বৈলপুর-করপার্টি মুক্তিযোদ্ধা বাজার গণকবর (চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা)
বৈলপুর-করপার্টি মুক্তিযোদ্ধা বাজার গণকবর (চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা) কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় অবস্থিত। গণকবরের স্থানটি কুমিল্লা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে ও চৌদ্দগ্রাম থানা থেকে ৪ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। এটি পড়েছে বৈলপুর ও করপাটি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা বাজার সীমানায়। বাজারটি কনকাপৈত ইউনিয়ন এবং বৈলপুর গ্রামটি মুন্সিরহাট ইনিয়নের অংশ। মুক্তিযোদ্ধা বাজারের তিন রাস্তার মোড় ঘেঁষে গণকবরটির অবস্থান। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চৌদ্দগ্রাম বাজার অংশ থেকে আটগ্রাম রাস্তা হয়ে প্রায় ৪ কিলোমিটার পশ্চিমে গণকবরটির স্থান। গণকবরের উত্তর, পশ্চিম ও পূর্ব পাশে বৈলপুর গ্রাম এবং দক্ষিণ পাশে করপাটি গ্রাম। এখানে ৬ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর রয়েছে।
৩রা ডিসেম্বর শুক্রবার ভারতের একাধিক জায়গায় পাকিস্তান বিমান হামলা চালায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া বেতার ভাষণে এর জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে যুদ্ধে ভারতের অংশ নেয়ার বিষয়টি স্পষ্ট করেন। সেদিন রাতে চৌদ্দগ্রাম সীমান্ত হয়ে ভারতীয় সৈন্য ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর একাধিক দল বাংলাদেশে প্রবেশ করে। যৌথবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে চৌদ্দগ্রাম থানা ও আশপাশে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পিছু হটতে থাকে। তারা মহাসড়ক থেকে সরে গিয়ে বৈলপুর ও করপাটি বাজারের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থান নেয়।
ঐদিন সন্ধ্যা থেকে পাকিস্তানিরা করপার্টি বাজারের দক্ষিণ পাশে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদদের পুকুরপাড়ে বাঙ্কার তৈরি করতে শুরু করে। আশপাশের অনেক নিরীহ লোককে জোরপূর্বক ধরে এনে রাতভর তাদের পাহারা দিতে বাধ্য করে। স্থানীয় আব্দুল মালেক ও সেরাজুল হক রাজাকারসহ কয়েকজন এদেশীয় দোসর পাকিস্তানিদের সহায়তা করে। পাকিস্তানি মেজর জং ছিল এ এলাকার দায়িত্বে। স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় দ্রুত তারা নিরাপত্তা ব্যূহ তৈরি করার চেষ্টা করে।
রাত ২টার পর যৌথবাহিনী এগিয়ে আসতে শুরু করে করপার্টি বাজারের দিকে। পাকিস্তানি বাহিনী তখন গুলি ছুড়ে প্রতিহতের চেষ্টা করে। রাত ৩টার দিকে যৌথবাহিনী পাকিস্তানিদের ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। এতে পাকিস্তানিরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এ-সময় অসংখ্য পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। তুমুল যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকসেনারা ৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে ফেলে এবং তাঁদের ৬ জনকে হত্যা করে ১ জনকে সঙ্গে নিয়ে লাঙ্গলকোটের ফরিকোট ক্যাম্পের দিকে পালাতে থাকে। এই মুক্তিযোদ্ধার আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। পালানোর আগে পাকসেনারা তাদের পাহারারত গ্রামবাসীদের গুলি করে হত্যা করে।
ভোরের আলো ফুটলে মুক্তিবাহিনী করপাটি বাজার দখলে নেয়। এ-সময় বহু পাকিস্তানি সেনা ও স্থানীয় নিরীহ লোকজনের লাশ পড়ে থাকতে দেখেন মুক্তিযোদ্ধারা। বেশ কিছু ভারতীয় সৈন্যের লাশও সেখানে পড়ে ছিল।
এখানে গণহত্যায় অসংখ্য লোক নিহত হয়। ৬ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার লাশ শনাক্ত করে বাজারের পাশেই গণকবর দেয়া হয়। গণকবর দেয়ার কাজে অংশ নেন করপার্টি গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস রশিদ, হাজী মঈনুদ্দিন মাস্টার, তাজুল ইসলাম মাস্টার ও মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল হক মজুমদার ইয়াকুব।
এ ঘটনার কারণে স্বাধীনতার পর করপাটি বাজারের নতুন নামকরণ করা হয় করপার্টি মুক্তিযোদ্ধা বাজারে। ঐ গণকবরে সমাহিত শহীদ আব্দুল গোফরান ভূঁইয়ার ছেলে মো. জহিরুল কাইয়ুম কাজলের উদ্যোগে গণকবরটির চতুর্দিকে পাকা দেয়াল করে সংরক্ষণ করা হয়।
এখানে শহীদ ৬ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ৩ জনের পরিচয় জানা গেছে। তাঁরা হলেন— আব্দুল গোফরান ভূঁইয়া (পিতা রইছের রহমান ভূঁইয়া, সেনের খিল, চৌদ্দগ্রাম), মনির হোসেন (বাতিশা, চৌদ্দগ্রাম) এবং মো. রতন মিয়া (মো. আলী আহমদ, চান্দিশকড়া, চৌদ্দগ্রাম)। [বাশার খান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড