You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে বেলকুচি উপজেলা (সিরাজগঞ্জ)

বেলকুচি উপজেলা (সিরাজগঞ্জ) সিরাজগঞ্জ জেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে। মুসলিম লীগ-এর যুগ্ম- সাধারণ সম্পাদক এম এ মতিনের বাড়ি বেলকুচির সোহাগপুর গ্রামে হওয়ায় ভারত বিভক্তির পর থেকে বেলকুচি মূলত মুসলিম লীগ অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে ১৯৬৬ সাল থেকে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মধ্যে মুসলিম লীগ-বিরোধী ও আওয়ামী লীগ-এর পক্ষে নতুন গণজাগরণের সৃষ্টি হয়। এর ফলে ৭০-এর নির্বাচনে বেলকুচির মানুষ আওয়ামী লীগ প্রার্থী আব্দুল মমিন তালুকদারকে এমএনএ এবং কে বি এম আবু হেনাকে এমপিএ নির্বাচিত করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সাতই মার্চের ভাষণ এর পর বেলকুচি উপজেলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরূপ ১০ই মার্চ সাইদুর রহমান (ক্ষিদ্রমাটিয়া)-কে আহ্বায়ক করে বেলকুচিতে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ পরিষদের সদস্যদের মধ্যে মহিউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর (সিরাজগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগ-এর আহ্বায়ক, বেড়াখাড়ুয়া), লুৎফর রহমান মাখন (পলাশডাঙ্গা যুবশিবির-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা, বেড়াখাড়ুয়া), আবু সাঈদ সরকার (সোহাগপুর), আব্দুর রশিদ সরকার (বয়রাবাড়ি), আকতার হোসেন (ক্ষিদ্রমাটিয়া), আমিনুল ইসলাম খান (চন্দনগাতি), জাহাঙ্গীর হোসেন (ক্ষিদ্রমাটিয়া), এ এইচ মতিউর রহমান (সোহাগপুর), আব্দুল হাই সরকার (সোহাগপুর), আলতাফ হোসেন সরকার (সোহাগপুর), এ কে এম নূরুল হুদা মনি (সোহাগপুর), আব্দুল কাদের পান্নু (সোহাগপুর) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
সোহাগপুর সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কার্যালয়টিকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হতো। বেলকুচি থানা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, তাঁদের মধ্যে রায়হান উদ্দিন সরকার (ক্ষিদ্রমাটিয়া), আতিকুর রহমান বাকী (বেড়াখাড়ুয়া), আব্দুস সোবহান খান (আঘরিয়া), ওসমান গণি সরকার (তামাই), হাবিবুর রহমন দালাল (সোহাগপুর), আব্দুল মজিদ সরকার (চালা), সন্তোষ কুমার প্রামাণিক (দেলুয়া), কদ্দুস মোল্লা (সোহাগপুর), আব্দুল লতিফ খান (সোহাগপুর) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এ-সময় দেলুয়া প্রগতি মজলিশের কার্যালয় থেকে বেলকুচি আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের প্রচার-প্রচারণা চালাতেন।
বেলকুচি উপজেলার বানিয়াগাতী হাইস্কুল, তামাই হাইস্কুল, সোহাগপুর বাজার এবং দেলুয়া প্রগতি মজলিশের সামনে বাঁশের লাঠি ও ডামি রাইফেল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। তাছাড়া এ অঞ্চলের অনেক ছাত্র-যুবক পার্শ্ববর্তী কামারখন্দ উপজেলার ভদ্রঘাটে পলাশডাঙ্গা যুবশিবির থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তারা ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধের উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেন।
বেলকুচি উপজেলায় যুদ্ধকালীন কমান্ডারদের মধ্যে নজরুল ইসলাম (পিতা আফতাব উদ্দিন সরকার, চন্দনগাতী), মহসীন আলী (পিতা মোজাম্মেল হক, আদাচাকি) ও আব্দুল হামিদ আকন্দ (পিতা সেকান্দার আলী আকন্দ, শাহপুর), জহুরুল ইসলাম (মুজিব বাহিনী, রাজাপুর), মাজেদ আলী মিয়া (গ্রুপ কমান্ডার, গোপালপুল), সাইদুর রহমান, মতিয়ার রহমান (সোহাগপুর), মোকাদ্দেস মাস্টার (গয়লা হোসেন), শহীদুর রেজা (ডিমুলেশন গ্রুপ লিডার), বাবর আলী (সেকশন কমান্ডার), আহসান হাবীব (কোম্পানি কমান্ডার, কাদেরিয়া বাহিনী), এ টি এম শামীম পান্না (কোম্পানি কমান্ডার), আবদুর রাজ্জাক (গ্রুপ কমান্ডার, শাহপুর), আতিকুর রহমান বাকী (মুজিব বাহিনী) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকবাহিনী গানবোটযোগে বেলকুচি আক্রমণ করতে আসছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে বেলকুচির আওয়ামী লীগ, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ এবং কয়েকশ মুক্তিকামী মানুষ বাঁশের লাঠি, ফালা-বল্লম, সড়কি, লাইসেন্সকৃত বন্দুক ইত্যাদি নিয়ে দেলুয়া যমুনা নদীর ঘাটে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য এগিয়ে যায়। কিন্তু পাকবাহিনী না আসায় প্রতিরোধকারী জনতা সেদিন নদীর ঘাট থেকে ফিরে আসে।
২৭শে এপ্রিল পাকবাহিনী বেলকুচিতে অনুপ্রবেশ করে এবং বেলকুচি থানায় তাদের অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। তাছাড়া মুসলিম লীগ নেতা এম এ মতিনের ক্যালেন্ডার মিলটিকে তারা অস্থায়ী ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করে। তবে এসব ক্যাম্পে রাজাকার ও মিলিশিয়া বাহিনী সার্বক্ষণিক অবস্থান করত। পাকবাহিনী প্রতিদিন সিরাজগঞ্জ থেকে বেলকুচিতে এসে বিভিন্ন এলাকা রেইড করে আবার সিরাজগঞ্জে চলে যেত।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই আবদুল জলিল ওরফে চাঁন মিয়া (সোহাগপুর)-কে সভাপতি ও শহীদুল্লাহ খান (সোহাগপুর)- কে সেক্রেটারি করে বেলকুচি থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটির সদস্যদের মধ্যে পিটিশন চান (দেলুয়া), আফসার ডাক্তার (সুবর্ণসারা), আনজীর আলী (ক্ষিদ্রামাটিয়া), আকছেদ আলী (দেলুয়া), আব্দুর রাজ্জাক (সোহাগপুর), ঈমান আলী (ক্ষিদ্রামাটিয়া), লুৎফর রহমান (বিমালারী), মো. আবদুল আজিজ (ক্ষিদ্রামাটিয়া), মোর্তুজা আলী (ক্ষিদ্রামাটিয়া), সফিউদ্দিন (ক্ষিদ্রামাটিয়া), হায়দার আলী (সোহাগপুর), আবুল পাশা (সোহাগপুর), আব্দুল জলিল মিয়া (সোহাগপুর), আব্দুল আজিজ (সোহাগপুর), আলাউদ্দিন (সোহাগপুর), এম এ মতিন (সোহাগপুর), মোজাম্মেল হক (সোহাগপুর), মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ খান (সোহাগপুর), সাবু মিয়া (সোহাগপুর), সেরাজুল হক (সোহাগপুর), হাবিবুর রহমান (সোহাগপুর), শামসুদ্দিন (লক্ষ্মীপুর), নূরুল হুদা (বেড়াখারুয়া), কাজী আবদুল হাকিম (দেলুয়া), তসলিম উদ্দিন (সোনাগ্রাম), মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন (ভাতুনিয়া), মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন (গয়নাকান্দি), মো. বুদু আলী সরকার (চালা), মোহাম্মদ শাহেদ আলী (বিমালারী) এদের নাম উল্লেখযোগ্য।
পাকবাহিনী তাদের দোসর রাজাকারদের সহযোগিতায় ১৩ই মে বেলকুচি থানার বয়ড়াপাড়া গ্রামে গণহত্যা চালিয়ে ১৭ জনকে হত্যা করে যা, বয়ড়াপাড়া গণহত্যা নামে পরিচিত। সেদিন রায়পাড়া গ্রামের ১০ জন নারী পাকবাহিনী কর্তৃক পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। লুটপাট শেষে হানাদাররা গ্রামটি পুড়িয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকবাহিনী সমেশপুর গ্রামের তিনজন নারীর সম্ভ্রমহানি করে। লুণ্ঠন শেষে গ্রামটিতে অগ্নিসংযোগ করে। স্থানীয় রাজাকাররা রাজাপুর, মাঝাইল ও নাকফাটা গ্রামে লুণ্ঠন চালায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রাজাকারদের সহযোগিতায় তামাই বাজার, নাকফাটা গ্রামের আব্দুল মমিন তালুকদার এমএনএ, বেড়াখাড়ুয়া গ্রামের কে বি এম আবু হেনা এমপিএ, আতিকুর রহমান বাকী ও লুৎফর রহমান মাখনের বাড়িসহ গ্রামগুলো পুড়িয়ে দেয়। এছাড়া তামাই পশ্চিমপাড়া, ধুকরিয়া, গোপালপুর, সগুনা, মেটুয়ানী ও কল্যাণপুর গ্রামেও অগ্নিসংযোগ করে।
যুদ্ধকালীন সময়ে বেলকুচি থানা ও এম এ মতিনের ক্যালেন্ডার মিলটি পাকবাহিনী নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করত। আগস্ট মাসের মাঝামঝি সময়ে কমান্ডার ফারুক ইকবালের নেতৃত্বে টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনী-র ১০-১৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি গ্রুপ বেলকুচি থানার তামাই পশ্চিমপাড়ায় অবস্থান করছিল। এ সংবাদ পাকবাহিনী জেনে যায়। ২১শে আগস্ট ভোরে পাকবাহিনী তিনটি লঞ্চযোগে তামাই পশ্চিমপাড়ার পাশে হুররাসাগর নদীর তীরে নামছে খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত পজিশনে যান। সেখানে পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়, যা – তামাই পশ্চিমপাড়া যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ-যুদ্ধে দুজন মুক্তিযোদ্ধাসহ ৪ জন শহীদ এবং ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
বেলকুচি থানায় রাজাকার ও মিলিশিয়া বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। পাকবাহিনী প্রতিদিন সিরাজগঞ্জ থেকে বেলকুচিতে এসে তাদের সহযোগিতায় বিভিন্ন গ্রামে অভিযান চালিয়ে সন্ধ্যার পূর্বেই সিরাজগঞ্জ ফিরে যেত। রাজাকার ও মিলিশিয়াদের শায়েস্তা করার জন্য আমির হোসেন ভুলু (কাজিপুর)-র পরিকল্পনায় মুক্তিযোদ্ধারা বেলকুচি থানা অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন এবং রেকি করার দায়িত্ব দেয়া হয় আদাচাকি গ্রামের সাঈদ আহমেদকে। তিনি বেলকুচির সাপ্তাহিক হাটে তেল, লবণ ইত্যাদি কেনার অজুহাতে রেকির কাজ সমাপ্ত করেন। অতঃপর আমির হোসেন ভুলুর নেতৃত্বে খ ম আক্তার হোসেন, ফজলুর মতিন মুক্তা, সোহরাব হোসেন, আব্দুল বারী, সাইদুর রহমান প্রমুখের সঙ্গে রেকির রিপোর্ট নিয়ে পর্যালোচনা সভা শেষে বেলকুচি থানা অপারেশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
১২ই সেপ্টেম্বর ভোররাতে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তিনদিক থেকে বেলকুচি থানায় আক্রমণ চালান। এই অতর্কিত আক্রমণে রাজাকার ও মিলিশিয়ারা দিশেহারা হয়ে অল্প সময় পরেই মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। বেলকুচি থানা অপারেশনে রাজাকার শাহজাহান আলী (সোহাগপুর)-সহ চারজন মিলিশিয়া নিহত এবং ১৫ জন বন্দি হয়।
৫ই ডিসেম্বর বেলকুচি থানার রাজাপুর ইউনিয়নের সমেশপুর ওয়াপদা বাঁধে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এক ভয়াবহ যুদ্ধ হয়, যা সমেশপুর যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ-যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে কাদেরিয়া বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার হাবিবুর রহমান (সিংগুলীর চর, কালিহাতী) শহীদ হন। ১৪ই ডিসেম্বর বেলকুচি উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- আবু বকর সিদ্দিকী, বীর বিক্রম (পিতা মনসুর আলী, দেলুয়াকান্দি)। বেলকুচি উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আবু বকর সিদ্দিকী, বীর বিক্রম (রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের পাশে শহীদ), মোজাফফর হোসেন মির্জা (পিতা আব্দুস সাত্তার, ক্ষিদ্রমাটিয়া), বাহাদুর আলী (পিতা মছের আলী, রাজাপুর), গোলাম সরওয়ার (পিতা মজিবর রহমান ভুইয়া, তামাই) ও আবদুর রহমান (পিতা আফাজ উদ্দিন, নিশিবয়রা)।
সমেশপুর ওয়াপদা বাঁধের পাশে শহীদ হাবিবুর রহমানের নামে একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। তামাই পশ্চিমপাড়া কবরস্থানে তামাই যুদ্ধে শহীদ হাসানুজ্জামান লেবু ও শহীদ গাজীয়ার রহমানের সমাধিসৌধ নির্মিত হয়েছে। বেলকুচি ডিগ্রি কলেজের পাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ম্যুরাল তৈরি করা হয়েছে এবং ঐ স্থানের নামকরণ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু স্কয়ার’। [মো. সোলায়মান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!