গ্রাম পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান ছিলেন আবুল কালাম ভূঞা এবং উপ-প্রধান ছিলেন হাবিবুর রহমান। সর্বস্তরের জনগণ অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও মিছিলে যোগদান করতে থাকে। অফিস-আদালতের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ভাষণ শোনার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর অসংখ্য নেতা-কর্মী ঢাকায় যান। ঢাকা থেকে ফিরে এসে তাঁরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক স্থানীয়ভাবে কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান এডভোকেট হামিদুর রহমান মোগড়ার গোলাম রফিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর কাছ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের একটি তালিকা সংগ্রহ করেন। এরপর তাঁদের নিয়ে তিনি একটি সভা করেন। সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন এলাকার যুবকদের সংগঠিত করে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এ লক্ষ্যে দক্ষিণ পৈরতলায় ছাত্রনেতা সৈয়দ এমরানুর রেজার বাড়ির উঠানে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের শিক্ষক লুৎফুর রহমানের (পরবর্তীতে শহীদ) সভাপতিত্বে আয়োজিত এ সভায় ৩০০ জনের মতো ছাত্র, যুবক, শ্রমিক ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্য উপস্থিত ছিলেন। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অধ্যাপক লুৎফুর রহমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে ৫০টির মতো ডামি রাইফেল এডভোকেট হামিদুর রহমানের নিকট হস্তান্তর করেন। এগুলো নিয়ে হামিদুর রহমান ছাত্রনেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ মাঠ, পূর্ব মেড্ডা গরুর বাজার মাঠ (বর্তমান পৌর কলেজ), অন্নদা স্কুল মাঠ এবং ঘাটুরা গ্যাসফিল্ড মাঠে ছাত্র-যুবকদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু করেন। সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রশিক্ষণ দানে এগিয়ে আসেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের ক্যাডেট কোরের ছাত্ররাও এ-সময় প্রশিক্ষণ গ্রহণ শুরু করেন। সর্বত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি চলতে থাকে। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সহযোগিতায় বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-যুবকরা সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের উদ্যোগ নেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি হুমায়ুন কবির ও জিএস শেখ কুতুব হোসেনের নেতৃত্বে কলেজ চত্বরে একটি প্রাথমিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়। কলেজের ক্যাডেট কোরের ছাত্ররা প্রথম এ প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। পর্যায়ক্রমে কয়েকশত ছাত্র-যুবক স্বতঃস্ফূর্তভাবে এখানে প্রশিক্ষণ নেন। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে লেফটেন্যান্ট ডা. আখতারের নেতৃত্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি শক্তিশালী প্রশিক্ষণ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। অল্পদিনের মধ্যেই এ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা দশ হাজারে উন্নীত হয়। এ বিপুল সংখ্যক প্রশিক্ষণার্থীকে এখানে প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব ছিল না। তাই ক্যাম্পটিকে তেলিয়াপাড়ায় স্থানান্তর করা হয়। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়। সেসব কেন্দ্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ও ছাত্রনেতৃবৃন্দকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ট্রেজারি থেকে রাইফেল সরবরাহ করা হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের বিজ্ঞানাগার থেকে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে তা দিয়ে হাতবোমা বানানো শুরু করেন। প্রয়োজনে হাতবোমা দিয়েও শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য সকলে প্রস্তুত হন। ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন, মুক্তিযুদ্ধে তাদের সমর্থন আদায় এবং অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের লক্ষ্যে এডভোকেট আলী আজম এমএনএ, আওয়ামী লীগ নেতা রবীন্দ্রমোহন নাগ ওরফে রবি নাগ (শাহবাজপুর), আবদুল আলী মোল্লা (চান্দুরা) এবং মো. শাহজাহান মিয়াসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ আগরতলায় গিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে মুক্তিযুদ্ধের আলাদা কোনো কমান্ডার ছিল না। মেজর সাফায়াত জামিল ও মেজর খালেদ মোশাররফের নির্দেশনায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের নেতৃত্বে এখানকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। এডভোকেট আলী আজম ভূঞা এমএনএ, এডভোকেট লুৎফুল হাই সাচ্চু এমপিএ, মহকুমা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান এডভোকেট হামিদুর রহমান, উপ-প্রধান কাজী আখতারুজ্জামান, থানা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান আবুল কালাম ভূঁইয়া, উপ-প্রধান হাবিবুর রহমান, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রউফ ওরফে হামদু মিয়া, আবদুল মালেক, শফিক খান, মাহবুবুল হুদা, মোশাররফ হোসেন ওরফে জীবন মিয়া, নজরুল ইসলাম বাদল ও জয়নাল আবেদিন আখন্দ এবং ছাত্রলীগ নেতা হুমায়ুন কবির, শেখ কুতুব হোসেন, আমানুল হক সেন্টু, আবদুল ওয়াহিদ খান লাভলু প্রমুখ এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন।
এডভোকেট আলী আজম এমএনএ মহকুমা পুলিশ অফিসার (এসডিপিও) আজহারুল ইসলাম এবং পুলিশ ইন্সপেক্টর চৌধুরী ফজলুল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন যে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ বাহিনী পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুত। এরপর তিনি ছাত্র-জনতাকে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য আহ্বান জানান। পাকবাহিনী ২৫শে মার্চ ঢাকায় গণহত্যা শুরু করলে স্থানীয় নেতৃবৃন্দসহ ছাত্র-জনতা রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ২৬শে মার্চ সকালে পাকসেনারা রাস্তায় নেমে কারফিউ জারির ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণার পর প্রাথমিক পর্যায়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে আতঙ্কের সৃষ্টি হলেও বেলা ১০টা নাগাদ ছাত্র-জনতা খণ্ডখণ্ড মিছিল নিয়ে এডভোকেট আলী আজম এমএনএ ও লুৎফুল হাই সাচ্চু এমপিএ-র বাসভবনে সমবেত হতে থাকে। এরপর ছাত্রনেতৃবৃন্দ এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা কারফিউ ভঙ্গ করে রাস্তায় নেমে আসে। লুৎফুল হাই সাচ্চু এমপিএ কয়েকজন ছাত্রনেতাসহ একটি জিপে চড়ে সারা শহর প্রদক্ষিণ করে সবাইকে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ুন।
এরূপ একটি মুহূর্তের জন্যই যেন সারা শহরের মানুষ অপেক্ষা করছিল। রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র, শ্রমিক, সংস্কৃতিকর্মী ও বিভিন্ন পেশাজীবীসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার- হাজার ছাত্র-জনতা লাঠিসোঁটা, কাঠের চেলি, বাঁশ, রামদা, বল্লম ইত্যাদি নিয়ে মিছিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থানরত চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা বিদ্রোহ করে সংগ্রামী জনতার সঙ্গে যোগ দেন। সকলের মুহুর্মুহু স্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। মেজর শাফায়াত জামিলের নির্দেশে তখন লেফটেন্যান্ট কবির ও লেফটেন্যান্ট হারুন স্থানীয় মহকুমা প্রশাসক ও পুলিশ প্রশাসককে বিদ্রোহের কথা জানান। মহকুমা প্রশাসক কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ এবং এসডিপিও আজহারুল ইসলাম প্রথম থেকেই অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
মেজর খালেদ মোশাররফ ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা শত্রুমুক্ত রাখার লক্ষ্যে দুটি কোম্পানিকে ভৈরব বাজারে পাঠিয়ে দেন এবং অন্য একটি কোম্পানিকে কুমিল্লার দিকে অগ্রসর হতে বলেন। এরপর তিনি মেঘনার পূর্বপাড়ে একটি প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরির ব্যবস্থা করেন। এছাড়াও তিতাস নদীর চতুর্দিকে অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষাব্যূহ নির্মাণ করেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তখন চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট, বাঙালি ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর কাছে যেসব অস্ত্র ছিল, তা দিয়েই প্রতিরোধ আন্দোলন জোরদার করা হয়। ছাত্র-জনতা, শ্রমিক-কৃষক ও বিভিন্ন পেশাজীবীসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রথম এ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ শক্তি বহুগুণে বেড়ে যায়। মেজর কে এম সফিউল্লাহর নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট জয়দেবপুরে বিদ্রোহ ঘোষণার পর ৩১শে মার্চ থেকে ১লা এপ্রিলের মধ্যে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে মিলিত হয়। দ্বিতীয় ও চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট একত্রিত হওয়ার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধ একটি সুসংহত সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়। এ দুটি বেঙ্গল রেজিমেন্ট স্থানীয় জনগণের সহায়তায় সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
১৪ই এপ্রিল বিকেল থেকে পাকবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওপর বিমান হামলা চালায়। ঐদিন দীর্ঘ সময় ধরে কয়েকটি জঙ্গি বিমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের আনাচে-কানাচে গোলা নিক্ষেপ করে ফিরে যায়। পরদিন ১৫ই এপ্রিল সকাল থেকে পুনরায় বিমান হামলা শুরু হয়। বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিবাহিনীর অবস্থানগুলোর ওপর প্রায় সারাদিন ধরেই আক্রমণ চলে। এরপর শহরতলী এলাকায় হেলিকপ্টারে করে সৈন্য নামায়। এলাকার বহু সাধারণ মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বাড়িঘর ছেড়ে চলে যায়। ১৪, ১৫ ও ১৬ই এপ্রিল উপর্যুপরি বিমান হামলায় মুক্তিবাহিনীও ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। কিছু অংশ তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টার্সে চলে যায়। সেখান থেকে অতিরিক্ত সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্রসহ আখাউড়া- সিলেট রেললাইন এবং সীমান্ত এলাকা দিয়ে এগিয়ে এসে আখাউড়ায় অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়।
১৭ই এপ্রিল পাকবাহিনী পশ্চিম দিক থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে অনুপ্রবেশ করেন তারা শহরের বড়বড় বাড়ি, বাজার, স্কুল-কলেজ ও মন্দিরে আগুন দেয়। সারা শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে এবং ব্যাপকহারে লুটতরাজ করে। এরপর পাকবাহিনী পর্যায়ক্রমে ওয়াপদা অফিস, নাটাই বটতলী এবং শ্রী শ্রী আনন্দময়ী কালীবাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করে।
১৭ই এপ্রিল পাকবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখলে নেয়ার পর এখানকার জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, -পিডিপি- ও মুসলিম লীগ-এর নেতারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত হয়। জামায়াতে ইসলামীর হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া (পিতা শামসু ভূঁইয়া, সুহিলপুর), মুসলিম লীগের জিল্লুর রহমান, আজিজুর রহমান মোল্লা, পিয়ারা মিয়া, পিডিপি-র আবদুর রহমান খান, হামিদুল হক টুক্কু প্রমুখ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে অভিনন্দন জানায়। পাকিস্তানি সামরিক সরকারের প্রতি তারা আনুগত্য প্রকাশ করে। হাবিবুর রহমান ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক এবং এডভোকেট এ টি এম ওবায়দুল্লাকে (পিডিপি-র নেতা) সদস্য-সচিব করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। মে মাসের মধ্যে বিভিন্ন থানা, ইউনিয়ন এবং গ্রাম পর্যায়ে শান্তি কমিটির শাখা গঠিত হয়। সুহিলপুর গ্রামের আনসার কমান্ডার আবুল কালাম চৌধুরী ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রধান রাজাকার কমান্ডার। সে বিভিন্ন গ্রামের সাধারণ মানুষকে নানাভাবে হয়রানি ও নির্যাতন করে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতগামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রকে সে তিতাস নদীর পাড় থেকে আটক করে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। ৬ই মে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে শান্তি কমিটির উদ্যোগে মিছিল ও জনসভার আয়োজন করা হয়। শান্তি কমিটির সদস্য, রাজাকার, স্থানীয় বিহারি এবং স্বাধীনতাবিরোধীরা পাকিস্তানের পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুন ইত্যাদি নিয়ে মিছিলে অংশগ্রহণ করে। পাকিস্তানি মেজর বোখারীর উপস্থিতিতে লোকনাথ ময়দানে একটি সভা হয়। আজিজুর রহমান মোল্লা, আবদুর রহমান খান, পিয়ারা মিয়া, হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া প্রমুখ এ সভায় বক্তৃতা করে। মে মাস থেকেই সমগ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। পাকিস্তানি সামরিক সরকার ঘোষিত প্রতিটি কার্যক্রম বাস্তবায়নে তারা তৎপর ছিল।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হিন্দু নিদর্শনগুলো পাকবাহিনী ধ্বংস করে দেয়। শ্রী শ্রী আনন্দময়ী কালীবাড়িতে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপনের পর বাড়িটির নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করা হয় ‘রাজাকার মঞ্জিল’। বাড়ির ফটকে, যেখানে পাথরে খোদাই করে লেখা ছিল ‘শ্রী শ্রী আনন্দময়ী কালীবাড়ি’, তা ভেঙ্গে সেখানে বাংলা ও উর্দু হরফে লেখা হয় ‘রাজাকার মঞ্জিল, রহমান বাড়ি’। এমনকি ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ নামটিও পরিবর্তন করে ‘রহমান বাড়ি’ রাখা হয়।
জুলাই মাসে নেজামে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা ফরিদ আহমদ শান্তি কমিটি আয়োজিত এক জনসভায় বক্তৃতা করে। পরবর্তী সভায় জামায়াতে ইসলামীর গোলাম আযম ও মুসলিম লীগের এ কিউ এম শফিকুল ইসলাম ‘দুষ্কৃতিকারীদের’ হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তৃতা দেয়। ৬ই সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে অনুষ্ঠিত শান্তি কমিটির এক সভায় মেজর আশরাফ খান চৌধুরী সভাপতিত্ব করে। এ সভায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাম পরিবর্তন করে ‘তাজুল ইসলাম নগর’ রাখার ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু ৯ই অক্টোবরের সভায় এ নামও পরিবর্তন করে ‘রহমান বাড়ি’ রাখা হয়। ৬ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা দিবসে শান্তি কমিটি ‘সংহতি’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে। পত্রিকার সম্পাদক এবং প্রকাশক ছিল শান্তি কমিটির প্রচার সম্পাদক ফারুকুল ইসলাম। মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মিন্নাত আলী পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীতে ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের অধ্যক্ষ আলী আজহার টি কে (তমঘায়ে খেদমত) পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করে।
শান্তি কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষকে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করে। তারা মুক্তিযোদ্ধা ও হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। তালিকা প্রস্তুত করে পাকবাহিনীকে হত্যাকাণ্ডে সহায়তা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িতে না পেয়ে তাঁদের পিতা-মাতা ও গ্রামবাসীদের ধরে নিয়ে পাকহানাদারদের হাতে তুলে দেয়। নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। শান্তি কমিটির দালাল জুরু মিয়া (তন্দুর হুজুর) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বহু মুক্তিযোদ্ধার নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে রাজাকার ও পাকবাহিনীর ক্যাম্পে জমা দেয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কুমারশীল মোড়ে একটি হিন্দুবাড়ি দখল করে শান্তি কমিটির অফিস স্থাপন করা হয়। বাড়িটির নাম দেয়া হয় শান্তিভবন। ওখান থেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গণহত্যা ও ধরপাকড়ের নীলনকশা তৈরি হয়। শান্তি কমিটির অফিস থেকে ‘ডান্ডিকার্ড’ বা পরিচয়পত্র দেয়া হতো। হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে যাদের কাছে পরিচয়পত্র থাকত না তাদের ধরে নিয়ে হত্যা করত। স্থানীয় দালালরা অর্থের বিনিময়ে কার্ড করে দিত। শান্তি কমিটির সদস্য রবিউল ইসলাম এবং তার ভাই ফারুকুল ইসলাম আইডেন্টিটি কার্ডের ছবি তুলে তখন প্রচুর টাকা হাতিয়ে নেয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কয়েকটি হিন্দুবাড়িও তারা দখল করে।
১৭ই এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর দখলের সময় পাকবাহিনী শহরের পৈরতলা এলাকায় সেকান্দার হাজি ও তার পুত্র কাসেম আলী চেয়ারম্যান এবং পীর সিরাজ পাঠানকে হত্যা করে। বুধন্তি ইউনিয়ন শান্তি কমিটির আহ্বায়ক আবদুল হেলিম (মাতু মিয়া) এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুত করে পাকবাহিনীকে দেয়। কমিটির উপ-প্রধান মাজু মিয়া ইসলামপুরের পশ্চিমে লাঙ্গইল্যা বিল থেকে মুক্তিযুদ্ধের একজন টু-আই-সি (সেকেন্ড ইন কমান্ড)সহ তিনজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে একজনকে নিজের হাতে গুলি করে হত্যা করে। অন্য দুজনকে পাকসেনাদের হাতে তুলে দেয়। সুহিলপুরের রাজাকার কমান্ডার আবুল কালাম চৌধুরী বহু মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘর তল্লাশি এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর দিনের পর দিন নির্যাতন চালায়।
মৈন্দ-বারৈউড়া গ্রামের ১৮ জন সাধারণ কৃষককে পাকবাহিনী শাহবাজপুর সংলগ্ন তিতাস নদী থেকে ধরে নিয়ে যায়। সেখান থেকে শাহবাজপুর ওয়াপদার দক্ষিণে চাতল বিলে নিয়ে সবাইকে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়, যা চাতলবিল- শাহবাজপুর গণহত্যা – নামে পরিচিত। শাহবাজপুরের রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনী মৈন্দ গ্রামের হাজী আশরাফ আলীকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। ২৪শে মে তারা আটলা গ্রামে ঢুকে প্রথমেই আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মান্নান মনু মিয়া ও খেলু মিয়ার বাড়িতে আক্রমণ চালায়। মাছিহাতা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সভাপতি হামিদুল হক হামদু সেদিন আটলায় তাঁর নিজ বাড়িতে ছিলেন। এ সংবাদ পেয়েই পাকবাহিনী সেদিন আটলা গ্রামে আক্রমণ চালায়। রাজাকার কমান্ডার হাফিজউদ্দিন গ্রামটি চিনিয়ে দেয় ৷ পাকবাহিনী এখান থেকে একজন মুক্তিযোদ্ধাসহ ১৩ জন লোককে ধরে নিয়ে উজানিসার ব্রিজের পাশে হত্যা করে, উজানিসার গণহত্যা নামে পরিচিত।
৯ই আগস্ট পাকবাহিনী বিজেশ্বর ইউনিয়নের উলচাপাড়া গ্রামে অতর্কিতে হামলা করে। ঐ গ্রামের জামে মসজিদের ইমাম আব্দুল কুদ্দুছ ক্বারীর (জামায়াতে ইসলামীর সদস্য ও শান্তি কমিটির দালাল) সহযোগিতায় তারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অশ্বিনী কুমার দেবনাথ এবং আওয়ামী লীগ কর্মী নায়েব আলী, শিশির কুমার দেবনাথ, তাজুল ইসলাম, আনোয়ারুল ইসলাম, তোতা মিয়া ও আবদুল করিমকে ওয়াপদা ক্যাম্পে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালায়। ১০ই আগস্ট রাতে ওয়াপদার দক্ষিণ পাশে অশ্বিনী কুমারকে দিয়ে মাটি খুঁড়িয়ে গর্ত করার পর তাকে হত্যা করে সেখানে মাটিচাপা দেয়। পরে তারা শিশির কুমারকেও হত্যা করে। ১৮ই আগস্ট পাকবাহিনী ১৩ জন মানুষকে হাত ও চোখ বেঁধে দাতিয়ারা ওয়াপদা অফিসের পূর্বদিকে মৌলভি আলী আজমের বাড়ির পাশে গুলি করে হত্যা করার পর মাটিচাপা দেয়। এটি দাতিয়ারা গণহত্যা হিসেবে পরিচিত পাকবাহিনী ও রাজাকারদের হাতে বন্দি অন্যান্যরা দীর্ঘদিন নির্যাতন ভোগ করার পর শান্তি কমিটির সদস্য ও দালালদের মাধ্যমে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পায়। শান্তি কমিটির সেকান্দার আলী ও মাজু মিয়া এলাকার রাজাকারদের নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু বাড়িঘর লুট করে। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারবর্গের কাছ থেকে তারা মাসিক কিস্তিতে চাঁদা আদায় করত। যারা চাঁদা দিতে পারত না, তাদের ওপর নির্যাতন চালাত। পাকসেনাদের নিয়ে তাদের বাড়িতে চড়াও হতো। কারো কারো বাড়িঘর পুড়িয়ে দিত। ইসলামপুরের রাজাকার কমান্ডার মোবারক হোসেন মুক্তিযোদ্ধা দারু মিয়া ও মোতালিব মিয়ার পিতা-মাতাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে অত্যাচার করে। সলিমুল্লাহ (বুধন্তি), সোলেমান (কেনা), মিয়া (বারঘড়িয়া), সুবের রহমান (বেরুইন), মোসলিম মিয়া (ইসলামপুর) প্রমুখ রাজাকার সারা বুধন্তি ইউনিয়নে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
২৪শে অক্টোবর সকালে একজন জেলেকে মাঠ থেকে ধরে এনে ক্যাম্পের পাশে হত্যা করা হয়। ২৫শে অক্টোবর রাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৪৯ জন নারী, পুরুষ ও শিশু নৌকাযোগে উজানিসার তিতাস ব্রিজের নিচ দিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় পাকসেনা ও রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে। তাদের সুলতানপুর ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। গাড়িতে এবং গাড়ি থেকে নামিয়ে সুলতানপুর ক্যাম্পের সামনের মাঠে হানাদাররা নারীদের ওপর নির্যাতন চালায়। নির্যাতনে দুজন নারী ঘটনাস্থলেই মারা যান। বাকি ২০ জন নারীকে সুলতানপুর স্কুলের অফিস কক্ষে এবং ২৭ জন পুরুষ ও শিশুকে পাশের একটি কক্ষে বন্দি করে রাখা হয়।
ঢাকাস্থ মোহাম্মদপুর থানার ওসি শিরু মিয়া, তাঁর কিশোর ছেলে ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুলের ছাত্র আনোয়ার কামাল, বাজিতপুর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমান, তোলারাম কলেজের ছাত্র আবু সাঈদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের ছাত্র শামসুল হক (নীলক্ষ্যা, রায়পুরা) ও হারিস মিয়াসহ বহু মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষকে তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়। পরে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে তাদের হত্যা করা হয়। ২৭শে নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের অধ্যাপক লুৎফুর রহমানকে কলেজ থেকে গ্রেফতার করা হয়। এ-সময় সরাইলের আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট আকবর হোসেন (বকুল মিয়া), তাঁর ছোটভাই সয়দ আফজল হোসেন, পৈরতলার মো. শাহজাহান মিয়া, সরাইলের ডা. হারুন ইসলাম (হারু ডাক্তার)-সহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বহু মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়। পর্যায়ক্রমে তাদের অনেককেই হত্যা করা হয়। তখন প্রায় প্রতিদিনই পাকবাহিনী বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ধরে এনে হত্যা করত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে যাবার পূর্বে ৬ই ডিসেম্বর রাতে পাকবাহিনী জেলখানা থেকে অধ্যাপক এ কে লুৎফুর রহমান ও এডভোকেট আকবর হোসেন (বকুল মিয়া)-সহ বহু মুক্তিযোদ্ধা, সাধারণ মানুষ ও বুদ্ধিজীবীকে কুরুলিয়া খালের পাড়ে নিয়ে হত্যা করে। এটি কুরুলিয়া খালপাড় গণহত্যা নামে পরিচিত।
সেপ্টেম্বর মাসে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা সুলতানপুরের উত্তর বাজার এলাকা থেকে ২৩ জন গ্রামবাসীকে ধরে এনে লাইন করে দাঁড় করায়। এরপর সেখান থেকে রতন মিস্ত্রি (বিরামপুর) এবং চির কুমার কাপালিককে (কলেমা বলতে ব্যর্থ হওয়ায়) লাইন থেকে আলাদা করে সুলতানপুর থেকে দক্ষিণ দিকে উজানীসার ব্রিজে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পাকবাহিনী তাদের ওয়াপদা, নাটাই বটতলী এবং আনন্দময়ী কালীবাড়ি ক্যাম্পকে নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করে। তবে তাদের প্রধান নির্যাতনকেন্দ্র ও বধ্যভূমি ছিল সুলতানপুর নির্যাতনকেন্দ্র ও বধ্যভূমি। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস ধরেই সুলতানপুর এবং তার আশপাশের এলাকায় নির্যাতন, লুণ্ঠন ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া আরেকটি নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল রাজাকার মঞ্জিল নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা হিন্দু বাড়িগুলোতে লুটপাট করে, বিভিন্ন এলাকা থেকে যুবতী মেয়েদের আটক রেখে দিনের পর দিন নির্যাতন করে হত্যা করে। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে (বর্ষাকালে) রাজাকাররা সিঙ্গারবিল এলাকা থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩৭ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে ধরে আনে। তাদের মধ্যে ১৬ জন যুবতী, ১৪ জন শিশু-কিশোর এবং ৭ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ছিল। পাকসেনারা যুবতী মেয়েদের একটি ঘরে আটক রেখে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে দুটি বধ্যভূমি রয়েছে— উজানিসার ব্রিজ বধ্যভূমি – এবং পৈরতলা বধ্যভূমি ও গণকবর। পাকবাহিনী বহু লোককে এদুটি স্থানে ধরে এনে হত্যা করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শত্রুমুক্ত হওয়ার পর পৈরতলা রেলব্রিজের পাশে গণকবর খুঁড়ে তিন-চারশ কঙ্কালের সন্ধান পাওয়া যায়। ঐ স্থানটি পৈরতলা গণকবর নামে পরিচিত। ঈদুল ফিতরের দিন সন্ধ্যার কিছু আগে পাকসেনারা পৈরতলা গ্রামটি ঘিরে ফেলে এবং সেখানে কারফিউ দিয়ে আশপাশের বাড়িঘর থেকে নারী-পুরুষ ও শিশু নির্বিশেষে বহু মানুষকে ধরে রেলব্রিজের পাশে নিয়ে যায়। এরপর তারা গ্রামের ছয়- সাতজন লোককে ধরে এনে তাদের দিয়ে গর্ত খুঁড়িয়ে সবাইকে হত্যা করে সেখানে মাটিচাপা দেয়। একই দিন রাতে কয়েকটা বাস ভর্তি করে বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু লোককে সেখানে এনে হত্যা করা হয়। নজরুল ইসলামসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকেও সেখানে এনে হত্যা করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উত্তরে হবিগঞ্জ, তেলিয়াপাড়া ও মাধবপুর থেকে দক্ষিণে কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর ও ব্রাহ্মণপাড়া পর্যন্ত বিশাল এলাকা মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে শত্রুমুক্ত ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা এখানে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। এ-সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওপর স্থলপথে কয়েকদফা আক্রমণ করে ব্যর্থ হয়ে পাকবাহিনী ক্রমাগত বিমান হামলা শুরু করে। ২রা এপ্রিল তারা উজানিসার ও গঙ্গাসাগর এলাকায় মুক্তিবাহিনীর ওপর বিমান হামলা চালায়। এরপর মুক্তিবাহিনীর এ অবস্থান দুটি আরো শক্তিশালী করা হয়। ৪ঠা এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের দক্ষিণাংশে কুরুলিয়া খাল এলাকায় ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের অবস্থানের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আক্রমণ চালায়। ৫ ও ৬ই এপ্রিল পুনরায় বিমান হামলা হয়। ৬ই এপ্রিল শহরের রেলক্রসিং ও নিয়াজ মুহাম্মদ হাইস্কুল সংলগ্ন এলাকায় দুটি বিমানের ক্রমাগত হামলায় দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর নুরুল ইসলামের ব্যাটম্যান শহীদ হন। মেজর শাফায়াত জামিল তখন একটি গাড়ি নিয়ে শহরের দক্ষিণ দিকে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের অবস্থানের দিকে যাচ্ছিলেন। মেজর নুরুল ইসলামও তাঁর ব্যাটম্যানসহ গাড়িতে ছিলেন। গাড়ির ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডে উড়ছিল বাংলাদেশের পতাকা। এ গাড়ির ওপরই হঠাৎ করে বিমান হামলা করা হয়। মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর নুরুল ইসলাম, তাঁদের দুজন ব্যাটম্যান ও ড্রাইভারসহ পাঁচজন দ্রুত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেন।
১৩ই এপ্রিল থেকে পাকবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখলের জন্য জল, স্থল ও বিমান পথে একযোগে আক্রমণ শুরু করে। এই ত্রিমুখী সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আশুগঞ্জ ও লালপুরে নিয়োজিত দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা তাঁদের অবস্থান ছেড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলে আসেন। মেঘনা ব্রিজ ও আশুগঞ্জ-লালপুর এলাকা সম্পূর্ণভাবে পাকসেনাদের দখলে চলে যায়।
২৪শে অক্টোবর রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে সাড়ে চার মাইল উত্তরে নন্দনপুরের কাছে প্রায় আড়াইশ মুক্তিযোদ্ধা সিএন্ডবি রাস্তা অতিক্রম করার সময় রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের এম্বুশে পড়েন। মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে ছিলেন ভৈরব বাজারের শাহাদাত হোসেন বেনু। এম্বুশে থাকা রাজাকার ও পাকসেনারা গুলি ছুড়তে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি চালান। কিন্তু হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্রের কাছে তাঁরা বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। এটি নন্দনপুর যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। এ-যুদ্ধে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা বন্দি হন এবং তাঁদের বহু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ হাতছাড়া হয়।
১৯শে নভেম্বর মুকুন্দপুর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে ২৮ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে এবং মুকুন্দপুর এলাকা হানাদারমুক্ত হয়।
৩০শে নভেম্বর থেকে ৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও তার সীমান্ত অঞ্চল আখাউড়া, আজমপুর ও রামপুরে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী-র সঙ্গে পাকবাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়, যা আখাউড়া-আজমপুর-রামপুর- ব্রাহ্মণবাড়িয়া যুদ্ধ নামে পরিচিত। এতে বহু পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৮ই ডিসেম্বর সকালে মুক্তিবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর নিজেদের দখলে নেয় এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- হাবিবুর রহমান, বীর উত্তম- (পিতা আজিজুর রহমান, মৈন্দ পূর্বপাড়া), হাবিলদার নাসির উদ্দিন, বীর উত্তম- (পিতা লাল মিয়া, মোহাম্মদপুর), আবু ছালেক, বীর প্রতীক (পিতা শহীদ আবুল হাসেম, টানমান্দাইল), আব্দুল মালেক, বীর প্রতীক (পিতা করম উদ্দিন, গোকর্ণ) ও সাইদুল হক, বীর প্রতীক (পিতা মমিনুল হক ভূঞা, ঘাটিয়ারা)।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- হাবিলদার নাসির উদ্দিন, বীর উত্তম (৪ঠা আগস্ট ঝিনাইগাতী উপজেলার নকশী বিওপিতে পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটি আক্রমণে শহীদ), সানাউল হক (সেনাবাহিনীর সদস্য; পিতা সায়েব আলী, রামরাইল), মো. হুমায়ুন কবির (সেনাবাহিনীর সদস্য; পিতা শামসুল হক, রামরাইল), মো. নজরুল ইসলাম (পিতা মো. গোলাম রসুল, রামরাইল), হাবিবুর রহমান খান (ইপিআর সদস্য; পিতা মিজানুর রহমান খান, পুনিয়াউট), হাবিবুর রহমান (আনসার সদস্য; পিতা হাজি সুরুজ আলী, সুহিলপুর হিন্দুপাড়া; সরাইল থানার বেড়তলা-শান্তিনগর যুদ্ধে শহীদ), আলতাফ হোসেন (আনসার সদস্য; পিতা আসব আলী, সুহিলপুর হিন্দুপাড়া; ঢাকার মোহাম্মদপুরে শহীদ), মো. জহিরুল ইসলাম (পিতা সুরুজ মিয়া, কোড্ডা), আলী আজম ভূঁইয়া (পিতা আব্দুস সামাদ ভূঁইয়া, পাইকপাড়া), মো. আলম ভূঁইয়া (পিতা আ. জলিল ভূঁইয়া, পাইকপাড়া), মো. নাজিম উদ্দিন ভূঁইয়া (পিতা আশিস ভূঁইয়া, পাইকপাড়া), খায়ের মিয়া চৌধুরী (পিতা আ. আহাদ চৌধুরী, পাইকপাড়া), মো. আবদুস সাত্তার (পিতা আবদুস সামাদ, সুলতানপুর), গোলাম মোস্তফা (সেনাবাহিনীর সদস্য; পিতা মকসুদ আলী, শিলাউর), বাবরু মিয়া (পিতা ছমির উদ্দিন, মহিউদ্দিন নগর), আবদুল আহাদ (পিতা আলী আজম, মহিউদ্দিন নগর), জিতু মিয়া (সেনাবাহিনীর সদস্য; পিতা হাজি নইমউদ্দিন, খেওয়াই), মো. আবুল হোসেন (সেনাবাহিনীর সদস্য; পিতা আবদুল ভূঁইয়া, চান্দপুর), গাজী নিজাম উদ্দিন (সেনাবাহিনীর সদস্য; পিতা আ. হক ভূঁইয়া, আটলা), মো. মমিনুল হক (সেনাবাহিনীর সদস্য; পিতা আবুল হাশেম ভূঁইয়া, দক্ষিণ – জগতসার), সামসুল হক (সেনাবাহিনীর সদস্য; পিতা চান্দ আলী মুন্সী, বড় হরণ), আবুল খায়ের (পিতা মিয়াচান সরকার, বড় হরণ), মো. শামসুল হক (সেনাবাহিনীর সদস্য; পিতা ধন মিয়া, কালিসীমা), মাহবুবুর রহমান চৌধুরী (পিতা মতিউর রহমান চৌধুরী, চিনাইর), আবদুর রহমান চৌধুরী (পিতা আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী, দক্ষিণ জগতসার), শফিকুল ইসলাম (পিতা হাজি গোলাম আহমদ, খাকচাইল), কাজী আলী আহাম্মদ (সেনাবাহিনীর সদস্য; ঘাটুরা, ময়মনসিংহে শহীদ), সিরাজ মিয়া (আমিরপাড়া, মজলিশপুর), আবরু মিয়া (পাইকপাড়া), খলিলুর রহমান (তারুয়া), ওমর আলী (মহিউদ্দিন নগর), আবদুল হাশিম ভূঁইয়া (চান্দপুর), মো. ইয়াছিন খান (পিতা মো. ইউনুস খান, দাতিয়ারা), হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া, আটলা), মনিরউদ্দিন (শালগাঁও, কালিসীমা), হারুন মিয়া (ভাদুঘর), ফজলুর রহমান (ঘাটিয়ারা), আবদুর রউফ (নাটাই), এ বি এম রহিম (ঘাটিয়ারা), মো. রহিমউদ্দিন (বিরামপুর), নজরুল ইসলাম (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র), হারিস মিয়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে বন্দি ছিলেন; ২১শে নভেম্বর রাতে পৈরতলা রেলসেতুর পাশে বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়), আশুরঞ্জন দে (ভৈরব বাজার, নন্দনপুর যুদ্ধে আহত অবস্থায় বন্দি হন; কয়েকদিন তাঁকে আটকে রেখে নির্যাতনের পর কুরুলিয়া খালে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়), ধন মিয়া ওরফে আবদুল মালেক (পিতা আবদুল আলী, সাহাপুর; ৩০শে সেপ্টেম্বর শহীদ), উমর আলী (কৃষক; পিতা হাজি আবদুন নূর, মহিউদ্দিন নগর), আবদুল আহাদ (পিতা আলী আজম, মহিউদ্দিন নগর), আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া (সুলতানপুর, মহিউদ্দিন নগর-আহরন্দ এলাকায় শহীদ), মো. এলু মিয়া (কোড্ডা) ও আবদুর রহমান চরু (নন্দনপুর)। এছাড়া বরিশালের একজন মুক্তিযোদ্ধা এখানে যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হন। তিনি হলেন আনোয়ারুল করিম ওরফে মানিক মিয়া (পিতা আবদুর রাজ্জাক)।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফারুকী পার্কে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে, যা ফারুকী পার্ক স্মৃতিসৌধ নামে পরিচিত। ১৯৮৪ সালের ১৯শে মে ব্রিগেডিয়ার আসমা আমিন পিএসসি এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন এবং ১৯৮৫ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের দক্ষিণ পাশে কাউতলীর মোড়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে সৌধ হিরন্ময়। ১৯৯৬ সালের ২৪শে নভেম্বর এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন জেলা প্রশাসক এবং ১৯৯৯ সালের ১৫ই মে এর ফলক উন্মোচন করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মন্ত্রী মো. জিলুর রহমান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া গোলচত্বরে ‘জাতীয় বীর আবদুল কুদ্দুস মাখন পৌর মুক্তমঞ্চ’ নির্মাণ করা হয়েছে। [জয়দুল হোসেন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড