You dont have javascript enabled! Please enable it! বেলতলী গণকবর (লাকসাম, কুমিল্লা) - সংগ্রামের নোটবুক

বেলতলী গণকবর (লাকসাম, কুমিল্লা)

বেলতলী গণকবর (লাকসাম, কুমিল্লা) কুকুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার লাকসাম রেলওয়ে জংশন এলাকার নিকটবর্তী স্থানে অবস্থিত। লাকসাম রেলওয়ে জংশনের উত্তর-দক্ষিণে কেবিন ব্লকের বিপরীত পাশের স্থানের নাম বেলতলী। বেলতলী গণকবরের পূর্বদিকে পাইকপাড়া, পশ্চিমে নসরতপুর, উত্তরে বড়তুপা এবং দক্ষিণে মিশ্রি গ্রাম অবস্থিত। সংখ্যার দিক বিবেচনায় বৃহত্তর কুমিল্লার মধ্যে বেলতলী গণকবর ছিল সর্ববৃহৎ।
১৫ই এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী লাকসামে প্রবেশ করে লাকসাম-কুমিল্লার প্রধান সড়কের পূর্বপাশের রেলওয়ে জংশন সংলগ্ন স্থানে অবস্থিত বিহারি আবদুল মান্নানের মালিকানাধীন “থ্রি-এ সিগারেট ফ্যাক্টরি’-তে (চাঁদপুর টোব্যাকো কোম্পানি) ক্যাম্প স্থাপন করে। ঐদিন থেকে শুরু করে ১১ই ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা এ ফ্যাক্টরিকে নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করে। থ্রি-এ সিগারেট ফ্যাক্টরি ক্যাম্পটি লোকজনের নিকট মিনি ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে পরিচিত ছিল। কুমিল্লার দক্ষিণ অঞ্চলের মধ্যে এটি ছিল পাকবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। এ ঘাঁটিকে কেন্দ্র করে যে স্থানটিতে নির্মম হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন করা হতো, সেটি বেলতলী বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। এখানে অসংখ্য লোকজনকে অকথ্য নির্যাতনের পর হত্যা করে একসঙ্গে মাটিচাপা দেয়া হয় বলে এটি বেলতলী গণকবর হিসেবে পরিচিতি পায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, রাজাকার বাহিনী ও স্থানীয় মুসলিম লীগ- অনুসারীদের সহযোগিতায় লাকসাম ও তার আশপাশের অঞ্চলের গ্রামগুলোতে অভিযান চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন, হিন্দু-বৌদ্ধ ও আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থকসহ সাধারণ লোকজন এবং আখাউড়া, চাঁদপুর, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের সংযোগস্থল লাকসাম রেলওয়ে জংশনে রেলগাড়িতে আসা যাত্রীদের ধরে বেলতলীতে এনে অকথ্য নির্যাতন শেষে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়া হতো।
পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সন্দেহভাজন পুরুষদের নির্মম শারীরিক নির্যাতন করে কখনো গুলি করে, কখনো ব্রাশফায়ার করে, কখনো বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে- খুঁচিয়ে হত্যা করত। নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের পর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে আনন্দ-উল্লাস করত। এরপর মৃত ও অর্ধমৃত এসব নারী-পুরুষদের গর্ত করে বেলতলী নামক স্থানে মাটিচাপা দিত। দু-একদিন পরপরই ২০-২৫টি লাশ এক সঙ্গে কবর দেয়া হতো। পাকসেনা ও তাদের দোসররা রেলওয়ে জংশনের মালী মণীন্দ্র চন্দ্ৰ, উপেন্দ্র, শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীদামচন্দ্রকে বাধ্য করত লাশগুলো নির্যাতনকেন্দ্র থেকে টেনে-হিঁচড়ে বেলতলীতে নিয়ে মাটিচাপা দিতে। তাছাড়া যাদের দ্বারা দিনের বেলায় গর্ত করানো হতো, রাতের বেলায় তাদেরও ঐসব গর্তে মৃত ও অর্ধমৃত অবস্থায় মাটিচাপা দিত। [ইমন সালাউদ্দিন]
বেলতলী বধ্যভূমি (লাকসাম, কুমিল্লা) কুমিল্লা জেলাধীন লাকসাম উপজেলার লাকসাম রেলওয়ে জংশন এলাকার নিকটবর্তী স্থানে অবস্থিত। গণহত্যানির্যাতনের ব্যাপকতা ও সংখ্যার দিক বিবেচনায় বৃহত্তর কুমিল্লার মধ্যে বেলতলী বধ্যভূমি ছিল সর্ববৃহৎ। ১৫ই এপ্রিল থেকে ১১ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকবাহিনী স্থানীয় দোসরদের সহযোগিতায় লাকসাম ও এর আশপাশের গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে শতশত লোক ধরে এ স্থানে এনে অকথ্য নির্যাতন শেষে হত্যা করে। লাকসাম রেলওয়ে জংশনের উত্তর-দক্ষিণে কেবিন ব্লকের বিপরীত স্থানের নাম বেলতলী। কোনো এক সময় অধিক সংখ্যক বেলগাছ থাকার কারণে এ স্থানটির নাম বেলতলী হয় বলে ধারণা করা হয়। প্রায় তিন হাজার বর্গমিটার আকৃতির বেলতলী বধ্যভূমির পূর্বে পাইকপাড়া, পশ্চিমে নসরতপুর, উত্তরে বড়তুপা এবং দক্ষিণে মিশ্রি গ্রাম অবস্থিত। ১৫ই এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী লাকসামে প্রবেশ করে লাকসাম- কুমিল্লার প্রধান সড়কের পূর্বপাশের রেলওয়ে জংশন সংলগ্ন বেলতলীতে অবস্থিত বিহারি আবদুল মান্নানের মালিকানাধীন “থ্রি-এ সিগারেট ফ্যাক্টরি’-তে (চাঁদপুর টোব্যাকো কোম্পানি) ক্যাম্প স্থাপন করে। ১৫ই এপ্রিল থেকে শুরু করে ১১ই ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা এ ফ্যাক্টরিকে নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করে। থ্রি-এ সিগারেট ফ্যাক্টরি ক্যাম্পটি লোকজনের নিকট মিনি ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে পরিচিত ছিল। কুমিল্লার দক্ষিণ অঞ্চলের মধ্যে এটি ছিল পাকবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। বৃহত্তর লাকসামে পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সবচেয়ে নির্মম ও জঘন্যতম নির্যাতনকেন্দ্র ছিল থ্রি-এ সিগারেট ফ্যাক্টরি। এ নির্যাতনকেন্দ্রকে কেন্দ্র করে যে স্থানটিতে নির্মম হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন সংঘটিত হয়, সেটি হচ্ছে বেলতলী বধ্যভূমি। এ ক্যাম্পের প্রধান দায়িত্বে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেজর মুজাফ্ফর হাসান গাদ্দার্জী ও ক্যাপ্টেন ওবায়দুর রহমান। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্যাতনকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজাকার বাহিনী ও স্থানীয় মুসলিম লীগ- অনুসারীদের সহযোগিতায় বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে লাকসাম ও তার আশপাশের অঞ্চলের গ্রামগুলোতে অভিযান চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন এবং আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থকসহ সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিত।
আখাউড়া, চাঁদপুর, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের সংযোগস্থল ছিল লাকসাম জংশন। ফলে এ স্থান দিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য লোকজন যাতায়াত করত। চেকপোস্ট বসিয়ে পাকবাহিনী বিভিন্ন দিক থেকে রেলগাড়িতে আসা যাত্রীদের নামাত। পুরুষ যাত্রীদের মধ্যে কাউকে-কাউকে হয়রানি ও মারধর করে ছেড়ে দিত, আর তরুণ ও মধ্যবয়সী পুরুষ যাত্রীদের মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে ধরে নির্যাতনকেন্দ্রে নিয়ে বন্দি করে রাখত। পুরুষের পাশাপাশি যৌন-লালসা মেটানোর জন্য যুবতি ও মধ্যবয়সী নারীদেরও এখানে ধরে নিয়ে আসত। নারীদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল হিন্দু যুবতি। আবার তাদের অধিকাংশ ছিল ফেনী, গুণবতী, নাঙ্গলকোট, সোনাইমুড়ি, নাথেরপেটুয়া, চাঁদপুর, শাহরাস্তি, চিতোষী প্রভৃতি অঞ্চলের ট্রেনযাত্রী। পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা শুধু ট্রেনের যাত্রীদের নয়, লাকসাম ও তার আশপাশের গ্রাম বিশেষ করে হিন্দু ও বৌদ্ধ অধ্যুষিত পাড়াগুলো থেকে অসংখ্য নারী-পুরুষকে ধরে এনে বন্দি করে রাখত মৃত্যুপুরী থ্রি-এ সিগারেট ফ্যাক্টরিতে। তাদের এ বর্বর কাজের প্রধান সহযোগী ছিল লাকসাম জিআরপি থানার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা বিহারি হাবিলদার বাকাওয়ালী। অত্র অঞ্চলের পাকবাহিনীর দোসর রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা ছিল বাকাওয়ালীর অন্যতম সহযোগী। যেসব নারী-পুরুষকে এখানে ধরে আনা হতো, রাতভর তাদের ওপর চলত নিষ্ঠুর নির্যাতন। নারী-পুরুষ উভয়কে বিবস্ত্র করে তাদের ওপর চালানো হতো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। নারীদের রাখা হতো কখনো উলঙ্গ, কখনো অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায়। পাকসেনারা দল বেঁধে এসে নারীদের ওপর গণধর্ষণ চালাত। নারী-পুরুষরা নির্যাতিত হতে-হতে যখন মৃতপ্রায় হতো, তখন তাদের টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হতো রেলওয়ে জংশন সংলগ্ন বেলতলীতে। পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহভাজন পুরুষদের নির্মম শারীরিক নির্যাতন করে কখনো গুলি করে, কখনো বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে হত্যা করত। নারীদের ওপর তারা শুধু শারীরিক-মানসিক নির্যাতন ও ধর্ষণকার্য করেই ক্ষান্ত হতো না, তাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে আনন্দ-উল্লাস করত। এরপর মৃত ও অর্ধমৃত এসব নারী-পুরুষকে গর্ত করে বেলতলীতে মাটিচাপা দিত।
সহস্রাধিক মানুষ বেলতলীতে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হলেও স্থানীয় কয়েকজন ছাড়া অন্যদের নাম জানা সম্ভব হয়নি, কারণ তারা ছিল রেলপথে দূর-দূরান্ত থেকে আগত অজানা-অচেনা মানুষ। স্থানীয় যে কয়েকজনের নাম জানা গেছে, তারা হলেন- আবদুল খালেক (মিশ্রি, লাকসাম; মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সমাজকর্মী ও আনসার কমান্ডার), আবদুস সোবহান (পাইকপাড়া, লাকসাম; কুমিল্লা দক্ষিণ মহকুমা ছাত্রলীগ-এর সাধারণ সম্পাদক), ছেরাগ আলী (ছাত্র), নুরু মিয়া (বাইনচাটিয়া, লাকসাম) প্রমুখ।
লাকসাম থ্রি-এ সিগারেট ফ্যাক্টরি নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবিরকে কেন্দ্র করে বেলতলী বধ্যভূমিতে নির্মম হত্যাকাণ্ডে পাকবাহিনীকে যারা সহযোগিতা করে, তারা হলো— সাজেদুল হক (৭০-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগ থেকে এমএনএ পদপ্রার্থী), আবদুল হাকিম মিয়া এমপিএ (৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত; মুক্তিযুদ্ধকালে পক্ষ ত্যাগ করে হানাদার বাহিনীর দোসরে পরিণত হয়), বিহারি বাকাওয়ালী (লাকসাম জিআরপি থানার হাবিলদার), আকবর খান (লাকসাম জিআরপি থানার সুবেদার), মুস্তাফা খান (লাকসাম জিআরপি থানার সুবেদার), মো. সফিকুল ইসলাম (লাকসাম জংশনের অফিস সহকারী), শওকত আলী বিহারি ও ইউনুস আলী বিহারি (লাকসাম রেলওয়ে ড্রাইভারের ২ পুত্র), আদম সফিউল্লাহ্ (স্থানীয় রাজাকার), ডা. রফিক, মাওলানা ওয়াদুদ প্রমুখ। সরকারি উদ্যোগে বর্তমানে বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। [ইমন সালাউদ্দিন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড