You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে বোদা উপজেলা (পঞ্চগড়) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে বোদা উপজেলা (পঞ্চগড়)

বোদা উপজেলা (পঞ্চগড়) সংস্কৃতিসমৃদ্ধ ও রাজনীতি- সচেতন একটি উপজেলা। ব্রিটিশ আমলে এখানে জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে বারবার কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়। সে- সময় থেকেই এ অঞ্চলে বামপন্থী প্রগতিশীল রাজনীতির ধারা চলে আসছে। ৫২-র ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-র ৬-দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন এবং ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সকল আন্দোলন-সংগ্রামে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও সাধারণ জনতা অত্যন্ত সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের সঙ্গে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে।
১৯৭০ সালের নির্বাচন ও তৎপরবর্তী দিনগুলোতে বোদার জনগণের সংগ্রামী তৎপরতা একান্তভাবে লক্ষ করা যায়। ৭১-এর মার্চ থেকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ডাকা অসহযোগ আন্দোলন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী নেতাদের নেতৃত্বে চরম আকার ধারণ করে। ৩রা মার্চ দেশের অন্যান্য এলাকার মতো বোদা থানায়ও সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর বোদা থানার ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এ উপলক্ষে এখানে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, যার প্রভাব পড়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম এমপিএ, ডা. আতাউর রহমান, মো. শফিউল্লাহ্, ফকরুল ইসলাম মানিক, আব্দুর রউফ, শামসুজ্জোহা, শামসুল আলম, লুৎফর রহমান, অনুপ কুমার কারকুন, আব্দুল লতিফ মাস্টার, প্রফুল্ল ঘোষ, মতিয়ার রহমান, হবিবর রহমান প্রমুখ। এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম এমপিএ-এর জন্মস্থান ময়দানদিঘিতেও সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ পরিষদের নেতৃত্ব দেন ডা. গোলাম রহমান, নূরুল ইসলাম সুজন (বর্তমানে সংসদ সদস্য), আকবর হোসেন, নির্মল চন্দ্ৰ বৰ্মণ, সাইফুদ্দীন প্রমুখ। এছাড়া, মোখলেসার রহমান, আলম চৌধুরী, ওয়ালিউল ইসলাম মন্টু ও সুলতান আলম প্রধানের নেতৃত্বে সাকোয়া, পাঁচপীর, মাড়েয়া, শালডাঙ্গা প্রভৃতি ইউনিয়নে আন্দোলন পরিচালিত হয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বাঙালি পুলিশ, ইপিআর, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যরাও স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে থাকেন। ৯ই মার্চ বোদা হাইস্কুল এবং নয়দিঘী স্কুল মাঠে দুটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। উভয় জনসভায় এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম এমপিএ-সহ অন্যান্য বক্তার বক্তব্যে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ঘোষিত স্বাধীনতার কথা বারবার উচ্চারিত হয়। এরপর সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে দলমত নির্বিশেষে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি ক্রমশ জোরদার হতে থাকে।
৮ই মার্চ বোদা বাজারের কুমিল্লা বেকারির রেডিওতে জনগণ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শোনে। পাশাপাশি সৈয়দপুর ও ঠাকুরগাঁও ইপিআর ক্যাম্পগুলোর খবরাখবরও দ্রুত আসতে থাকে। এরকম এক উত্তাল দিনে ছাত্রনেতা তরিকুল আলম এবং ছাত্র-জনতা বোদা থানা থেকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে নেয়। ২৩শে মার্চ ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ইত্যাদি স্লোগানের মধ্য দিয়ে সংগ্রাম পরিষদের নেতারা বোদা বাজারের কুমিল্লা বেকারির সম্মুখস্থ পাকুর গাছের তলায় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পাতাকা উত্তোলন করেন। পতাকাটি তৈরি করেছিলেন দর্জি গণেশ সরকার এবং পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে মাইক দিয়ে সাহায্য করেছিলেন দবির মেকার|
২৭শে মার্চ রাতে সুবেদার মেজর কাজিমুদ্দিনের নেতৃতে ঠাকুরগাঁও ইপিআর ক্যাম্পের বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করেন এবং সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পাকসেনাদের পরাস্ত করে ক্যাম্প দখল করে নেন। এরপর থেকেই সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ। অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য আব্দুর লতিফ ওয়াপদার (পানি উন্নয়ন বোর্ড) প্রাচীরঘেরা মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেন। ঠাকুরগাঁও ইপিআর ক্যাম্পে বাঙালি সেনাদের বিদ্রোহ ঘোষণার পর সেখানে দুদিন যাবৎ গোলাগুলি চলে এবং যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করে। এর ফলে বোদায় সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণেচ্ছু মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। এ- সময় ওয়াপদার গোপন চত্বর থেকে বেরিয়ে বোদা হাইস্কুল মাঠে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এর সঙ্গে যোগ দেন আনসার কমান্ডার সোলেমান ও তাঁর গ্রুপের সকল সদস্য। ইতোমধ্যে ‘বিপ্লবী কমান্ড’ নামে একটি বিশেষ প্রশিক্ষিত দল গঠিত হয়। ফকরুল ইসলাম মানিকের নেতৃত্বে তাঁর বাড়িতে বসে ইউনুস খোকা, মোয়াজ্জেম হোসেন বাবু, শামসুজ্জোহা, আব্দুর রউফ, সুধাংশু চন্দ্র চন্দ, এমরান, খোকা, বিভুরঞ্জন সরকার প্রমুখ এ ‘বিপ্লবী কমান্ড’ গঠন করেন এবং স্বাধীনতার অগ্নিশপথে তাঁরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। বোদা থানার ওসি আতিয়ার রহমান থানা থেকে ২০টির মতো রাইফেল ও বেশকিছু গুলি বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিলকে প্রদান করেন। ঠাকুরগাঁও ট্রেজারি থেকে সংগ্রহ করা হয় আরো ৫০-৬০টি রাইফেল। এগুলো দিয়ে বোদা হাইস্কুল মাঠে প্রায় দুশ মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দেন সোলেমান কমান্ডার ও তাঁর সহকারী মুজাহিদ ফজলু (ফজলুকে ১৫ই এপ্রিল দেবীগঞ্জ থেকে আসা একটি মটর সাইকেলে ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে রেকি করতে পাঠালে তিনি আর ফিরে আসেননি; পাকসেনা কিংবা তাদের দোসরদের হাতে শহীদ হন বলে মনে করা হয়; বোদায় তিনিই প্রথম শহীদ)। এখানে যাঁরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন, তাঁরা হলেন- ফকরুল ইসলাম মানিক, শামসুল আলম, তরিকুল আলম, মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল, ইউনুস খোকা, এমরান খোকা, লুৎফর রহমান, টিপু সুলতান, আব্বাস, দুলাল কারকুন, সুধাংশু চন্দ্র চন্দ প্রমুখ।
যুদ্ধের সময় বোদা উপজেলায় কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন এফএফ তরিকুল আলম (প্রাক্তন অধ্যক্ষ, পাথরাজ মহাবিদ্যালয়) এবং বিএলএফ- মো. আকবর হোসেন (ময়দানদিঘি)।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে যখন বাঙালি ইপিআর, আনসার ও মুজাহিদরা সৈয়দপুরের উদ্দেশে অগ্রসর হন, তখন থেকেই বোদার সংগ্রাম পরিষদ ও বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পাহারা ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার ব্যবস্থা করে। বোদা গার্লস স্কুলে সংগ্রাম পরিষদের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন করা হয়। এখানে খাদ্য, অস্ত্র ও অন্যান্য জরুরি রসদ মজুদ করা হয়। সেচ্ছাসেবক, মুজাহিদ ও আনসারদের জন্য এখানে খাদ্য প্রস্তুত করা হতো। বোদার বিভিন্ন স্থানে তৈরি করা হয় বাংকার ও বেরিকেড। পথেপথে গাছ ও গাছের গুঁড়ি ফেলে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। আইন- শৃঙ্খলা রক্ষা ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সংগ্রাম পরিষদের সদস্যগণ নিরলস টহল ও মাইকিংয়ের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করেন। জলেশ্বরীর মিল থেকে বোদা বাসস্ট্যান্ড ব্রিজ পর্যন্ত শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। কিন্তু এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষদিকে ঠাকুরগাঁওয়ের পতন হলে সংগ্রাম পরিষদ ও বিপ্লবী কমান্ড কৌশলগত কারণে পিছু হটে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয়।
১৭ই এপ্রিল সকালে পাকবাহিনী বিনা প্রতিরোধে ঠাকুরগাঁও থেকে জিপ ও সামরিক ট্রাক নিয়ে বোদা বাজারে প্রবেশ করে। এসময় স্বল্পসংখক মানুষ বাজারের অলিগলিতে অবস্থান করছিল। তাদের দিয়ে তারা পাকিস্তানের পক্ষে একটি মিছিল করায়। এরপর পাকসেনারা বোদা বাজারের পুরোটা দখলে নেয়। তাদের বিশেষ নজর ছিল পাকিস্তানবিরোধী সংগঠন ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর। তবে এখানে তারা কোনো স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেনি।
উপজেলায় পাকবাহিনীর সহযোগীদের মধ্যে মো. সুফি ইসাহাক (বহিরাগত এবং এলাকায় ‘সুফি’ নামে পরিচিত, থানা সেনেটারি কার্যালয়ের একজন নিম্নমান কর্মচারী), মো. হবিবর কমান্ডার (চন্দনবাড়ি), ইছা মৌলবি (কার্জিপাড়া, চন্দনবাড়ি), ঘুটু ডাক্তার দ(মাড়েয়া), হাদি (কামাত কাজলদিঘি, ছাত্র), আজিজার (মাঝগ্রাম, কৃষক), সালমান বিহারি (নয়াদিঘি, কৃষক), সামসুদ্দিন (নয়াদিঘি), বকতার আলী (মন্নাপাড়া, ছাত্র), কলু মোহাম্মদ (কান্তমনি, কৃষক), কছিমদ্দিন ঠাটারিয়া (মাড়েয়া, কৃষক), হাতেম আলী (বড়শশী, কৃষক), কুতুব ডাক্তার, কছিমউদ্দীন ঠাটারি (সাকোয়া) প্রমুখ। এদের উদ্যোগে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। এ দুই বাহিনীর সদস্যরা হলো— সৈয়দ হাজী (সাকোয়া), মো. ইসহাক আলী খান (পাঠানপাড়া), শওকত আলী (পাঠানপাড়া), মো. হবিবর (রাজাকার কমান্ডার), সাইফুল্লাহ্ (যতনপুকুরী), নূরুল ইসলাম (মাড়েয়া), সইমদ্দিন (মাড়েয়া), নূরুর রহমান (মাড়েয়া), মশিয়র রহমান (ঝলই), সিরাজুল ইসলাম (চন্দনবাড়ী), নফি মিয়া (মাড়েয়া), তোয়াবুর রহমান (সাকোয়া), ভটরু মোহাম্মদ (সাকোয়া), লুলু মোহাম্মদ (চন্দনবাড়ী) প্রমুখ।
১৭ই এপ্রিল বোদা বাজারে প্রবেশ করে পাকবাহিনী নিরপরাধ তিনজন লোককে হত্যা করে। তাঁরা হলেন ডা. যতীন্দ্রমোহন সাহা, আব্দুল মান্নান (থানা পোস্ট মাস্টার) এবং আব্দুল লতিফ (ইউপি মেম্বার)। অতঃপর তারা বোদা থানায় গিয়ে থানাসংলগ্ন মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক ও খ্যাতনামা ক্রিড়াবিদ সুধীর চন্দ্র চন্দের বাড়ি লুণ্ঠনশেষে আগুনে পুড়িয়ে দেয়।
এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে পাঁচপীর ইউনিয়নের ঢাবঢুব এলাকায় এক ভয়ঙ্কর গণহত্যা সংঘটিত হয়। ঘটনার দিন ঠাকুরগাঁও, গড়েয়া, ঝারবাড়ি, বীরগঞ্জ প্রভৃতি এলাকার নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের তিন সহস্রাধিক লোক ভারতে যাওয়ার জন্য এখানে জড়ো হয়। পাকবাহিনীর স্থানীয় দোসর ও অবাঙালিরা তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। এতে নেতৃত্ব দেয় মঙ্গুলু চেয়ারম্যান। তার সঙ্গে ছিল ঠাকুরগাঁও অঞ্চলের শুখানপুকুরি ও বালিয়া ইউনিয়নের বালিয়া কলোনির লোকজন। তাদের মধ্যে কয়েকজন হলো- তারা মিয়া (গড়েয়া, শুখানপুকুরি, ঠাকুরগাঁও), মোকরুল ইসলাম, মহিউদ্দীন, মতি, আয়তুল্লাহ, মন্ডলু, ছকু প্রমুখ। গণহত্যার শিকার ব্যক্তিরা অন্য এলাকার হওয়ায় তাদের পরিচয় জানার কোনো সুযোগ নেই। ঢাবঢুব গণহত্যাকে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার সবচেয়ে বড় গণহত্যা বলে গণ্য করা হয়। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকসেনারা রাণীগঞ্জ বাজার থেকে কিছু লোককে ধরে আনে। তাদের মধ্যে কয়েকজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও পাঁচজন শালশিরি ইউনিয়নের ধরধরায় পাকসেনাদের হাতে নিহত হন। তারা হলেন- পানবর বর্মণ (মাঝাপাড়া), পশুনাথ বর্মণ (মোহনঝাড়), কানাই বর্মণ (মোহনঝাড়), গোপাল বর্মণ (মোহনঝাড়) এবং কোটই বর্মণ (ফকদই পাড়া)। সে-সময় এখানে এমন একটি ভয়ঙ্কর অবস্থা বিরাজ করছিল যে, তাদের কবর দেয়ার মতো কোনো লোক ছিল না। তাই শেয়াল-কুকুর ও শকুনে মৃতদেহগুলো খেয়ে ফেলে।
জুলাই মাসে পাকবাহিনী ইউসুফ মন্টু নামে একজনকে ধরে নিয়ে পঞ্চগড় ডাকবাংলোর একটি কক্ষে ১৪ দিন আটকে রাখে এবং তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চলায়। এরপর ওয়াহিদুজ্জামান সুজা নামে আরেকজনকে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা ধরে নিয়ে পঞ্চগড় সুগারমিলের একটি কক্ষে বন্দি করে রাখে।
২৬শে সেপ্টেম্বর পাকসেনারা মাড়েয়া ইউনিয়ন ও সাকোয়া ইউনিয়নের মধ্যবর্তী স্থান থেকে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আলম চৌধুরীকে আটক করে ঠাকুরগাঁও ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন করে।
বোদা অঞ্চলের তিনদিকে ভারত হওয়ায় এ অঞ্চলে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের তৎপরতা ছিল নিয়মিত। তদুপরি অক্টোম্বর মাসের প্রথমদিকে মুক্তিবাহিনী নয়াদিঘি দখল করলে সাকোয়া-নয়াদিঘি ও বোদা এলাকায় পাকবাহিনীর অত্যাচার বৃদ্ধি পায়। নয়াদিঘিতে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে রাজাকার কমান্ডার মো. হবিবর ও অন্যদের সহায়তায় পাকবাহিনী নয়াদিঘি বাজার ঘেরাও করে এবং সেরাজুল আলম ও খায়রুল আলম প্রধানসহ মোট ১৭ জনকে ধরে নিয়ে ঠাকুরগাঁও উপজেলার রাণীশংকৈলের অদূরে খুনিয়াদিঘিতে হত্যা করে। বোদা উপজেলার প্রায় ৫০টি এলাকায় নারীনির্যাতনের ঘটনা ঘটে। জমাদার পাড়ায় দুজন এবং সিপাইপাড়ায় একজন মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়। পাথরাজ নদীর তীরে ছিল পাকসেনাদের কংক্রিটের বাংকার। সেখানে বহু নারী লাঞ্ছিতা হন। বোদা হানাদারমুক্ত হওয়ার পর বিবস্ত্র অবস্থায় ৩ জন নারীকে ঐ বাংকার থেকে উদ্ধার করা হয়। বোদার টিএন্ডটি অফিসের পাশে পাকসেনারা একজন মহিলাকে ধর্ষণ করে। নয়াদিঘি অঞ্চলেও অনেক নারী লাঞ্চিত হন। নারীনির্যাতনে রাজাকাররাও অংশ নেয়।
বোদা উপজেলায় রাজাকার কমান্ডার নিয়ন্ত্রিত একটি হিন্দুবাড়িতে পাকবাহিনীর দোসররা হিন্দু সম্প্রদায়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন ও তাদের সন্দেহভাজনদের ধরে এনে তাদের ওপর নির্যাতন চালাত। রাজাকার সুফি ও তার দোসররা এখান থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত এবং তাদের অনুগতদের বিশেষ কার্ড প্রদান করত। লুটের মালামালও এখানে বসে তারা ভাগবাটোয়ারা করত|
বোদা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। সে-সবের মধ্যে নয়াদিঘি যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। ১২ই অক্টোবর এ-যুদ্ধ সংঘটিত হয়। দীর্ঘ চার ঘণ্টাব্যাপী এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণে টিকতে না পেরে হানাদাররা পালিয়ে যায়। ১লা ডিসেম্বর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
বোদা উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. কাশেম আলী (পিতা আশরাফ আলী, মুন্সিপাড়া, বড়শশী), কাজীমুদ্দিন (পিতা মো. মনছুর আলী, কালিয়াগঞ্জ), কেশব চন্দ্র রায় (পিতা ভগরাম রায়, বনগ্রাম), মো. শামসুল হক (পিতা মো. পর্বত আলী, কালিয়াগঞ্জ), আব্দুল খালেক (পিতা আতর আলী মুনশী, কাজলদিঘি), মো. মজিবর রহমান (পিতা মো. জামাল হাফেজ, কালিয়াগঞ্জ), নৃপেন্দ্রনাথ বর্মণ (পিতা খগেন্দ্রনাথ বর্মণ, হরিনিমাইপাড়া), প্রেমহরি বর্মণ (পিতা প্রিয়নাথ বর্মণ, সাকোয়া), স্বপন কুমার বকশী (পিতা নগেন্দ্রনাথ বকশী, সাকোয়া), মো. উমেশ আলী (পিতা ডা. আহমদ আলী, সোনাপাড়া, ময়দানদিঘি; আনসার), মো. আব্দুস সামাদ (পিতা জবর আলী মুন্সি, বোদেশ্বরী, বড়শশী), মেরাজুল হক প্রধান (পিতা আশরাফ আলী প্রধান, নয়াদিঘি), খোরশেদ আলী (পিতা নেহারু মোহাম্মদ, ভেলাপুকর, ময়দানদিঘি), মো. কছিম উদ্দীন (যতনপুকুরী), মো. আজিজুল হক (বোদা), মো. সাইফুল ইসলাম (চন্দনবাড়ি), রহমান উদ্দীন (অফিরামপুর, ময়দানদিঘি), জয়নাল আবেদিন (মানিকগঞ্জ ক্যাম্পে শহীদ, অমরখানায় সমাহিত) এবং আব্দুল মজিদ (সাকাতিপাড়ায় শহীদ)। এছাড়া কুমিল্লা জেলার একজন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেক (সেনাবাহিনীর সাবেক এনসিও) সাকাতিপাড়ায় শহীদ হন। মালকাডাঙ্গায় তাঁর কবর রয়েছে।
ঢাবঢুব গণহত্যার স্থলে নিহতদের স্মৃতির উদ্দেশে জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। [প্রবীর চন্দ]
তথ্যসূত্র: মাহবুব আলম, গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে, দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা; ড. নাজমুল হক, পঞ্চগড় জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, গতিধারা, ঢাকা; বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড