You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে বেলাব উপজেলা (নরসিংদী)

বেলাব উপজেলা (নরসিংদী) ১৯৭১ সালে বৃহত্তর ঢাকা জেলার রায়পুরা থানার অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমানে এটি নরসিংদী জেলাধীন। ১৯৮৫ সালে মনোহরদী থানার ৩টি ও রায়পুরা থানার ৪টি ইউনিয়ন নিয়ে বেলাব উপজেলা গঠিত হয়। এর উত্তরে কিশোরগঞ্জ জেলা, পূর্বে কুলিয়াচর ও ভৈরব উপজেলা, দক্ষিণে রায়পুরা উপজেলা এবং পশ্চিমে মনোহরদী উপজেলা।
বাহান্নর ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে এ উপজেলার অধিবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ- নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের অধিবেশন ১লা মার্চ স্থগিত ঘোষিত হলে দেশের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু ২রা মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দেন। সারাদেশের মানুষের মতো এ উপজেলার মানুষও তাতে সক্রিয়ভাবে যোগ দেয়। ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান)-এ প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেন। সে অনুযায়ী এ উপজেলার মানুষ সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। এদিকে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার বেড়েই চলে। ২৫শে মার্চ রাতে তারা অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং গণহত্যা চালায়। বঙ্গবন্ধু ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। বেলাব উপজেলার মানুষ তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
এখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে আবদুল হাই, গয়েস আলি মাস্টার, শমসের আলী ভূঁইয়া, সিরাজ মাস্টার, সুরোজ ফকির, আলেক মাস্টার এবং আবদুল গফুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এঁরা বাঁশের লাঠি প্রস্তুত করে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেন এবং ট্রেনিংএর ব্যবস্থা করেন। তৎকালীন আইন পরিষদ সদস্য আফতাব উদ্দিন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুট করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য এ এলাকার স্থল ও নৌ পথে গাজীপুর, কাপাসিয়া, মনোহরদী, বেলাব ও ভৈরব হয়ে ভারতের আগরতলায় গমন ছিল সর্বাপেক্ষা নিরাপদ। জুলাই মাসের প্রথম দিক থেকে দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ-সময় নদী-নালা পানিতে ভরে যাওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সন্ধানে প্রায়শ নৌপথে টহল দিত।
মুক্তিযুদ্ধকালে বেলাব অঞ্চল ছিল ৩নং সাব-সেক্টরের অধীন এ সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন সুবেদার মেজর নুরুল আজিম চৌধুরী। রায়পুরা, শিবপুর, মনোহরদী ও কুলিয়ারচরে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি থাকলেও বেলাবতে তারা কোনো ঘাঁটি স্থাপন করতে পারেনি। রায়পুরা থেকে শিবপুর ও মনোহরদী থেকে কুলিয়ারচর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা ছিল মুক্তাঞ্চল এবং মুক্তিবাহিনীর অবাধ বিচরণক্ষেত্র। নদী- নালা, খাল-বিল, গাছ-গাছালি, ঝোপ-ঝাড় ও পাটক্ষেত অধ্যুষিত প্রাকৃতিক পরিবেশ এ উপজেলাকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত করেছিল।
জুলাই মাসের প্রথম দিকে পাকবাহিনীর একটি টহল দল লঞ্চযোগে প্রথম বেলাব উপজেলায় প্রবেশ করে। তবে এখানে তারা কোনো ক্যাম্প স্থাপন করতে পারেনি। দখলদার বাহিনী মাঝে-মধ্যে ভৈরব এবং টোক থেকে নদীপথে এ এলেকায় এসে টহল দিত।
বেলাব উপজেলায় আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো রাজাকার, আলবদর বা আলশামস বাহিনী গঠিত হয়নি। পুরো এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে থাকায় এবং পাকবাহিনী এলাকায় কোনো স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করতে না পারয় স্বাধীনতাবিরোধীদের তৎপরতা ছিল না। নরসিংদী কলেজের খলিলুর রহমান এবং আকতার উদ্দিন নামে এক ব্যাক্তি অত্র এলাকার রাজাকার হিসেবে পরিচিত ছিল। তারা পাকবাহিনীর নিকট বিভিন্ন খবর পৌঁছাত। খলিলুর রহমানকে মুক্তিযোদ্ধারা পিটিয়ে মেরে ফেলেন।
১৪ই জুলাই সংঘটিত বেলাব যুদ্ধএর পর পাকবাহিনী বড়িবাড়ি এলাকায় গণহত্যা চালায় এবং অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটায়। বড়িবাড়ি গণহত্যায় ৭০ জনের মতো সাধারণ মানুষ নিহত হয়। তাদের নদীর পাড়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যাশেষে লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়। এছাড়া পাকিস্তানি বাহিনী বিভিন্ন স্থানে আরো কয়েকজনকে হত্যা করে। তাদের মধ্যে আমলাব গ্রামের অবু হানিফ একজন।
ল ২০শে নভেম্বর সকালে হানাদার বাহিনী বেলাব বাজার ও মরজালে নূরু মেম্বারের বাড়িসহ অসংখ্য ঘরবাড়ি ও দোকানপাট জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। সেখান P থেকে তারা আমলাবতে চৌধুরী মেম্বারের বাড়ি, উজিলার আব্দুল হাই, আব্দুল খালেক মাস্টার ও ধুকুন্দির কালা গাজীর , বাড়িঘর ও সহায়-সম্পত্তি আগুনে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এরপর ধুকুন্দি থেকে তারা বেলাব এসে নদী পার হয়ে রায়পুরায় ফিরে যায়।
বেলাব যুদ্ধের ৩দিন পর ভৈরব থেকে একটি টহল গানবোট আড়িয়াল খাঁ নদীতে এসে বেলাব বাজার ও বাজারের দক্ষিণ পাশে একটি বড় বটগাছকে লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করে ভৈরবে ফিরে যায়।
বেলাব উপজেলায় একটি গণকবর রয়েছে। সেটি হলো সরলাবাদ ইউনিয়নের ইব্রাহিমপুর গণকবর।
পাকবাহিনীর সঙ্গে বেলাব থানার মুক্তিযোদ্ধাদের একটিই যুদ্ধ হয়, সেটি হলো বেলাব যুদ্ধ। ১৪ই জুলাই এ-যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। যুদ্ধের পর পাকসেনারা এলাকায় নির্মম হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন চালায়। ১৭ই জুলাই বেলাব উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
বেলাব উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— কমান্ডার আবুল বাশার, আনসার কমান্ডার মোমতাজ, নূরু মিয়া, সোহ্রাব ও আ. বারিক।
বেলাব উপজেলায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশার ও আমলাব গ্রামের শহীদ আবু হানিফের কবর রয়েছে। আমলাব ইউনিয়নে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আবদুল হাই স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে। [এম আর মাহবুব]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!