You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে ব্রিগেড ফোর্স

ব্রিগেড ফোর্স ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ব্যাপক গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু হলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর সকল ইউনিটের বিদ্রোহী বাঙালি সৈন্যরা পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয় পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ এবং সর্বস্তরের বাঙালি জনগণ; প্রতিরোধ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ২৫শে মার্চ থেকে জুন মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে মূলত গেরিলা পদ্ধতি (‘হিট এন্ড রান’ যুদ্ধকৌশল) প্রয়োগ করে। এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করে তাদের দুর্বল ও বিপর্যস্ত করে নিরাপদ অবস্থানে চলে যেতেন। গেরিলাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল মূলত শত্রুসেনাদের ব্যবহৃত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অন্যান্য স্থাপনা ধ্বংস করা এবং শত্রুদের ঘাঁটি, জ্বালানি, গোলাবারুদ ও রসদ সরবরাহের ওপর হামলা চালানো। এ পর্যায়ে ভারতীয় বিএসএফ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করত। তবে অল্পদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিযোদ্ধারা বুঝতে পারেন যে, ‘হিট এন্ড রান’ যুদ্ধকৌশল প্রয়োগ করে আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাময়িক বিজয় অর্জন করা সম্ভব হলেও সে বিজয়কে ধরে রাখা সম্ভব হবে না, এজন্য প্রয়োজন প্রচলিত যুদ্ধ। তাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে টিকে থাকার লক্ষ্যে প্রচলিত যুদ্ধ শুরু করার জন্য নিয়মিত বাহিনী পুনর্গঠনের প্রয়োজন হয়। এছাড়া জুন মাস থেকে মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকলে বাংলাদেশ সরকার শত্রুসেনাদের ওপর নিয়ন্ত্রিত ও সংঘবদ্ধ আক্রমণের জন্য গেরিলা যুদ্ধের পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশ হিসেবে তিনটি ব্রিগেড ফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়।
বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মেজর জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম এবং মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম মুক্তিবাহিনীর এ তিন সেক্টর কমান্ডারের ইংরেজি নামের আদি অক্ষর দিয়ে ব্রিগেড তিনটির নামকরণ করা হয় যথাক্রমে ‘জেড’ ফোর্স (জিয়া ফোর্স), ‘এস’ ফোর্স (সফিউল্লাহ ফোর্স) ও ‘কে’ ফোর্স (খালেদ ফোর্স)। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ, ৮ম এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গঠিত ৯ম, ১০ম ও ১১শ ব্যাটালিয়ন সমন্বয়ে এ তিনটি ব্রিগেড ফোর্স গঠিত হয়। তবে যেহেতু এ-সকল ব্যাটালিয়নে সৈন্য সংখ্যা কম ছিল, তাই ১১টি সেক্টর থেকে সামরিক বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ এবং অন্যান্য আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে ব্রিগেডের শক্তি বৃদ্ধি করা হয়। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার দুটি ব্যাচে সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট অফিসার নিয়োগ করে। প্রথম ব্যাচে ৬১ জন ক্যাডেট এবং দ্বিতীয় ব্যাচে ৪৭ জন ক্যাডেট প্রশিক্ষণ শেষে কমিশনপ্রাপ্ত হন। সেনাবাহিনীর এ-সকল অফিসারকেও ব্রিগেড ফোর্সের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, যদিও প্রথম থেকেই তিনটি ব্রিগেড ফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, কিন্তু অস্ত্র ও যাবতীয় সরঞ্জাম পেতে দেরী হওয়ার ফলে ‘কে’ ফোর্স এবং ‘এস’ ফোর্স ব্রিগেড আকারে গঠন করতে বিলম্বিত হয়।
‘জেড’ ফোর্স: ৭ই জুলাই ১ নম্বর সেক্টরের নিয়মিত বাহিনীর (সামরিক বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও
আনসার বাহিনীর সদস্য) বিশেষ করে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১ম, ৩য় এবং ৮ম এই তিনটি ব্যাটালিয়ন নিয়ে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে প্রথম বিগ্রেড ফোর্স ‘জেড’ ফোর্স গঠন করা হয়। উল্লেখ্য যে, ১নং সেক্টর থেকে মেজর এ জে এম আমিনুল হক, বীর উত্তম-, ২নং সেক্টর থেকে মেজর শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রম এবং ৩নং সেক্টর থেকে মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী, বীর বিক্রমকে পদায়ন করে এ তিনটি ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার নিযুক্ত করা হয়। ‘জেড’ ফোর্সের ব্রিগেড সদর দপ্তর ছিল মোঘালয় রাজ্যের তুরা শহরের দশ কিলোমিটার উত্তরে তেলঢালায়। মেজর জিয়াউর রহমানকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি দিয়ে এ ফোর্সের ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ করা হয় এবং ব্রিগেড মেজরের দায়িত্ব দেয়া হয় ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, বীর বিক্রমকে। এ ফোর্সের সদর দপ্তরে অন্যান্য যে-সকল অফিসার দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা হলেন— ক্যাপ্টেন সাদেক হোসেন (ডি-কিউ) (DAA&QMG- Deputy Assistant Adjutant and Quarter Master General), ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম (সিগনাল অফিসার) এবং আব্দুল হাই মিয়া (মেডিকেল অফিসার)।
‘জেড’ ফোর্স ব্রিগেডের অধীন ইস্ট রেঙ্গল রেজিমেন্টের তিনটি ব্যাটালিয়নের দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা হলেন— ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়ন কমান্ডিং অফিসার মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী, বীর বিক্রম ; আগস্ট মাস থেকে মেজর মো. জিয়াউদ্দিন আহমেদ, বীর উত্তম। সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ বজলুল গণি পাটোয়ারী, বীর প্রতীক ; ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত আলী খান, এডজুট্যান্ট; লেফটেন্যান্ট মুজিবর রহমান ফকির, মেডিকেল অফিসার; শহীদ ক্যাপ্টেন মাহাবুবুর রহমান, বীর উত্তম, আলফা কোম্পানি কমান্ডার (৮ই ডিসেম্বর মাহাবুবুর রহমান শহীদ হলে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত আলী খান, বীর উত্তম এ কোম্পানির অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন); লেফটেন্যান্ট ওয়াকার হাসান, বীর প্রতীক, আলফা কোম্পানির অফিসার; লেফটেন্যান্ট আনিসুর রহমান, আলফা কোম্পানির অফিসার; ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম, কমান্ডার, ব্রাভো কোম্পানি; লেফটেন্যান্ট আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী, কমান্ডার, চার্লি কোম্পানি (কিছুকাল চার্লি কোম্পানির কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন লেফটেন্যান্ট এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী); ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ, বীর উত্তম, কমান্ডার, ডেল্টা কোম্পানি (৩১শে জুলাই সালাহউদ্দিন মমতাজ শহীদ হলে ডেল্টা কোম্পানির কমান্ডার দায়িত্ব পালন করেন মেজর বজলুল গনি পাটোয়ারী)।
৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়ন কমান্ডিং অফিসার মেজর শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রম; সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ক্যাপ্টেন মহসীন উদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম। তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়নের অন্যান্য অফিসারগণ হলেন— ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, বীর প্রতীক, আলফা কোম্পানির কমান্ডার; মেজর আকবর হোসেন, বীর প্রতীক, ব্রাভো কোম্পানির কমান্ডার; মেজর মহসীন উদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম, চার্লি কোম্পানির কমান্ডার; লেফটেন্যান্ট এস আই এম নূরুন্নবী খান, বীর বিক্রম, ডেল্টা কোম্পানির কমান্ডার; লেফটেন্যান্ট মঞ্জুর আহমেদ, বীর প্রতীক, এমএস (মিলিটারি সাপ্লাই) কোম্পানির কমান্ডার; লেফটেন্যান্ট ফজলে হোসেন, কোম্পানি অফিসার।
৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়ন কমান্ডিং অফিসার- মেজর এ জে এম আমিনুল হক, বীর উত্তম; সেকেন্ড-ইন- কমান্ড— ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী। এ ব্যাটালিয়নের অন্যান্য অফিসারগণ হলেন- মেজর খালেকুজ্জামান চৌধুরী, আলফা কোম্পানির কমান্ডার; মেজর আমিন আহমেদ চৌধুরী, বীর বিক্রম, ব্রাভো কোম্পানির কমান্ডার (আমিন আহমেদ চৌধুরী ৩রা আগস্ট আহত হলে এ কোম্পানির কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন ক্যাপ্টেম সাদেক হোসেন); লেফটেন্যান্ট মোদাসসের হোসেন খান, বীর প্রতীক, চার্লি কোম্পানির কমাণ্ডার; লেফটেন্যান্ট মাহবুব-উল-আলম, বীর প্রতীক, ডেল্টা কোম্পানির কমান্ডার। এছাড়াও ডেল্টা কোম্পানির অন্যান্য অফিসারগণ হলেন— শহীদ লেফটেন্যান্ট
এস এম ইমদাদুল হক, বীর উত্তম, লেফটেন্যান্ট মো. ওয়ালিউল ইসলাম, বীর প্রতীক, লেফটেন্যান্ট সৈয়দ মুনিবুর রহমান ও লেফটেন্যান্ট কে এম আবু বকর। ‘জেড’ ফোর্স চিলমারী, বাহাদুরাবাদ ঘাট, কামালপুর, টেংরাটিলা, লাতু, নকশী বিওপি, গবিন্দগঞ্জ, বড়লেখা, হাজীপাড়া এবং আরো অনেক স্থানে সম্মুখ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করে।
‘কে’ ফোর্স: সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে ‘কে’ ফোর্স গঠনের নির্দেশ পেয়ে মেজর খালেদ মোশাররফ ২নং সেক্টরের নিয়মিত বাহিনী পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পুনর্গঠন করে আরো দুটি ব্যাটালিয়ন ৯ম ও ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করা হয়। মূল ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চার্লি কোম্পানি এবং ২নং সেক্টরের কিছু অভিজ্ঞ সৈন্য নিয়ে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পুনর্গঠন করা হয়। মূল ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানি এবং ব্রাভো কোম্পানির কিছু সৈন্য নিয়ে ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করা হয়। ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানি ও ব্রাভো কোম্পানির অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করা হয়।
১৪ই অক্টোবর সৈন্যদের পুনর্গঠনের কাজ শেষ করে ২নং সেক্টরের নিয়মিত বাহিনীর ৪র্থ, ৯ম ও ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এ তিনটি ব্যাটালিয়নের সমন্বয়ে মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ‘কে’-ফোর্স (খালেদ ফোর্স) গঠন করা হয়। ‘কে’-ফোর্সের বিগ্রেড সদর দপ্তর ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায়। মেজর খালেদ কর্নেল পদে পদোন্নতি দিয়ে এ ফোর্সের ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ করা হয়। খালেদ মোশাররফ ‘কে’-ফোর্সের দায়িত্ব নেয়ার পর ২নং সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর এ টি এম হায়দার, বীর উত্তম কে। সেপ্টেম্বর মাসের ২১ তারিখ খালেদ মোশাররফ কসবার কাছে কমলাসাগরে কপালে স্প্লিন্টারের আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হলে ভারপ্রাপ্ত অফিসার হিসেবে ‘কে’-ফোর্সের দায়িত্ব পালন করেন মেজর আব্দুস সালেক চৌধুরী, বীর উত্তম-। ‘কে’- ফোর্সের সদর দপ্তরে যে-সকল অফিসার দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা হলেন— মেজর মো. আব্দুল মতিন, বীর প্রতীক, বিগ্রেড মেজর; ক্যাপ্টেম আব্দুল খালেক মোল্লা, কিউ; ক্যাপ্টেম শহিদুল ইসলাম, সিগন্যাল অফিসার এবং ক্যাপ্টেন আখতার আহমেদ, মেডিকেল অফিসার।
৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আব্দুল গাফফার হালদার, বীর উত্তম, সেকেন্ড-ইন-কমান্ড লেফটেন্যান্ট ফজলুল হক। এ ব্যাটালিয়নের অন্যান্য অফিসারগণ হলেন- লেফটেন্যান্ট মমতাজ হাসান, বীর প্রতীক, কমান্ডার, আলফা কোম্পানি; লেফটেন্যান্ট ফজলুর রহমান, কমান্ডার, ব্রাভো কোম্পানি; লেফটেন্যান্ট মোস্তাফা কামাল হাসমি, কমান্ডার, চার্লি কোম্পানি এবং লেফটেন্যান্ট জামিল উদ্দিন আহসান, কমান্ডার, ডেল্টা কোম্পানি।
৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আইনউদ্দিন, বীর বিক্রম; সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ক্যাপ্টেন এম আশরাফ হোসেন। নবম ব্যাটালিয়নের অন্যান্য সামরিক অফিসাররা হলেন- লেফটেন্যান্ট এম হারুন-উর রশীদ, বীর প্রতীক, আলফা কোম্পানির কমাণ্ডার; ক্যাপ্টেন এম আশরাফ হোসেন, ব্রাভো কোম্পানির কমান্ডার; লেফটেন্যান্ট খন্দকার আজিজুল ইসলাম, চার্লি কোম্পানির কমান্ডার এবং লেফটেন্যান্ট শাহরিয়ার হুদা, ডেল্টা কোম্পানির কমান্ডার।
১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম, বীর বিক্রম, সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ক্যাপ্টেন শহীদুল ইসলাম। এ ব্যাটালিয়নের অন্যান্য অফিসারগণ হলেন- লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামান, আলফা কোম্পানির কমান্ডার; লেফটেন্যান্ট সৈয়দ মিজানুর রহমান, ব্রাভো কোম্পানির কমান্ডার; লেফটেন্যান্ট দীদার আনোয়ার হোসেন, চার্লি কোম্পানির কমান্ডার; লেফটেন্যান্ট মোখলেছুর রহমান, ডেল্টা কোম্পানির কমান্ডার। ‘কে’-ফোর্স বীরত্বের সঙ্গে বিলোনিয়া, মন্দাভোগ, সালদা নদী ও কোনাবন এলাকায় বারবার শত্রুসেনাদের পর্যুদস্ত করে। এছাড়াও এ ব্রিগেডের মুক্তিযোদ্ধারা কসবা, কলাছড়া চা বাগান, লাটুমুড়া, নয়নপুর, মিয়াবাজার এবং অন্যান্য স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে বীরত্বের পরিচয় দেয়। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় খালেদ মোশাররফ তাঁর ব্রিগেডসহ ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন।
‘এস’ ফোর্স: অক্টোবর মাসে ৩নং সেক্টরের অধীন ২য় এবং ১১শ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নিয়মিত বাহিনীর দুটি ব্যাটালিয়ন নিয়ে ‘এস’-ফোর্স ব্রিগেড গঠন করা হয়। উল্লেখ্য যে, এ সেক্টরের নিয়মিত বাহিনীর কিছু সদস্য এবং ২য় ইস্ট রেজিমেন্টের পুরনো সৈনিকদের থেকে নির্বাচন করে সেপ্টেম্বর মাসে ১১শ ব্যাটালিয়ন গঠন করা হয়। এ ব্রিগেডের সদর দপ্তর ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের হাজামারায়। মেজর কে এম সফিউল্লাহকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি দিয়ে এ ফোর্সের ব্রিগেড কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয়। ‘এস’-ফোর্স গঠনের পর ৩নং সেক্টরকে নতুন করে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়। কে এম সফিউল্লাহ ‘এস’-ফোর্সের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর ৩নং সেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর কাজী নূরুজ্জামান, বীর উত্তম-কে। ‘এস’-ফোর্সের ব্রিগেড মেজরের দায়িত্ব দেয়া হয় ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আজিজুর রহমান, বীর উত্তম-কে। এ ব্রিগেডের সদর দপ্তরে কর্মরত অন্যান্য অফিসারগণ হলেন— ক্যাপ্টেন আবুল হোসেন, ডি কিউ; ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আব্দুর রউফ, সিগন্যাল অফিসার এবং ক্যাপ্টেন মোকতার কামাল চৌধুরী, মেডিকেল অফিসার। ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী, বীর বিক্রম এবং সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মেজর মতিউর রহমান, বীর বিক্রম। এ রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়নের অন্যান্য অফিসারগণ হলেন- লেফটেন্যান্ট সায়ীদ আহমেদ, বীর প্রতীক, এডজুট্যান্ট; লেফটেন্যান্ট আবুল হোসেন, মেডিকেল অফিসার; মেজর মতিউর রহমান, আলফা কোম্পানির কমান্ডার; লেফটেন্যান্ট আনিসুল হাসান, আলফা কোম্পানির অফিসার; শহীদ লেফটেন্যান্ট ইবনে ফজল বদিউজ্জামান, বীর প্রতীক, ব্রাভো কোম্পানির কমান্ডার (৫ই নভেম্বর লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামান শহীদ হলে ব্রাভো কোম্পানি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন শহীদ লেফটেন্যান্ট সেলিম কামরুল হাসান (৩০শে জানুয়ারি ১৯৭২ শহীদ); লেফটেন্যান্ট সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহীম, বীর প্রতীক, চার্লি কোম্পানির কমান্ডার; ক্যাপ্টেন গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান, বীর বিক্রম, ডেল্টা কোম্পানির কমান্ডার।
১১শ ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন ক্যাপ্টেন আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম, বীর বিক্রম। তবে নভেম্বর মাসে মেজর নাসিম আহত হলে এ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর মতিনকে। এ ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড-ইন-কমান্ডের দায়িত্ব দেয়া হয় ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়াকে। এ ব্যাটালিয়নের অধীনেও আলফা, ব্রাভো, চার্লি ও ডেল্টা নামে চারটি কোম্পানি ছিল, যার কমান্ডার ছিলেন নিময়মিত বাহিনীর অফিসারগণ। ১১শ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়নের অন্যান্য অফিসারগণ হলেন— ক্যাপ্টেন মঈন উদ্দিন আহমেদ, মেডিকেল অফিসার; লেফটেন্যান্ট আব্দুর রহমান, মেডিকেল অফিসার; লেফটেন্যান্ট শামসুল হুদা বাচ্চু, আলফা কোম্পানির কমান্ডার; মেজর সুবিদ আলী ভূঁইয়া, ব্রাভো কোম্পানির কমান্ডার; লেফটেন্যান্ট মো. নজরুল ইসলাম, বীর প্রতীক, চার্লি কোম্পানির কমান্ডার; লেফটেন্যান্ট নাছির উদ্দিন, ডেল্টা কোম্পানির কমান্ডার; লেফটেন্যান্ট আবুল হোসেন, কোম্পানি অফিসার। ‘এস’-ফোর্স পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তেলিয়াপাড়া, আখাউড়া, ধর্মগড় ও মুকুন্দপুর যুদ্ধে কৃতিত্ব প্রদর্শন করে।
২১শে নভেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকারের যৌথ সিদ্ধান্তে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ কমান্ড গঠন করা হয়। যৌথ কমান্ড পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। যৌথ কমান্ড পরিচালনার সুবিধার জন্য মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টর ও ৩টি ব্রিগেড ফোর্সকে পুনর্বিন্যস্ত করে মোট ৪টি যুদ্ধাঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। মুক্তিবাহিনীর ১১টি সেক্টরসহ নিয়মিত বাহিনীর ৩টি ব্রিগেডকে এ ৪টি অঞ্চলের যৌথ কমান্ডে সমন্বিত করা হয়। চূড়ান্ত অভিযানে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর তিনটি ব্রিগেড ফোর্সকে পাকিস্তানি শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণের জন্য বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত হয়। এ উদ্দেশ্যে অক্টোবর মাসের ১ম সপ্তাহে ‘জেড’ ফোর্স- কে তেলঢালা থেকে সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায় স্থানান্তরিত করা হয়। সিলেটের উত্তর সীমান্ত থেকে দক্ষিণে রাঙ্গামাটি ও কাপ্তাই এলাকা বাদে গোটা বৃহত্তর চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের দায়িত্বে থাকা ভারতীয় মিত্রবাহিনী-র ৮, ৫৭ ও ২৩ মাউন্টেন ডিভিশন নিয়ে গঠিত ৪ কোর-এর অধীনে তিনটি ব্রিগেডের এক-একটি ব্রিগেডকে এক-একটি ডিভিশনে ন্যস্ত করা হয়। সেমতে ৮ মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনে ‘জেড’-ফোর্স ব্রিগেড, ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনে ‘এস’-ফোর্স ব্রিগেড এবং ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনে ‘কে’ ফোর্স ব্রিগেড ন্যস্ত করা হয়। যৌথ কমান্ডের অধীনে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে এ তিনটি ব্রিগেড ফোর্স চূড়ান্ত বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে পাকিস্তানি বাহিনীকে সম্পূর্ণ পরাভূত করে। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী যৌথ বাহিনীর অংশ হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ৩রা ডিসেম্বর থেকে, যখন পাকিস্তান ও ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ৩রা ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত নিয়মিত বাহিনী এবং গণবাহিনী সামগ্রিকভাবে মুক্তিবাহিনী পরিচয়ে সমন্বিত পরিকল্পনামতে ১১টি সেক্টর ও ৩টি ব্রিগেড থেকে অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত থাকে। ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন হওয়া পর্যন্ত এ যৌথ কমান্ড কার্যকর ছিল। [সাজাহান মিয়া]
তথ্যসূত্র: হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পা.), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : ৩য় খণ্ড মুজিব নগর : প্রশাসন, তথ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ১৯৮২; এ এস এম সামসুল আরেফিন, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান, সময় প্রকাশন ২০১২; বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ৫ম খণ্ড, সম্পাদনা এরিয়া সদর দপ্তর, রংপুর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ২০০৮; এম আর আখতার মুকুল, আমি বিজয় দেখেছি, অনন্যা, প্রথম প্রকাশ ১৯৮৫; মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (সম্পা.), ২নং সেক্টর এবং কে ফোর্স কমান্ডার খালেদের কথা, সেন্টার ফর বাংলদেশ লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজ, ২০০৮; KM Safiullah, Bangladesh at War, Agamee Prakashani 2005

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!