বোরনপুর গণহত্যা (মিটামইন, কিশোরগঞ্জ)
বোরনপুর গণহত্যা (মিটামইন, কিশোরগঞ্জ) সংঘটিত হয় সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। এতে প্রায় ২০০ মানুষ প্রাণ হারায়।
কিশোরগঞ্জ জেলার মিটামইন উপজেলার সদর ইউনিয়নের একটি গ্রাম বোরনপুর। ১৯৭১ সালে এ গ্রামের বাসিন্দাদের শতভাগ ছিল হিন্দু ধর্মানুসারী। গ্রামের মোট লোকসংখ্যা ছিল দুই থেকে আড়াই হাজার। বোরনপুরের পাশের একটি গ্রাম নতুন হাটি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এ দুই গ্রামের বাসিন্দারা ভয়ে ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছিল। এ আতঙ্ক একদিন তাদের জীবনে বিভীষিকাময় হয়ে দেখা দেয়। মে মাসের প্রথমদিকে পাকবাহিনীর দোসর ও লুটেরাদের একটি দল বোরনপুর ও নতুন হাটি গ্রামে হামলা চালায়। তারা দুই গ্রামের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িতে লুটতরাজ চালিয়ে তাদের অর্থ-সম্পদ ছিনিয়ে নেয়। ইটনা থানায় পাকবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপিত হলে মিটামইনের কিছু প্রভাবশালী লোক রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। এর ফলে হিন্দুদের মধ্যে আতঙ্ক আরো বৃদ্ধি পায়।
১৫ই সেপ্টেম্বর মিটামইন থানার ঢালা-ছত্রিশ গ্রামে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা নির্বিচার গণহত্যা, লুটতরাজ, নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটালে বোরনপুর ও নতুন হাটি গ্রামে চরম ভীতি দেখা দেয়। তারা ধন-সম্পদ, ইজ্জত ও প্রাণ হারানোর ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে দিন কাটায়। ঢালা-ছত্রিশের ঘটনার কয়েকদিন পর বোরনপুর গ্রামের প্রায় ৫০টি হিন্দু পরিবার ১২টি বড় নৌকায় করে গভীর রাতে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের হামলার ভয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। তাদের নৌকা শেষরাতের দিকে ইটনার কাছাকাছি এলে নৌ-টহলরত রাজাকার বাহিনীর হাতে আটক হয়। কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার কুরবান আলী, খুর্শিদ, আব্দুল হকসহ অন্যরা নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ- সহ প্রায় দুশত মানুষকে ইটনা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। প্রাণ বাঁচানোর জন্য অসহায় মানুষেরা ঘাতক বাহিনীর কাছে বারবার অনুনয়-বিনয় করে। কিন্তু তাদের প্রাণভিক্ষা ঘাতকদের মনে এতটুকু করুণা জাগাতে পারেনি। তারা কয়েকজন মেয়েকে রেখে বাকি সবাইকে ইটনার বয়রা বটমূলের বধ্যভূমিতে নির্মমভাবে হত্যা করে। এদের নিষ্ঠুরতা থেকে নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ কেউই রেহাই পায়নি। আটককৃত মেয়েদের ইটনার পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে বন্দি করে রেখে দিনের পর দিন ঘাতক বাহিনী ও রাজাকাররা পাশবিক নির্যাতন চালায়। ঘাতকরা কিছু মেয়েকে নিকলী ও কিছু মেয়েকে কিশোরগঞ্জ সেনা ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। পরে নির্যাতিত মেয়েদের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়ি। এ হত্যাকাণ্ড থেকে মাঝির ছদ্মবেশ নিয়ে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন মিটামইন হাইস্কুলের একজন শিক্ষক। তিনি এ যন্ত্রণাকর অভিজ্ঞতায় এখনও বাকশক্তিহীন। [শেখ অলিনেওয়াজ অলিউল্লাহ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড