You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.17 | ব্যাটেল অব শিরোমনি (ফুলতলা, খুলনা) - সংগ্রামের নোটবুক

ব্যাটেল অব শিরোমনি (ফুলতলা, খুলনা)

ব্যাটেল অব শিরোমনি (ফুলতলা, খুলনা) সংঘটিত হয় ১৭ই ডিসেম্বর। ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকহানাদার বাহিনীর ভয়াবহ এ-যুদ্ধে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
ডিসেম্বরের শুরু থেকেই বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরাজিত হতে থাকে। ৩রা ডিসেম্বর পাকবাহিনী ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ৬ই ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। মিত্ররাষ্ট্র হিসেবে ভারত বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর সহযোগিতায় এক বিশাল বাহিনী বাংলাদেশে প্রেরণ করে, যা মিত্রবাহিনী নামে পরিচিত। সীমান্তের চতুর্দিকে দিয়ে এ বাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করে। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে দখলদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
যশোরে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যান্টনমেন্টে প্রচুর অস্ত্র শস্ত্র ও গোলাবারুদ সংরক্ষিত ছিল। যশোর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বিভিন্ন স্থানে প্রবল প্রতিরোধ এবং কোনো-কোনো স্থানে পরাজয়ের কারণে একটি নতুন কৌশল অবলম্বন করে। শিরোমনি ও আটরা গিলাতলা এলাকাটি খুলনা শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। এটি উত্তর দিক থেকে শহরের একটি প্রবেশদ্বার। এ স্থানকে পাকসেনারা বিকল্প ঘাঁটি হিসেবে গোপনে প্রস্তুত করে। যুদ্ধের দিক থেকে এলাকাটির কৌশলগত খুব গুরুত্ব ছিল। বিল ডাকাতিয়ার পূর্ব প্রান্ত শিরোমনি এলাকা, যার পরেই বর্তমান জাহানাবাদ ক্যান্টনমেন্ট। ক্যান্টনমেন্টের সঙ্গে লাগোয়া রেললাইন, যা উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত। খুলনা-যশোর রেললাইন থেকে স্থানটির ব্যবধান মাত্র ১০০ গজ। খুলনা-যশোর রোডের শিরোমনি ও আটরা শিল্প এলাকার পূর্ব পাশে মাত্র ৫০০ গজ দুরে ভৈরব নদী প্রবাহিত। শিরোমনি এলাকায় রেল, জল ও স্থল এ তিন ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল এবং তা পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকায় মুক্তিবাহিনীর এ এলাকায় প্রবেশ খুবই দুরূহ ছিল। কার্যত শিরোমনি এলাকাকে যশোর ক্যান্টনমেন্টের সেনাপ্রধান দ্বিতীয় ঘাঁটি হিসেবে তৈরি করে। ৯ই ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সুরক্ষিত যশোর সেনানিবাস ত্যাগ করে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। একদল ফরিদপুরের দিকে, অন্যটি পাকশীর পথে পদ্মা পার হয়ে পাবনার দিকে এবং বাকি দলটি ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানের নেতৃত্বে খুলনার দিকে যায়। হায়াত খান তার ১০৭ ব্রিগেডকে খুলনার শিরোমনিতে এনে সুরক্ষিত ডিফেন্স লাইন গড়ে তোলে। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই যে পাকিস্তানি বাহিনীর পতন হবে এটা হায়াত খানের ধারণার বাইরে ছিল। খুলনায় ছিল বিহারি জনগোষ্ঠীর শক্ত অবস্থান। হায়াত খান ভেবেছিল কিছুদিন যুদ্ধটা প্রলম্বিত হলে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের সহায়তায় তিনি আত্মসমর্পণ বা পরাজয় এড়িয়ে নিরাপদে সরে যেতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবতা তার অনুমানের মধ্যে ছিল না। যশোর সেনানিবাস দখল করার পর যৌথ বাহিনীর একটি অংশ খুলনার দিকে চলে আসে। অন্য একটি দল যারা নাভারন কলারোয়া দিয়ে এগোচ্ছিল, তারাও খুলনার উপকণ্ঠে চলে আসে। এ দলের একাংশ শাহপুর-জামিরা দিয়ে ফুলতলা গাড়াখোলায় চলে আসে। অপর অংশ মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা সহায়তায় শৈলগাতি-দৌলতপুর সড়ক হয়ে শলুয়ার এক মাইল পশ্চিমে ঘাঁটি গাড়ে। যুগপদভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের আরো দুটি সুসজ্জিত দল খুলনা শহরের দক্ষিণ ও দক্ষিণ- পশ্চিমে শক্ত অবস্থান নেয়। তাই হায়াত খানের পক্ষে খুলনা শহরের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে বের হয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।
হায়াত খান সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ সমর্থনপুষ্ট তার ব্রিগেডকে খুলনা শহরের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম এলাকা জুড়ে অবস্থান নিতে নির্দেশ দেয়। তার কমান্ডের লক্ষ্য ছিল ভারতীয় ও বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখা। ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানের এ কৌশল প্রথমদিকে ভালই কাজ করে। তার “নেতৃত্বে পুরো শিরোমনি এলাকা জুড়ে তিন স্তর প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করা হয়। অগ্রগামী অংশে পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে শেরম্যান ট্যাংক সজ্জিত সাঁজোয়া বাহিনী ছিল। দৌলতপুরে অবস্থানরত গোলন্দাজ বাহিনী পুরোপুরিভাবে রণকৌশলে সজ্জিত ছিল। এখান থেকে অবিরামভাবে মিত্রবাহিনীর অবস্থানের ওপর মর্টার নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল। আটরা থেকে শিরোমনি পর্যন্ত যশোর রোডে পাকবাহিনী ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন পুঁতে রাখে। এ সবকিছুই তারা করে অসম্ভব ক্ষিপ্রতা ও পেশাদারি পারদর্শিতার সঙ্গে। সবকিছু ঠিকঠাক করে পাকবাহিনী ডিফেন্স লাইনে সতর্ক অবস্থান নেয়। মিত্রবাহিনী ফুলতলা ও পথের বাজারের কবরস্থান থেকে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করে, তবে শত্রুর কাছ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। গাড়াখোলা গ্রাম থেকে মর্টার শেল নিক্ষেপ করেও অনুরূপ কোনো প্রত্যুত্তর পায়নি।
১৩ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর ৩০-৩৫টি গাড়ির এক বিরাট বহর মেজর গনি ও মেজর মহেন্দ্র সিংহের নেতৃত্বে যশোর রোড হয়ে শিরোমনিতে ঢুকে পড়ে। তাদের ধারণা ছিল পাকবাহিনী পশ্চাদপসরণ করে খুলনা শহরে চলে গেছে। কিন্তু তা ছিল সম্পূর্ণ ভুল। যখন এই কনভয় ইস্টার্ন, আলীম, আফিল জুট মিলস্ অতিক্রম করে বাদামতলা বর্তমান চক্ষু হাসপাতালের নিকট পৌঁছায়, তখন পাকসেনাদের ভারী কামানগুলো একযোগে গর্জে ওঠে। এ অবস্থায় মিত্রবাহিনীর কনভয় সামনে-পেছনে কোথাও যেতে পারেনি। পাকসেনাদের প্রচণ্ড আক্রমণে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। এমনকি সামান্য প্রতিরোধ বা নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সুযোগও তারা পায়নি। এখানে ২৫০-৩০০ জন ভারতীয় সৈন্য শহীদ হন। তাঁদের বিরাট কনভয় পাকসেনাদের হামলায় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। ভারতীয় বাহিনীর জন্য এটি ছিল প্রচণ্ড রকমের আঘাত। ৮নং সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুর মিত্রবাহিনীর যুদ্ধের এ কৌশলটিকে সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নিতে পারেননি। তিনি যশোর সেনানিবাসে অবস্থিত সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সে মেজর জেনারেল দলবীর সিং-এর কাছে শিরোমনি এলাকায় অবস্থানরত মিত্রবাহিনীর অধিনায়কত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত করার অনুরোধ জানান। কিন্তু তাঁর র্যাংক (মেজর) একটি যুদ্ধরত আর্মড্ ফোর্সের কর্তৃত্ব নেয়ার উপযুক্ত না হওয়ায় জেনারেল সিং ইতঃস্তত করছিলেন। কিন্তু মেজর মঞ্জুরের যোগ্যতায় তাঁর বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। জেনারেল সিং ফোর্ট উইলিয়াম-এ ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার্সকে বিষয়টি অবহিত করেন এবং সেখান থেকে অনুমতি নেন। মুহূর্তেই বিষয়টি ফুলতলায় অবস্থানরত মিত্রবাহিনীর কমান্ডকে জানানো হয়। মেজর মঞ্জুর সাব- সেক্টর কমান্ডার মেজর হুদাকে সঙ্গে নিয়ে আক্রমণ কৌশল তৈরি করেন। ৯নং সেক্টরে যুদ্ধরত মেজর জয়নাল আবেদীনকে খুলনা শহরের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিক, যেখানে শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধরত ছিলেন, তাদের সেখানে আক্রমণ তীব্র করার পরামর্শ দেন। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা রূপসা-বটিয়াঘাটা-গল্লামারী বরাবর আক্রমণ তীব্র করে তোলেন। দৌলতপুর-শোলগাতি সড়কে অবস্থানরত ভারতীয় বাহিনীকে শলুয়া সুইজ গেটের পূর্বপাশে অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর গোলন্দাজ আক্রমণের নির্দেশ দেন। ফলে খুলনা শহরের দক্ষিণ-পূর্ব থেকে দক্ষিণ দিক হয়ে পশ্চিম দিক দিয়ে শত্রুবাহিনীকে ঘেরাও করেন। বাকি থাকে উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব দিক। আটরা শিল্প এলাকায় প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির পর যৌথবাহিনীর একটি কলাম ইস্টার্ন জুট মিলস্-এর পাশ দিয়ে ভৈরব নদী পেরিয়ে নদীর পূর্ব তীর বরাবর সৈন্য মোতায়েন করে। এখানে মিত্রবাহিনীর গোলন্দাজ ইউনিট অবস্থান নেয় যাতে শিরোমনিতে শত্রুর প্রতিরক্ষা পজিশনে মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করতে পারে। একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় দল ভারতীয় পদাতিক ইউনিটের সঙ্গে এমনভাবে প্রস্তুত থাকে যাতে যে-কোনো সময়ে আদেশ পেলে দেশীয় নৌযানে নদীর পশ্চিম পাড়ে তাঁরা চলে যেতে পারেন।
ব্রিগেডিয়ার হায়াতের বাহিনী শিরোমনি ক্ষুদ্র শিল্পনগরীর (বর্তমান বিসিক শিল্প নগরী) বিভিন্ন পাকা ভবন ঘিরে সুরক্ষিত বাঙ্কারে ভারী অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয় এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন পয়েন্টে সাঁজোয়া বাহিনী নিয়ে সজ্জিত থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে পাকবাহিনীকে পরাস্ত করার একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়ায় আকাশপথে বিমান থেকে গোলা বর্ষণ। কিন্তু আকাশ থেকে সহায়তা পাওয়া সুনিশ্চিত ছিল না। খুলনার যুদ্ধক্ষেত্রে ভারতীয় জঙ্গীবিমানের আক্রমণ পরিচালিত হয় মূলত গোলকুণ্ডা বিমানঘাঁটি এবং বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ভারতীয় বিমানবাহী জাহাজ ‘বিক্রান্ত’ থেকে। ডিসেম্বরে ভোররাতের আকাশ থাকে কুয়াশাচ্ছন্ন। ফলে আলো না ফুটলে বিমান আক্রমণ সম্ভব হতো না। এসব প্রতিকূল পরিস্থিতি মাথায় রেখেই মেজর মঞ্জুরকে আক্রমণের ছক তৈরি করতে হয়। সময়ও ছিল অত্যন্ত কম। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অপারেশন শেষ করতে হবে। ভারতীয় সাঁজোয়া বাহিনীকে সামনে রেখে পদাতিক বাহিনীকে তিনি সহায়ক হিসেবে রাখেন। শিরোমনি ক্ষুদ্র শিল্পনগরীতে কোনো-কোনো পয়েন্টে শত্রুর ডিফেন্স পজিশন এবং ফায়ার করার সামর্থ কেমন সেসব তথ্য স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে তিনি আগেই সংগ্রহ করেন। তারপর ট্যাংক বহর প্রস্তুত করে প্রতিটি মুভিং ট্যাঙ্ক- এর আড়ালে এক সেকশন করে মুক্তিযোদ্ধার ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র দল নিয়োজিত করেন। শেষ রাতে নির্ধারিত সময়ে ট্যাঙ্ক বহরের একটি কলামকে পূর্ব দিকের ছোট-ছোট পথ বেয়ে ক্ষুদ্র শিল্পনগরীর মধ্যে এবং ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রিজ-এর দিকে পাঠিয়ে দেন। অন্য বহরটি যশোর রোডের মূল সড়ক আড়ালে রেখে রাস্তার পূর্ব পাশের নিচু বরাবর একই পদ্ধতিতে দক্ষিণে শত্রুর শক্তিশালী অবস্থানের দিকে এগুতে থাকে। ট্যাংকগুলোর ভেতরে ভারতীয় নিয়মিত বাহিনী আর বাইরে জীবন উৎসর্গের ঝুঁকি নিয়ে অদম্য মুক্তিযোদ্ধা দলের অবস্থান। স্বল্প সময়ের মধ্যে শুরু হয় বিধ্বংসী আক্রমণ। এবার পরাজিত হয় ব্রিগেডিয়ার হায়াতের বাহিনী। পাকিস্তানি সেনাদলকে তাদের শেষ যুদ্ধে অসংখ্য সহযোদ্ধাকে হারাতে হয়। যুদ্ধময়দাে বাস্তবতার নিরিখে তৈরি করা মেজর মঞ্জুরের রণকৌশল একাধারে যেমন ছিল ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি ছিল অভিনব। ঝুঁকি ছিল এজন্য যে, শত্রুর রিকয়েললেস রাইফেল বা অন্য কোনো ভারী গোলার আঘাতে যদি কোনো ট্যাঙ্কের গতি রুদ্ধ হয়ে যেত তাহলে ট্যাঙ্ককে আড়ালে রেখে এগিয়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে আর বেঁচে থাকা সম্ভব হতো না। দ্বিতীয়ত পুরো আক্রমণটি ছিল ‘ব্লিটজক্রিগ’ বা অত্যন্ত ‘ক্যালকুলেটেড টাইম ফ্রেম’, যা শুধুমাত্র বিজয়কে হিসেবে রেখে করতে হয়। তাই সামান্য স্খলন তাদের জন্য চরম পরিণতি ডেকে আনতে পারত। তৃতীয়ত একটি ঘনবসতিপূর্ণ নগর এলাকা যেখানে অসংখ্য পাকা স্থাপনায় শত্রুর অবস্থান এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে শত্রুর পক্ষে জায়গা পরিবর্তন করে আক্রমণকারীদের ফাঁদে ফেলানো সম্ভব, এমনি একটি যুদ্ধক্ষেত্রে সাঁজোয়া বাহিনীকে মূল ভূমিকায় রেখে পদাতিক আক্রমণের ছক তৈরি করা কঠিন ছিল। তবে শেষ কথা হলো, মেজর মঞ্জুর এটি সম্পূর্ণ সফলভাবে করে দেখিয়েছেন এবং প্রায় শূন্য ক্যাজুয়ালটিতে যুদ্ধ সমাপ্ত হয়।
১৭ই ডিসেম্বর সকালের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরোধ ব্যূহ ভেঙ্গে যায়। প্রতিপক্ষের দিকে গোলা নিক্ষেপ শুরু হলে যৌথবাহিনী শিরোমনির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। তাঁরা একের পর এক পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের ধরে তাদের ব্যাজ ও ইউনিফরম খুলে নিয়ে এক জায়গায় জড়ো করতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু এ সময় ঘটে আর এক ঘটনা। পাকিস্তানি সেনাদের অনেকে ব্যাজ ও ইউনিফরম খুলে নিতে বাধা দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে শুরু হয় হাতাহাতি লড়াই। অনেকক্ষণ হাতাহাতি লড়াই চলার পর পাকবাহিনীর সদস্যরা নতি স্বীকার করে। ব্যাজ ও ইউনিফরম খুলে নেয়ার সময় পাকসেনাদের অনেকে কাঁদতে থাকে। এ সময় তাদের কয়েকজন নিজেদের অস্ত্র দিয়ে আত্মহত্যা করে। অতঃপর গোটা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে তাদেরকে খুলনা সার্কিট হাউস মাঠে আনা হয়। ১৭ই ডিসেম্বর খুলনা শহরে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণে সম্মতির কথা ঘোষণা করে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিশাল ক্যানভাস অসংখ্য গৌরবগাঁথায় সমৃদ্ধ। এ-সবের মধ্যে শিরোমনি যুদ্ধের ঘটনা নিঃসন্দেহে প্রথম সারিতে। উভয় পক্ষে এ-যুদ্ধের ক্ষয়-ক্ষতি ছিল অনেক। পাকিস্তানিদের জন্য এটা ছিল এমন এক সম্মুখ সমর যখন তাদের কোনো এয়ার সাপোর্ট ছিল না, সাপ্লাই লাইন ছিল অরক্ষিত, পার্শ্ববর্তী জনপদ বৈরী, চেইন-অব কমান্ড ছিন্ন-ভিন্ন। এ পরিস্থিতিতে তারা প্রতিরোধ ব্যূহ গড়ে তুলে প্রথম দিকে যৌথ বাহিনীর অগ্রযাত্রা রুখে দেয়। অপরদিকে প্রায় বিনা বাধায় যশোর ক্যান্টনমেন্টের মতো একটি সুরক্ষিত সেনা ছাউনি দখল করেও যৌথ বাহিনীকে শিরোমনিতে এসে শুধু থমকে দাঁড়াতে হয়নি, প্রচণ্ড ক্ষয়- ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। আর তাই যুদ্ধের সব প্রচলিত কৌশল ত্যাগ করে মিত্রবাহিনীকে নতুন রণকৌশল তৈরি করতে হয় এমন এক বাহিনীর বিরুদ্ধে, যারা তাদের প্রধান সেনাপতির আত্মসমর্পণের আদেশ অমান্য করে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। এ ক্ষেত্রে সমর নায়ক হিসেবে মেজর মঞ্জুর শুধু সফলতার পরিচয়ই দেননি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ সম্মুখ সমরে নেতৃত্ব দিয়ে মাতৃভূমির বিজয় মুকুটে শেষ পালকটি গেঁথে দেয়ার গৌরব অর্জন করেন। এ যুদ্ধের কৌশল ভারত ও পোলান্ডসহ বহু দেশের সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা কলেজে পাঠদান করা হয়। ফুলতলায় শিরোমনি যুদ্ধের একটি স্মৃতিফলক এবং একটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। [পারভীন সুলতানা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড