বোয়ালিয়া গণহত্যা (গোমস্তাপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ)
বোয়ালিয়া গণহত্যা (গোমস্তাপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ) সংঘটিত হয় ১৯শে সেপ্টেম্বর। এতে ২৫০ জন নিরীহ মানুষ শহীদ হন।
পাকহানাদার বাহিনী চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর থানার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের ঘাটনগর, গৌরীপুর, দরবারপুর, লক্ষ্মীনারায়ণপুর, বৌরতলা, কাঞ্চনতলা, বোয়ালিয়া, বড়বঙ্গেশ্বরপুর, বঙ্গেশ্বরপুর, বাবুপুর, দুর্গাপুর, চকমজুমদার, নরশিয়া, পলাশবনী, সাহাপুর, আলমপুর, নওদাপাড়া ইত্যাদি গ্রামে নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। এ গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বোয়ালিয়া গণহত্যা নামে পরিচিত।
রহনপুর ক্যাম্পে যেসব পাকিস্তানি সেনা অফিসার ছিল, তাদের মধ্যে মেজর ইউনুস ছিল সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও ভয়ংকর। তার নির্দেশে পাকবাহিনী মকরমপুর ঘাট পর্যন্ত সমস্ত আমবাগান ঘিরে ট্রেঞ্চ ও বাংকার বানিয়ে এক শক্ত ডিফেন্স তৈরি করেছিল। এসব ক্যাম্পের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত সৈন্যদের দিয়ে হানাদাররা মেজর ইউনুসের পরিকল্পনা ও প্ররোচনায় বোয়ালিয়া গণহত্যা পরিচালনা করে।
ঘটনার দিন মকরমপুর ঘাট থেকে শত্রুসৈন্যরা মুক্তিবাহিনীর ওপর হঠাৎ গুলিবর্ষণ আরম্ভ করে। অপরদিকে মেজর ইউনুসের নেতৃত্বে গৌরীপুর ঘাটের পাশ দিয়ে একটি পাকিস্তানি সেনাদল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বোয়ালিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে হানা দেয়। তারা বাড়ি-বাড়ি ঢুকে নির্মমভাবে মানুষকে হত্যা করতে থাকে। তাদের এলোপাতাড়ি গুলিতে আতংকিত মানুষজন দিকবিদিক ছুটতে থাকে। হানাদাররা চারদিক ঘিরে ফেলে গুলি করতে থাকে। মানুষের আর্তনাদ আর হাহাকারে আকাশ যেন বিদীর্ণ হয়ে যায়। সেদিন আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা কেউ রেহাই পায়নি। নরপশুরা শিশুদের পেটে বেয়নেট বিদ্ধ করে। বেয়নেট বিদ্ধ দেহ তারা দূরে নিক্ষেপ করে। হত্যা আর উন্মত্ততায় তারা মেতে ওঠে। প্রতিটি বাড়িতে লাশের স্তূপ তৈরি হয়। পুরো এলাকায় করুণ ও মর্মান্তিক ঘটনার জন্ম হয়। বর্বর বাহিনী গ্রামগুলোতে চার ঘণ্টা ধরে নিষ্ঠুর এ হত্যাকাণ্ড চালায়।
সেদিন এখানে ২৫০ জন নারী-পুরুষ-শিশু নিহত হয়। রক্তে লাল হয়ে যায় মহানন্দা নদীর পানি। হত্যাকাণ্ডের ২-৩ দিন পরেও অনেকের লাশ পানিতে ভাসতে দেখা যায়। সেদিন যারা নিহত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে যাদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে, তারা হলেন— গৌরীপুর গ্রামের মো. আব্দুর রাজ্জাক (পিতা মো. গিয়াস উদ্দীন), মো. হামেদ আলী (পিতা মো. ওয়াজেদ আলী), মো. সাইফুল ইসলাম (পিতা মো. ওয়ারেশতুল্লাহ), মো. আব্দুর রশিদ (পিতা মো. এনামুল জমাদার), দরবারপুর গ্রামের মো. হানিফ মহাজন (পিতা বোগদাদ আলী), মো. আব্দুল জাব্বার (পিতা মো. হকদার কবিরাজ), মো. আজিজুল হক (পিতা মো. আব্দুল জাব্বার), মো. এনেশ আলী (পিতা মো. সাজুরুদ্দিন), মো. আব্বাস আলী (পিতা মো. সাজুরুদ্দিন), মো. সুকুদ্দি (পিতা মো. বানারুদ্দিন), মো. লালা মোহাম্মদ (পিতা বাজারী মণ্ডল), মো. হোসেন আলী (পিতা মো. বাজারী মণ্ডল), দীন মুহম্মদ (পিতা বাজারী মণ্ডল), মনিরুল ইসলাম (পিতা সমশের আলী মণ্ডল), চাঁদ মোহাম্মদ (পিতা মো. খোশাল মণ্ডল), মোসা. সুফিয়া খাতুন (পিতা মো. মোস্তফা মোল্লা), মো. মফিজুদ্দিন (পিতা মো. আব্দুল কাদের), মোসা. টুকি খাতুন (স্বামী দানেশ অরুল), মো. দুলাল (পিতা দানেশ অরুল), মোসা. আলো বিবি (স্বামী বাজারী মণ্ডল), মোসা. ফরি বেগম (স্বামী আব্দুল জলিল), মোসা. রেশমা বিবি (স্বামী খাতির আলী), মো. হারু শেখ (পিতা পাতান শেখ), লাসান দিয়াড়া (পিতা ইব্রাহিম দিয়াড়া), ঘাটনগর গ্রামের মোসা. মনিজা বেগম (স্বামী গিয়াস উদ্দিন), মোসা. মেরিনা বেগম (পিতা মো. সিদ্দিক), মো. সাইফুল ইসলাম (পিতা মো. সিদ্দিক), মোসা. মজিদা (পিতা দোস্ত মোহাম্মদ), মোসা. রোকেয়া (পিতা দোস্ত মোহাম্মদ), মোসা. আবেদা (পিতা দোস্ত মোহাম্মদ), রেজাউল (পিতা মো. গিয়াস উদ্দীন), মোসা. বেগম নেসা (পিতা নেস মোহাম্মদ), মোসা. রাবেয়া বেগম (স্বামী গোলাম রাব্বানী), মোসা. গাজলী (স্বামী কুতুবুল আলম), মো. সজল (পিতা কুতুবুল আলম), মো. নয়ন (পিতা কুতুবুল আলম), আজমীর মান্নান (পিতা মো. আবুল কাশেম), শামীম (পিতা তেনু আলী), মোসা. রুবিনা (পিতা তেনু আলী), মোসা. নাজিরা বেগম (পিতা রফিকুল ইসলাম), লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামের নেশ মোহাম্মদ (পিতা রাফাতুল্লাহ), মো. সিদ্দিক আলী (পিতা ইয়ারুদ্দিন মিয়া), মোকসেদ দফাদার (পিতা হেদায়েত উল্লাহ), অহাব আলী (পিতা চাঁদ মুন্সী), আবু সাহাবু (পিতা কুদ্দুস আলী), সুধোন আল (পিতা ইব্রাহিম আলী), মো. ঝালু (পিতা সুধোন আলী), মো. কালু (পিতা সুধোন আলী), সাজুরুদ্দিন (পিতা সেফাতুল্লাহ), মোসা. সালেহা (স্বামী আতাজুদ্দিন), মো. কবিল (পিতা আইয়ুব আলী), মো. সেকান্দার আলী (পিতা খুদি মোল্লা), হাওয়া বিবি (স্বামী সেকান্দার আলী), মো. ইনা আলী (পিতা সেকান্দার আলী), হাসু চৌকিদার (পিতা জাহির রাজাতুল্লাহ), পরিবত আলী (পিতা মিয়ারুদ্দিন), বালু বহারা (পিতা তালুক মণ্ডল), সাজেনুর নেসা (পিতা বালু বহারা), বেগম বিবি (স্বামী ফিন্টু মিয়া), ওয়েজউদ্দীন (পিতা উজির পাগলা), আবেদ আলী (পিতা নেকি পাগলা), এরফান আলী (পিতা বতি মণ্ডল), মো. সামেদ (পিতা আনারুদ্দিন), নওদাপাড়া গ্রামের মো. নজরুল ইসলাম (পিতা দেরাস ঘরামী), মো. আইয়ুব আলী (পিতা ফাইজুদ্দিন), মো. সেতু (পিতা আসগর আলী), হাজী ওসমান আলী (পিতা হাজী তাইজুদ্দিন), মোসা. ফিরোজা বেগম (স্বামী আবুল হোসেন), ইনু জমাদার (পিতা নেয়ামত জমাদার), বোয়ালিয়া গ্রামের সাইফুদ্দিন (পিতা রাজাতুল্লাহ), গোলেনুর বিবি (স্বামী জসিমুদ্দিন), রজত আলী (পিতা মো. হারু শেখ), আলিয়া বিবি (পিতা মো. রাহাত আলী), সোনা বিবি ( স্বামী এজারুদ্দিন), হাজেরা বিবি (পিতা এজারুদ্দিন), সালেহা বিবি (স্বামী শামসুদ্দিন), কাচু বিবি (স্বামী জোহাক আলী), চেন বানু বিবি (স্বামী সলেমান), বৌরতলী গ্রামের রশিমন বিবি (স্বামী ইসলাম), ওজকার বিবি (স্বামী নাসির কাতারী), জল বিবি (স্বামী আলতাস আলী), সলেমান বহির (পিতা মহিরুদ্দিন), সুলতান আলী (পিতা আইনুদ্দিন), হাজী মো. জাফুরুদ্দিন (পিতা আশুরদ্দিন), খালেদ আলী (পিতা মজুরুদ্দিন), মো. এরশাদ আলী (পিতা মজুরুদ্দিন), মো. রিয়াজ উদ্দিন (পিতা মজুরুদ্দিন), মো. জুলকার (পিতা এরফান আলী), বেলায়েত আলী (পিতা মো. জহির), বেলাল সর্দার (পিতা তুফানী সর্দার), মহসীন আলী (পিতা মো. ওজকোরী), মোসা. শমশের বিবি (পিতা মোন্তাজ আলী), কাঞ্চনতলা গ্রামের মো. আকিমুদ্দিন (পিতা দিলু মিস্ত্রি), সোহরাব আলী (পিতা মো. ঝড়ু), মো. কসিমুদ্দিন (পিতা ইয়ারুদ্দিন), মো. কালু (পিতা লাল মোহাম্মদ), মো. আসতার আলী (পিতা ফজর আলী), আজিতন নেসা (পিতা কায়েস উদ্দিন), ঝড়ু শেখ (পিতা মো. ইয়াদগাড়), মোসা. মনোয়ারা (পিতা কায়েস উদ্দিন), বড়বঙ্গেশ্বরপুর গ্রামের মো. কাঞ্চি সরকার (পিতা মো. এজারুদ্দিন), বঙ্গেশ্বরপুর গ্রামের হালেমান বিবি (স্বামী খাবিরুদ্দিন), বাবুপুর গ্রামের ফরজেন খাতুন (স্বামী সামীরুদ্দিন), দুর্গাপুর গ্রামের নেজাম মণ্ডল (পিতা জামরুদ্দিন), চকমজুমদার গ্রামের অরেজুদ্দিন (পিতা আসমত আলী), ফকির উদ্দিন (পিতা কাৰ্ত্তিক মণ্ডল), এরফান আলী (পিতা ফকির উদ্দিন), মো. জবেদ (পিতা কালুমদ্দিন), মো. সাজ্জাদ (পিতা খাপুরুদ্দিন), নরশিয়া গ্রামের মালা বখশ (পিতা মো. সওদাগর), দবিরুদ্দিন (পিতা খুশি সরকার), মো. তালেব (পিতা খুশি সরকার), মো. অযেশ (পিতা মো. তাহির), মোসা. মেরালী (পিতা মো. ভোলা), জসীমুদ্দিন (পিতা আমিরুদ্দিন), মো. আ. রশিদ (পিতা মো. ইসমাইল), জামরুদ্দিন (পিতা আমিরুদ্দিন), পলাশবনী গ্রামের মো. হামদুল (পিতা মো. সাবার), সাহাপুর গ্রামের মো. ডুমন (পিতা মো. ফরিঙ্গ), পটল (পিতা মো. আয়েশ মোল্লা), আইনুদ্দিন (পিতা মো. মুকুট উদ্দিন), করুদ্দিন (পিতা সাযযুরুদ্দিন কবিরাজ), আলমপুর গ্রামের মো. রুহুল শেখ (পিতা বেলায়েত শেখ), মোসা. সালোয়ার খাতুন (পিতা মো. মোহরম শেখ) ও দেরাসাত আলী (পিতা সৈয়দ আলী)। [মাযহারুল ইসলাম তরু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড