You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ, হাউজ অব কমন্স-এ লেবার পার্টির এমপি ব্রুস ডগলাস-ম্যান

ব্রুস ডগলাস-ম্যান (১৯২৭-২০০০) ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ, হাউজ অব কমন্স-এ লেবার পার্টির এমপি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই এর একনিষ্ঠ সমর্থক, Justice for East Bengal সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশ প্রশ্নে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সরবকণ্ঠ, বাংলাদেশ সংকটের ওপর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একাধিক বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতির অন্যতম প্রবক্তা, ব্রিটেনে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে বিশিষ্ট ভূমিকা পালনকারী এবং বাংলাদেশের শরণার্থী ও বাংলাদেশ সংকট সম্বন্ধে অক্সফাম থেকে প্রকাশিত (২১শে অক্টোবর ১৯৭১) The Testimony of Sixty ডকুমেন্টে অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গের অন্যতম। তিনি ১৯২৭ সালের ২৩শে জুন যুক্তরাজ্যের সাসেক্সের বেক্সহিলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম লেজলি জন ডগলাস-ম্যান। পিতা ছিলেন আইনজীবী। তিনি কানাডার টরেন্টো থেকে কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা শেষে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখানে উচ্চতর শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করেন এবং তখন থেকে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। লেবার পার্টিতে যোগদানের পর সর্বপ্রথম ১৯৭০ সালে তিনি পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ আন্দোলনের পক্ষে ১৮ই এপ্রিল লন্ডনে ব্রুস ডগলাস-ম্যান Justice for East Bengal নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। পরের দিন ১৯শে এপ্রিল সাবেক ব্রিটিশ মন্ত্রী জন স্টোনহাউজের সঙ্গে তিনি ভারতে আশ্রিত বাঙালি শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে যান। ২৩শে এপ্রিল কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে ব্রিটিশ সরকার ও অন্যান্য দেশের প্রতি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ আরোপের আহ্বান জানিয়ে ব্রুস ডগলাস-ম্যান বলেন (বঙ্গানুবাদ), ‘ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় সেদেশে মার্কিন সেনাদের কর্তৃক মাইলাইতে যে অমানুষিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল, পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বহু স্থানে প্রতিনিয়ত সেরূপ ঘটনা ঘটছে। ২৪শে এপ্রিল তাঁরা ভারত সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্ত অঞ্চলে প্রবেশ করেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের একটি শিবিরে বাংলাদেশ সরকার-এর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ-এর সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ হয়। সফর শেষে লন্ডন প্রত্যাবর্তন করে সাংবাদিকদের সঙ্গে ‘পূর্ব বাংলার সংকট পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার নয়’ বলে তিনি স্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত করেন। তাঁর উদ্যোগে পূর্ব বাংলায় যুদ্ধ বিরতির ব্যবস্থা গ্রহণে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ৩০০ এমপি-র স্বাক্ষরে একটি প্রস্তাব পার্লামেন্টে উত্থাপন করা হয় এবং ১৪ই মে ঐ প্রস্তাবের ওপর এক বিশদ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে অংশ নিয়ে ব্রুস ডগলাস-ম্যান ‘জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকৃতির ভিত্তিতে’ বাংলাদেশ সংকটের রাজনৈতিক সমাধান, তা না হওয়া ও সংঘর্ষ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার ব্রিটিশ সাহায্য বন্ধ রাখা, বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল যাতে পাকিস্তানকে সাহায্যদান বন্ধ রাখে সে ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগ গ্রহণ, পূর্ব বাংলায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও শরণার্থীদের দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য অবিলম্বে সেখান থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রত্যাহার ইত্যাদির প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেন (বঙ্গানুবাদ), ‘পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপকতা এবং তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে যে প্রচণ্ড ঘৃণার উদ্রেক হয়েছে, তার ফলে পাকিস্তান আজ এক রাষ্ট্র হিসেবে মৃত।’ ৩০শে জুন ২১৬ জন এমপি স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আহ্বান জানিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যে প্রস্তাব উত্থাপন করেন, ব্রুস ডগলাস-ম্যান ছিলেন তার অন্যতম উদ্যোক্তা। একই আহ্বানে পল কনেট-এর নেতৃত্বাধীন Action Bangladesh-এর উদ্যোগে ট্রাফালগার স্কোয়ারে স্মরণকালের যে বৃহত্তম জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেও ব্রুস ডগলাস- ম্যান অনুরূপ বক্তব্য তুলে ধরেন। লন্ডন শহরের বাইরেও তিনি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে প্রবাসী বাঙালিদের একাধিক সমাবেশে বাংলাদেশের পক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন। আগস্ট মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি অবস্থায় সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচার শুর হলে ঐ বিচার বন্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি জানিয়ে দুই শতাধিক ব্রিটিশ এমপি পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব আনেন। ব্রুস ডগলাস-ম্যান ছিলেন প্রস্তাবকারীদের মধ্যে অন্যতম। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর প্রহসনমূলক বিচারের প্রতিবাদে ১১ই আগস্ট লন্ডনের হাইড পার্কে প্রবাসী বাঙালিদের এক বিরাট প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে শোভাযাত্রা সহকারে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট ভবনে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও অন্যান্যদের সঙ্গে ব্রুস ডগলাস-ম্যান ঐ শোভাযাত্রার অগ্রভাগে ছিলেন। ৭ই অক্টোবর ব্রাইটনে লেবার পার্টির বার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশ পরিস্থিতির জন্য পাকিস্তান সরকারকে দায়ী এবং জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়, তার সমর্থনে ব্রুস ডগলাস- ম্যান জোরালো বক্তব্য রাখেন। তিনি এও বলেন (বঙ্গানুবাদ), ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত বাংলাদেশ সরকার-কে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য শ্রমিকদল কর্তৃক ব্রিটিশ সরকারকে নিরবিচ্ছিন্ন চাপ দেয়া অবশ্য কর্তব্য।’
মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১২ সালের ২৭শে মার্চ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ব্রুস ডগলাস- ম্যান-কে Friends of Liberation War সম্মাননায় (মরণোত্তর) ভূষিত করা হয়। ২০০০ সালের ২৭শে জুলাই বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ডগলাস-ম্যানের জীবনাবসান ঘটে। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: আবদুল মতিন, স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালী, লন্ডন, র্যাডিকেল এশিয়া পাবলিকেশন্স ১৯৮৯; আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি, ঢাকা, ইউপিএল ১৯৯০; শেখ আবদুল মান্নান, মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্যের বাঙালীর অবদান, ঢাকা, জ্যোৎস্না পাবলিশার্স, ১৯৯৮; Harun-or-Rashid, “British perspectives, pressures and publicity regarding Bangladesh, 1971″, Contemporary South Asia 1995, Oxford, 4 (2), 139-149; The Testimony of Sixty, Oxfam, Oxford 21 October 1971; https://en.wikipedia.org/wiki/ Bruce_Douglas-Mann

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!