You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে বোচাগঞ্জ উপজেলা (দিনাজপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে বোচাগঞ্জ উপজেলা (দিনাজপুর)

বোচাগঞ্জ উপজেলা (দিনাজপুর) দিনাজপুর জেলার ১৩টি উপজেলার একটি। দিনাজপুর শহর থেকে সড়কপথে এর দূরত্ব প্রায় ২৮ কিমি। এর নিকটবর্তী উপজেলা দিনাজপুর জেলার বিরল, কাহারোল, বীরগঞ্জ এবং ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই জেলা শহরের সঙ্গে এর রেল ও সড়কপথে যাতায়াতের ব্যবস্থা আছে। তবে সড়কপথেই যাতায়াত সহজ। উল্লেখ্য যে, উপজেলা ও থানার নাম বোচাগঞ্জ হলেও পৌরসভা, ডাকঘর, রেলস্টেশন, সুগার মিল, স্কুল-কলেজ এবং বাজার সেতাবগঞ্জ নামে পরিচিত। পাকিস্তানি শাসকদের কর্তৃক বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, অর্থনৈতিক শোষণ, সর্বোপরি ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে উপেক্ষা করে বাঙালিদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় দেশের অন্যান্য স্থানের মতো বোচাগঞ্জের সাধারণ মানুষের মধ্যেও প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ- থেকে তারা বুঝতে পারে যে, স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। জেলা শহর দিনাজপুরে প্রতিদিন অনুষ্ঠিত মিছিল ও প্রতিবাদ- সমাবেশের সংবাদ তাদের উদীপ্ত করে তোলে। স্থানীয় বড়মাঠে নিয়মিত সভা-সমাবেশ ও পথসভা হতে থাকে। সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে বড়মাঠ-সংলগ্ন সেতাবগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাব। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর পৈশাচিক গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগ মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। জনসাধারণের মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে ওঠে। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় বোচাগঞ্জের স্বাধীনতাকামী মানুষকে জাগিয়ে তোলে।
আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রউফ চৌধুরী (পরবর্তীতে দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং প্রতিমন্ত্রী)-র নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এ বি এম মোকছেদ আলী এমএনএ, মো. সোলেমান আলী, আনোয়ারুল হক চৌধুরী নবাব, আব্দুস সালাম চৌধুরী, কমরেড খলিলুর রহমান, শেখ আব্দুল হাই, আমিনুল হক চৌধুরী (পরবর্তীতে বোচাগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি), রাধাপদ অধিকারী, অধ্যক্ষ আব্দুর রশীদ, মো. লুৎফর রহমান (মুক্তিযুদ্ধের সময় তার অসীম সাহস ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে ‘পাগলা ঘন্টি’ বলে সম্বোধন করতেন), আব্দুল মাজেদ, মো. ফজলুল হক (হক সাহেব), হবিবর রহমান (মেম্বার, ব্যবসায়ী) প্রমুখ সংগ্রাম কমিটির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ছাত্রনেতা নজরুল ইসলাম নজু, আবু সৈয়দ হোসেন, শেখ আব্দুল হাই এবং পরেশ চন্দ্র সরকার সংগ্রাম কমিটিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। পরবর্তীকালে এঁরাই উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালের শুরু থেকেই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নেতৃত্বে বিভিন্ন কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সংগঠিত হচ্ছিল। তারাসহ আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর নেতা-কর্মী এবং স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম-আদিবাসী সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ সংগ্রাম কমিটির আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সংগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আব্দুর রউফ চৌধুরী ও আনোয়ারুল হক চৌধুরীর পরামর্শে মো. লুৎফর রহমান ১০০ আদিবাসীকে নিয়ে একটি তীরন্দাজ বাহিনী গঠন করেন। সুলতানপুরের কামারদের সহযোগিতায় তীরের ফলা তৈরি করে তা যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়। সেতাবগঞ্জ সুগার মিলের গাড়ি নিয়ে সংগ্রাম কমিটির লোকজন দিনাজপুর কুঠিবাড়ীতে গিয়ে প্রতিরোধে অংশ নেন। এছাড়া তারা সুগার মিলের গাড়িতে দিনাজপুরে প্রতিরোধ অংশগ্রহণকারীদের জন্য খাবার পৌঁছে দিত। ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও থানা আনসারের বেশ কয়েকজন সদস্য প্রতিরোধ সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন। তাঁদের অস্ত্র দিয়ে স্থানীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যান। সেখানে তাঁদের রিক্রুটিং ক্যাম্প ছিল তরঙ্গপুর, ডালিমগাঁও, মালন ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুঁড়ির পানিঘাটায় তাঁদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ হতো। তারপর দেরাদুন ও উত্তর প্রদেশের হাফলং-এ উচ্চতর প্রশিক্ষণ হতো।
২৭শে মার্চ দিনাজপুর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স (কুঠিবাড়ী) বাঙালি ইপিআর সদস্যরা দখল করে নেন। সেখানে অবস্থানরত সকল পাকিস্তানিকে হত্যা করা হয়। এরপর বাঙালি ইপিআর-রা দিনাজপুর শহরের অদূরে কাঞ্চন নদীর ওপারে গিয়ে অবস্থান নেন। অস্ত্রাগার থেকে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ন নদীর ওপারে নিয়ে যাওয়া হয়। নদীর ওপারে গিয়ে কুঠিবাড়ীর উপআোর্কিট হাউজে অবস্থানরত ফ্রন্ট্রিয়ার ফোর্সের প্রায় ১৫০ জন পাকিস্তানি রিজার্ভ সৈন্যের সঙ্গে ইপিআর-রা যুদ্ধে লিপ্ত হন। এ-যুদ্ধ ২-৩ দিন যাবৎ চলে। এপ্রিলের ৩ তারিখ পাকিস্তানি রিজার্ভ সৈন্যরা পার্বতীপুরের দিকে পলায়ন করে। আনসার সদস্য এনামুল হক এ প্রতিরোধ যুদ্ধের সময় ২৯শে মার্চ কাঞ্চন নদীর পাড়ে শহীদ হন। তিনিই বোচাগঞ্জ উপজেলার প্রথম শহীদ|
বোচাগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সময় কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ইদ্রিস আলী, মো. সামশুল আলম, আব্দুর রাজ্জাক, সাইদুর রহমান, আব্দুল মতিন ও মহিদুল ইসলাম। ২৫শে মার্চের পর পাকসেনারা যাতে বোচাগঞ্জে না আসতে পারে সেজন্য রাস্তায় গাছ কেটে এবং গাছের গুঁড়ি ফেলে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। পরবর্তীতে বাঙালি ইপিআরদের আনা অস্ত্র দিয়েও প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও থানা আনসারের বেশ কয়েকজন সদস্য এতে অংশগ্রহণ করেন। ইপিআর মো. মোস্তাফিজুর রহমান অবরোধকার্যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে মো. লুৎফর রহমান ও আব্দুর রউফ চৌধুরী সেতাবগঞ্জ সুগার মিলের ট্রাকে করে ডাবরি ইপিআর ক্যাম্প, জগদল ও কোচল ইপিআর ক্যাম্প থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য মালামাল বোচাগঞ্জে নিয়ে আসেন এবং কাঞ্চন ঘাটে আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক ইউসুফ আলী এমএনএ (স্বাধীনতার পরে মন্ত্রী) ও এ বি এম মোকছেদ আলী এমএনএ-র নিকট সেগুলো হস্তান্তর করেন।
কাহারোল উপজেলার দশ মাইল এলাকায় প্রতিরোধ ভেঙ্গে ১৫ই এপ্রিল পাকবাহিনী পুনরায় দিনাজপুর শহর দখল করে। কাঞ্চন নদীর পাড়ে অবস্থানরত ২০০-র মতো বাঙালি ইপিআর, আনসার সদস্য এবং প্রতিরোধকারীরা পিছু হটে পার্শ্ববর্তী বিরল থানার সীমান্তবর্তী এলাকায় ডিফেন্স তৈরি করে। কিন্তু মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী-র লোকেরা তাদের অবস্থান পাকবাহিনীকে জানিয়ে দেয়। ফলে ১৬ই এপ্রিল পাকবাহিনী বিরল ডিফেন্সের ওপর আক্রমণ চালায়। বিরলের পতনের পর পাকবাহিনী পার্শ্ববর্তী থানা বোচাগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয় এবং ১৯শে এপ্রিল তারা বোচাগঞ্জের দখল নেয়। তেমন কোনো অস্ত্র ও গোলাবারুদ না থাকায় পাকবাহিনীর সামনে প্রতিরোধকারীরা বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি।
পাকবাহিনী বোচাগঞ্জ দখলের সময় চৌরাস্তায় শহীদ পাড়ার মুন্সী আফজাল খাঁকে হত্যা করে। সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দের বাড়িতে হানা দেয়। নেতৃবৃন্দকে না পেয়ে তাঁদের আত্মীয়-স্বজনদের হত্যা করে। অনেককে ধরে নিয়ে যায়। এ-সময় তারা সংগ্রাম কমিটির মূল সংগঠক রউফ চৌধুরীর দুই ভাতিজা, লুৎফর রহমানের চাচা দবিরউদ্দিন ও আন্ধারু আহম্মেদকে হত্যা করে।
তৎকালীন সিও (ডেভলপমেন্ট) অফিস (বর্তমান উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়)-এ পাকবাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ক্যাম্পের মূল দায়িত্বে ছিল সুবেদার আসলাম। এছাড়া উপজেলা সদরের থানা রোডে আনসার ক্লাবে তারা আরেকটি ক্যাম্প স্থাপন করে, যার মূল দায়িত্বে ছিল মমতাজ খান। এ দুই ক্যাম্প কমান্ডার ছিল অত্যন্ত হিংস্র ও প্রচণ্ড বাঙালি-বিদ্বেষী। বাঙালিদের হত্যা এবং নির্যাতন করা এদের কাছে ছিল নেশার মতো। এছাড়া ভারতের সীমান্ত এলাকার হাট-বাজারগুলো, যথা- মাহেরপুর বিওপি, সুকদেবপুর, তেতরা ইত্যাদি স্থানেও পাকবাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। মাহেরপুরে পাকবাহিনী একটি শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে। কারণ এটি বোচাগঞ্জের দক্ষিণে, বিরলের উত্তরে এবং পীরগঞ্জের পূর্বে ভারতে প্রবেশের পথ হওয়ায় ভৌগোলিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পাকবাহিনী এখানে অনেক বাংকার ও স্থাপনা গড়ে তোলে।
সারাদেশের মতো বোচাগঞ্জেও জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের সদস্য, রাজাকার, আলবদর এবং অবাঙালিরা পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করে। এখানকার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল মহসীন চৌধুরী। বোচাগঞ্জের যেসব রাজাকার ও আলবদর মুক্তিযুদ্ধের সময় কুখ্যাত ছিল এবং পাকবাহিনীর নৃশংসতার সহযোগী ছিল, তাদের কয়েকজন হলো- আকিম উদ্দিন ম্যানেজার (বড়মাঠ- সংলগ্ন বোচাগঞ্জ বাজার), আফাজ হাজী (ধনতলা, ঝাড়বাড়ী), গাফফার হাজী (সুবিদাহাট, হাজীপাড়া), ডা. নিয়াজ (সওদাগড়পট্টি, স্টেশন রোড; পল্লী চিকিৎসক), হাজী নাসির উদ্দিন বিহারি (সুবিদাহাট), ওয়ারেছ আলী (ঝাড়বাড়ী, ধনতলা; পিতা-পুত্র উভয়ই রাজাকার), মইনুল ইসলাম মইন বিহারি (মিল রোড, সেতাবগঞ্জ), আবদুল হক খোকা (ছাতৈল), মোহাম্মদ আলী (আনোড়া), আয়নুল মোহাম্মদ (মুরারীপুর), মঞ্জু বাদিয়া (রনগাঁও, চণ্ডীপুর), সোবহান চৌধুরী (বনহারা, ৫নং ছাতৈল ইউনিয়ন; জামায়াত নেতা), আব্দুল জব্বার (সহসপুর), আব্দুল ওয়াহেদ (মুশিদহাট), আব্দুল মতিন (১নং নাফানগর ইউনিয়ন), মুনির উদ্দিন (শেখরপুর), খোকা ডাক্তার (বেলবাস ছাতৈল), আব্দুস সবুর (খনগাঁও), আব্দুস সালাম (খনগাঁও), জান মোহাম্মদ (শেখরপুর), শের মোহাম্মদ (শেখরপুর), ফুলবাবু (মিল রোড) প্রমুখ। এদের মধ্যে রাজাকার মঞ্জু বাদিয়া সবচেয়ে বেশি নৃশংস ছিল। সে নিজহাতে অসংখ্য বাঙালিকে হত্যা ও নির্যাতন করে এবং নারীনির্যাতনে সহায়তা করে। আকিম উদ্দিন ম্যানেজার ছিল আর এক কুখ্যাত রাজাকার। সে রাজাকার, আলবদর ও শান্তি কমিটির নেতৃত্ব দেয়। বোচাগঞ্জে পাকবাহিনী অনেক লোককে হত্যা করে। এপ্রিল মাসের শেষদিকে একদিন বিকেলবেলা ফুলবাড়ি হাট আর্মি ক্যাম্প থেকে পাকসেনারা যখন সেনগ্রামের (পুলহাট থেকে ২ কিমি দক্ষিণে) দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন আত্মরক্ষার্থে পলায়নরত ১১ জন গ্রামবাসীকে পাকসেনারা ধরে এনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। তাদের মধ্যে ৯ জন মারা যায়। নিহতদের সকলেই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। এ হত্যাকাণ্ডের পর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক বয়স্ক লোককে ডেকে পাকসেনারা জানতে চায় সে হিন্দু না মুসলিম। মুসলিম পরিচয় দিলেও এক পর্যায়ে তা নিশ্চিত হতে তাকে লুঙ্গি খুলতে বাধ্য করা হয়। এরপর তাকে দিয়ে গর্ত খুঁড়িয়ে নিহতদের লাশগুলো মাটিচাপা দেয়া হয়। এ হত্যাকাণ্ডের পর রাজাকার খোকা ডাক্তারের নেতৃত্বে এলাকাটিতে ব্যাপক লুটতরাজ এবং বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। খোকা ডাক্তার ছিল বেলবাস, ছাতোল ও সেনগাঁও দিঘি এলাকার ত্রাস।
পাকসেনা ও রাজাকাররা চিলাপাড়া-কৃষ্ণপুর, জেলেপাড়াসহ আশপাশের বিভিন্ন পাড়ার ৬০-৭০টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে হিন্দুদের সব বাড়িই পোড়ানো হয়। রাজাকাররা চিলাপাড়ার পেয়ারি বর্মণ (পিতা সদই বর্মণ), প্রফুল্ল কুমার বর্মণ (পিতা ভদই বর্মণ), চুকুরু বর্মণ (পিতা অদই বর্মণ), ঠোগা বর্মণ (পিতা ধূদিরাম বর্মণ), সূর্যকান্ত, মেলা বর্মণ, যশোদা বর্মণ, বিন্দুরাম বর্মণ, ভুদুরু দাস (পিতা ছেবদেরা দাস), কালিচরণ দাস (পিতা ভদুরু দাস), নগেন দাস, ভেদাই দাস, নেত্রমোহন দাস, টাকুরা দাস, রমেশ দাস, অনন্ত দাসসহ বহু লোকের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। এসব বাড়িতে যখন আগুন দেয়া হয়, তখন বাড়িগুলো ছিল ফাঁকা। বাড়ির লোকজন ভারতে চলে গিয়েছিল। ফাঁকা বাড়ির মালামাল লুটপাট করে রাজাকাররা আগুন ধরিয়ে দেয়।
রাজাকার বাহিনী চিলাপাড়া থেকে মালামাল বোঝাই শতাধিক গরু-মোষের গাড়ি লুট করে। কাহারোল, বীরগঞ্জের জয়নন্দ, দশমাইল, সুজালপুরসহ বিভিন্ন এলাকার লোকজন চিলাপাড়ার ওপর দিয়ে ভারতে যেত। পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তায় রাজাকার বাহিনী তাদের চাল, ডাল, বিছানাপত্র, সোনা-দানা, গরু, মোষ, ছাগল ইত্যাদি মালামাল লুট করে নিত। বাধা দিতে গিয়ে অনেকেই রাজাকারদের হাতে বেদম মারধরের শিকার হয়। মালামাল লুটের সঙ্গে নারী-পুরুষসহ ৫০-৬০ জন লোককে রাজাকাররা ধরে নিয়ে যায়। পরে নারীদের ছেড়ে দিয়ে পুরুষদের আনসার ক্যাম্প ও সিও (ডেভ) ক্যাম্পে নিয়ে হত্যা করা হয়। একই ঘটনা বারবার ঘটেছে দোমোহনী ঘাট দিয়ে ভারতে যাওয়ার সময়। এখানে নারীদের ধরে এনে বন্দি করে পাশবিক নির্যাতন করা হয়। দৌলতপুরে পাকসেনারা মুক্তিযুদ্ধের এক সংগঠকের নিকট আত্মীয়াকে গণধর্ষণ করে। ফুটকিবাড়িতে মে মাসের বিভিন্ন সময়ে ১৪ গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়, যা ফুটকিবাড়ি হত্যাকাণ্ড- নামে পরিচিত।
বেলবাস এলাকায় এক অবস্থাপন্ন কৃষক মো. মনিরুজ্জামানের পুত্র মুক্তিযুদ্ধে যান। এ অপরাধে তাঁর আরেক পুত্র এবং কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনকে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়াতে তাকে বাধ্য করা হয়। তাদের মধ্যে একজন অস্ত্রসহ ভারতে পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। নভেম্বরের শেষদিকে বাঙালিদের বিজয় যখন আসন্ন, তখন পাকসেনারা মো. মনিরুজ্জামানকে কয়েকদিন গাছে ঝুলিয়ে রেখে অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে। বোচাগঞ্জের বিহারিরা বাজারের দোকানপাট ও বাড়িঘর লুট করে এবং হিন্দু অধ্যুষিত মুরারীপুর, পুলহাট ও আশপাশের গ্রামগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় ৷ উপজেলা সিও (ডেভলপমেন্ট) অফিস ক্যাম্পের কাছে বিএডিসি-র সিড অফিসের গোডাউন ঘরে পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্রে রাজাকারআলবদররা অসংখ্য নারীকে ধরে এনে হানাদারদের হাতে তুলে দেয়। পাকবাহিনী তাদের পৈশাচিকভাবে ধর্ষণ-নির্যাতন করে। অনেক নারীকে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। একই নির্যাতনকেন্দ্রে শতশত বাঙালিকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। বোচাগঞ্জ আনসার ক্লাব ক্যাম্পেও পাকসেনা, রাজাকার ও বিহারিরা অসংখ্য নারী-পুরুষকে নির্যাতন ও হত্যা করে। বোচাগঞ্জে পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল মূলত দুটি। প্রথমটি সিও (ডেভলপমেন্ট) অফিসে অবস্থিত পাকবাহিনীর ক্যাম্প (বর্তমানে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়) সংলগ্ন বিএডিসি-র সিড অফিসের গোডাউন ঘর। এখানে পাকবাহিনী, রাজাকার ও আলবদররা শতশত মানুষকে ধরে এনে বন্দি করে অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে হাসপাতালের পাশের রাস্তায় গণকবর দিত। এছাড়া অসংখ্য নারীকে ধরে এনে দিনের পর দিন বন্দি করে রেখে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হতো এবং পরবর্তীতে হত্যা করা হতো।
দ্বিতীয় নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবিরটি হলো থানা রোডের আজিমাবাদ রেল ক্রসিংয়ের পাশে অবস্থিত আনসার ক্লাব ক্যাম্প। পাকসেনা, রাজাকার ও বিহারিরা অসংখ্য মানুষকে এখানে ধরে এনে দিনের পর দিন নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে।
বোচাগঞ্জ মুক্ত হওয়ার পর সেতাবগঞ্জ কলেজের বিভিন্ন কক্ষে মেয়েদের পরিধেয় কাপড়-চোপড়সহ নানা জিনিসপত্র এবং কলেজের পুকুরে কয়েকটি মৃতদেহ পাওয়া যায়। এ থেকে ধারণা করা হয় যে, এখানেও পাকবাহিনী ও রাজাকাররা নারীদের ধরে এনে নির্যাতন করত এবং সেতাবগঞ্জ কলেজ নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
বোচাগঞ্জে বধ্যভূমি হিসেবে সবার কাছে অতিপরিচিত তৎকালীন সিও (ডেভলপমেন্ট) অফিসে অবস্থিত পাকবাহিনীর ক্যাম্প সংলগ্ন বিএডিসি-র সিড অফিসের গোডাউন ঘর (বর্তমান উপজেলা পরিষদের আবাসিক এলাকার পেছনে)। এখানে পাকবাহিনী, রাজাকার ও আলবদররা অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে দিনের পর দিন বন্দি রেখে অমানুষিক নির্যাতন এবং পরে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করে। এ নির্যাতনকেন্দ্রটি ৬ই ডিসেম্বর বোচাগঞ্জ মুক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এলাকাবাসীর কাছে বিভীষিকাময় একটি স্থান হিসেবে পরিচিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ ক্যাম্পের নাম শুনলেই বোচাগঞ্জবাসী আতঙ্কে শিউরে উঠত। এ বধ্যভূমিতে নিহত অসংখ্য বাঙালিকে বর্তমানে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বাসার উত্তর পাশে ও অফিসের ৫০ গজ পূর্বে (যেখানে একটি শিমুল গাছ ও বাঁশঝাড় ছিল) গণকবর দেয়া হয়। ধনতলা গ্রামের এ গণকবর মাকলা বাঁশতলা গণকবর নামেও পরিচিত, যেহেতু তখন এখানে মাকলা বাঁশের ঝোপ ছিল বোচাগঞ্জ মুক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পাকসেনা ও রাজাকাররা এ নির্মম হত্যাকাণ্ড চালায়।
বোচাগঞ্জের আরেকটি বধ্যভূমি হলো থানা রোডের আজিমাবাদ আনসার ক্লাব সংলগ্ন বধ্যভূমি। পাকসেনা, রাজাকার ও বিহারিরা এখানে অসংখ্য মানুষ ধরে এনে দিনের পর দিন নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে। প্রত্যক্ষদর্শী একজন মুক্তিযোদ্ধা (বর্তমানে থানা ডেপুটি কমান্ডার) সামশুল আলমের বর্ণনায় জানা যায় যে, এ আনসার ক্লাব ক্যাম্পের মেঝেতে কয়েক ইঞ্চি পুরু রক্ত জমাট বেঁধে ছিল। আনসার ক্লাব ক্যাম্পের পাশে রেললাইনের ধারের পুকুরটিতে বাঙালিদের হত্যা করে ফেলে দেয়া হতো। এ পুকুরটিও বোচাগঞ্জের আরেকটি গণকবর।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বোচাগঞ্জ থানায় পাকবাহিনীর এডভান্সড ক্যাম্প ছিল মাহেরপুরে। সেখান থেকে পাকসেনারা মুক্তাঞ্চলের দিকে অনবরত মর্টার শেল নিক্ষেপ করত। এর জবাবে ক্যাম্প লক্ষ্য করে মুক্তিসেনারাও পাল্টা গোলাবর্ষণ করতেন। মুক্তাঞ্চল এবং মাহেরপুর ক্যাম্পের মাঝে ছিল টাঙ্গন নদী। বোচাগঞ্জে সম্মুখ যুদ্ধ কম হওয়ার এটি একটি কারণ।
বোচাগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি চোরাগোপ্তা হামলা করেন। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে একটি এবং ইপিআর মোস্তাফিজুরের নেতৃত্বে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি দল এ হামলা চালায়।
এ উপজেলায় উল্লেখযোগ্য কোনো যুদ্ধ হয়নি। এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মাহেরপুরে পাকবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে কয়েকবার খণ্ড যুদ্ধ হয়েছে, যা মাহেরপুর যুদ্ধ নামে পরিচিত। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কয়েকটি অপারেশন পরিচালনা করেন। সেপ্টেম্বর মাসে পার্শ্ববর্তী কাহারোল থানায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জহুরুল ইসলাম এবং অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলহাট ব্রিজ আপারেশন পরিচালিত হয়। এতে ব্রিজ পাহারারত রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে। অপারেশনে ব্রিজটির অংশবিশেষ ধ্বংস হয়ে যায়। নভেম্বর মাসে রামপুর ও হরিশ্চন্দ্রপুর ব্রিজদুটি উড়িয়ে দেয়া হয়। মুক্ত এলাকা মাধবপুর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গিয়ে এ অপারেশন পরিচালনা করেন।
বোচাগঞ্জ কাউন্সিল হাটে হাবিলদার ওসমান গণির নেতৃত্বে মো. লুৎফর রহমানসহ ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা এক্সপ্লোসিভ দিয়ে স্থানীয় রেললাইনটি বিচ্ছিন্ন করে দেন। তাঁরাই সাগুনী নদীর ওপর রেলব্রিজের পশ্চিমাংশ ধ্বংস করে দেন। মো. লুৎফর রহমানের পরামর্শে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক বোচাগঞ্জ এলাকার ৩টি রেলব্রিজ থেকে ২৭ জন রাজাকারকে বন্দি করে নিয়ে আসেন। তাদের ৭নং সেক্টর তরঙ্গপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। ৬ই ডিসেম্বর বোচাগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
বোচাগঞ্জ উপজেলায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনজনের নাম পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন- এনামুল হক (পিতা মজের মোহাম্মদ, ধনতলা), আবুল কাশেম (পিতা আসারু মোহাম্মদ, বেহাগাঁও, সেতাবগঞ্জ পৌর এলাকা) এবং চিনিরাম রায় (পিতা আনন্দ মোহন, মাধবপুর হাট)।
বোচাগঞ্জ উপজেলায় বড়মাঠের পশ্চিম পাশে সেতাবগঞ্জ পৌরসভার প্রাক্তন মেয়র ওমর ফারুক চৌধুরীর উদ্যোগে শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করে সেতাবগঞ্জ পৌরসভা। বোচাগঞ্জের প্রথম শহীদ এনামুল হক স্মরণে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়। উপজেলা রোডের ৪ তলা মোড় থেকে কাহারোল রোড পর্যন্ত সড়কটি ‘শহীদ এনামুল হক সড়ক’ নামে পরিচিত। [মো. হাবিবুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড