বোরারচর যুদ্ধ (ময়মনসিংহ সদর)
বোরারচর যুদ্ধ (ময়মনসিংহ সদর) ২৮শে নভেম্বর সংঘটিত হয়। দুই পর্যায়ের এ-যুদ্ধে ৭০ জন হানাদার পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং ১২ জন আত্মসমর্পণ করে যুদ্ধে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার একটি গ্রাম বোরারচর। ১১ নম্বর সেক্টরের ঢালু সাব-সেক্টর কমান্ডার লে. আবু তাহের আহমেদ ৬৪ জনের একটি দল নিয়ে বোরারচর গ্রামে হাইড-আউট করেন। স্থানীয় দালালরা মুক্তিযোদ্ধাদের হাইড-আউটের খবর কোতোয়ালি থানার ওসি আবুল হোসেনকে জানায়। ২৮শে নভেম্বর পুলিশ ও পাকসেনাদের একটি বড় দল মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। পাকসেনাদের উপস্থিতি পূর্বেই বুঝতে পেরে লে. তাহের দলের সবাইকে প্রস্তুত করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে ব্রহ্মপুত্র নদ আর নদের দক্ষিণে বেগুনবাড়ি রেলস্টেশন। দক্ষিণ দিক থেকে নদ পাড় হয়ে পাকসেনারা প্রথমে ফাঁকা গুলি ছুড়লে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে শত্রুদের অবস্থান বোঝা সম্ভব হয়। দুপক্ষের মাঝখানে ছিল উঁচু একটি মাটির রাস্তা। মুক্তিযোদ্ধারা হাইড-আউট থেকে বের হয়ে রাস্তার উত্তর দিকে পজিশন নেন। ফলে খোলা মাঠে আক্রান্ত হয়ে প্রথম ধাপে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক সৈন্য প্রাণ হারায়। অন্যরা বালুমাটিতে গর্ত করে সেখানে পজিশন নিতে সক্ষম হয়। এভাবে যুদ্ধ চলে ভোর থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত পুলিশ ও পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গ্রামে আশ্রয় নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা কৌশল পরিবর্তন করে উত্তর দিকে গিয়ে পজিশন শক্ত করে এম্বুশ করেন।
হাইড-আউটে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রামবাসী প্রতিদিন মানুষের বাড়ি থেকে খাবার দিতেন। সেদিন খাবার দিতে আসা লোকজনের সঙ্গে নদে গোদারা চালায় এমন একটি ছেলে লে. তাহেরকে এসে জানায় যে, পাকসেনারা গ্রামের পশ্চিম পাড়ায় একত্রিত হয়ে আছে। তারা তার নৌকায় নদ পার হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করতে পারে। তখন লে. তাহের সিদ্ধান্ত নেন যে, যদি পাকসেনারা নৌকায় নদ পার হয়ে তাঁদের দিকে অগ্রসর হয় তাহলে তাদের নদের মধ্যখানে আক্রমণ করা হবে। নদের মাঝখানে আসামাত্র ফাঁকা গুলি করলে নৌকার মাঝিরা সাঁতরে নিরাপদ স্থানে চলে যাবে। তখন মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুদের ওপর গুলিবর্ষণ করবেন। পরিকল্পনামতো সব কাজ চলে। পাকসেনারা নৌকায় করে অগ্রসর হলে ইপিআর-এর সিপাহি মো. ইদ্রীস (বরিশাল) তাঁর এলএমজি থেকে নৌকা লক্ষ করে ব্রাশফায়ার করেন। আক্রান্ত হয়ে পাকসেনারা পানিতে হাবুডুবু খেতে থাকে। গ্রামের মানুষ পানিতে নেমে তাদের ধরে ফেলে। মহিলারা দা, লাঠি, খন্তা, বল্লম হাতে পুরুষের সঙ্গে জনযুদ্ধএ লিপ্ত হয়। জনতার হাতে অনেক পাকসেনা নিহত হয়। থানার ওসি ও ১২ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে। সেদিন বোরারচরে দুবারে ৭০ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শত্রুদের গুলিতে শহীদ হন। এ-যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য লে. আবু তাহের আহমেদ ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত হন। [বিমল পাল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড