You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.14 | বেলাব যুদ্ধ (বেলাব, নরসিংদী) - সংগ্রামের নোটবুক

বেলাব যুদ্ধ (বেলাব, নরসিংদী)

বেলাব যুদ্ধ (বেলাব, নরসিংদী) সংঘটিত হয় ১৪ই জুলাই। এতে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। যুদ্ধের পর পাকসেনারা এলাকায় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায়।
পাকসেনাদের একটি দল ১লা জুলাই ৩টি লঞ্চে করে নদীপথে কিশোরগঞ্জের টোক থেকে বেলাব হয়ে ভৈরবে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা করে। ১৩ই জুলাই বেলাব ডোমরাকান্দা বাজারে তারা যাত্রাবিরতি করে। এদিন সন্ধ্যায় বাজনাবের জাফর আলী ইঞ্জিনিয়ারের বাড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারেন যে, পাকবাহিনীর লঞ্চগুলো পরদিন খুব সকালে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র দিয়ে বেলাব বাজারের দিকে আসবে। মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নেন পাকসেনারা বেলাবর দিকে অগ্রসর হলে বড়িবাড়ি কুটি থেকে তাদের বহনকারী লঞ্চগুলোতে আক্রমণ করা হবে। এ আক্রমণে টোকে অবস্থানরত আকমল বাহিনীর অংশগ্রহণ করার কথা ছিল। কিন্তু যোগাযোগের অব্যবস্থা ও সময়ের সংক্ষিপ্ততার কারণে আকমল বাহিনীকে সংবাদ দেয়া সম্ভব হয়নি। শুধু স্থানীয় সুবেদার আবুল বাশারের বাহিনীই আক্রমণ করবে মর্মে সিদ্ধান্ত হয়।
১৩ই জুলাই সূর্যাস্তের পর এলাকাবাসীকে সতর্ক করা হয় তারা যেন পরদিন সকালের মধ্যেই অন্যত্র সরে যায়। সুবেদার বাশারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের এ দলটি ১৪ই জুলাই সকাল ৭টার পূর্বে আনর আলী গোদারাঘাট (বর্তমান বেলাব-ফরিদপুর আড়িয়াল খাঁ ব্রিজ) হয়ে বড়িবাড়ি ও ভাংগার ঘাট এলাকায় আড়িয়াল খাঁ নদীর পাড় বরাবর অবস্থান নেয়। পুলিশ, আনসার ও নিয়মিত সেনাসদস্য নিয়ে মোট ২৫ জনের এ দলটিকে ৩টি সেকশন বিভক্ত করে আড়িয়াল খাঁ নদী বরাবর প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করা হয়। উক্ত দলের সঙ্গে ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১০ জন এফএফ সদস্যও যুদ্ধে অংশ নেন। অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের মধ্য ১টি রকেট লন্সার, ১টি ২ ইঞ্চি মর্টার, এসএলআর এবং ৩০৩ রাইফেল ছিল।
নদী তখন বর্ষার পানিতে পূর্ণ। সকালে ডোমরাকান্দা থেকে দখলদার বাহিনীর লঞ্চগুলো পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে অগ্রসর হয়ে আড়িয়াল খাঁ নদীতে এসে বেলাব বাজারের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পূর্ব থেকে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে পান যে, পরপর তিনটি লঞ্চ এগিয়ে আসছে। কয়েকটি ছৈওয়ালা নৌকা সামনে ও পেছনে রেখে লঞ্চগুলোর সামনেরটি যখন রকেট লন্সারের অবস্থানের সামনে চলে আসবে, তখনই লঞ্চকে লক্ষ করে রকেট ছুড়ে আক্রমণের সূচনা করা হবে। কিন্তু ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের দক্ষিণ দিকের অবস্থানের দিকে অগ্রসরমাণ লঞ্চের সামনে একটি ছৈওয়ালা নৌকাকে দ্রুত ঘাটের দিকে আসতে দেখে মুক্তিযোদ্ধা আনসার কমান্ডার মোমতাজ নৌকার মাঝিকে সন্দেহবশত চ্যালেঞ্জ করেন। সঙ্গে-সঙ্গে নৌকা থেকে গুলি বর্ষণ করলে মোমতাজ গুলিবিদ্ধ হয়ে তৎক্ষণাৎ শাহাদৎ বরণ করেন। মোমতাজের আকস্মিক মৃত্যু ও শত্রুপক্ষের গুলিবর্ষণের জবাবে মুক্তিযোদ্ধারা সামনের লঞ্চগুলোকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকেন। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে রকেট লন্সার চালক মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ বারবার চেষ্টা করেও ফায়ার করতে পারেননি। এর ফলে গোটা বাহিনীর ওপর বিপর্যয় নেমে আসে। এ-সময় দখলদার বাহিনীর সৈন্যরা দ্রুত স্থলভাগে উঠে মুক্তিযোদ্ধাদের বামদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং ভারী ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে তাঁদের অবস্থান লক্ষ করে এলোপাতাড়ি ফায়ার করতে থাকে। এ-সময় দক্ষিণ দিকে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ডান দিক দিয়ে আরো একটি ছৈওয়ালা নৌকায় আত্মগোপনকারী হানাদার সৈন্যরা দ্রুত ঘাটে এসে তীরে উঠে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান লক্ষ করে ফায়ার করতে থাকে। এতে কমান্ডার সুবেদার আবুল বাশার, নূরু মিয়া, সোহ্র্রাব ও আ. বারিক ঘটনাস্থলে শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধারা বুঝতেই পারেননি যে, নৌকার ভেতর শত্রুসৈন্যরা আত্মগোপন করে ছিল। তাঁদের লক্ষ্য ছিল লঞ্চগুলো। এমন সময় আরো কতগুলো নৌকা মুক্তিযোদ্ধাদের দৃষ্টি এড়িয়ে ঘাটে এসে ভেড়ে। হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর এমজি ১০৬ মেশিনগান ও ৩ ইঞ্চি মর্টার থেকে শেল নিক্ষেপ করছিল। এমতাবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন এবং পাট ও ধানক্ষেতের Saved ভেতর ঢুকে প্রাণ বাঁচান। তাঁরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং দৌড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান। বেলা ২টার দিকে বেলাব থেকে তিন মাইল দূরে বটেশ্বর স্কুলে এসে মুক্তিযোদ্ধারা সমবেত হন। পরে মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ তাঁদের স্ব-স্ব বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
কমান্ডারসহ পাঁচজন সহযোদ্ধার মৃত্যুতে দলের অন্য মুক্তিযোদ্ধারা সাময়িকভাবে হলেও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। যুদ্ধের পরপরই এলাকা প্রায় জনশূন্য হয়ে যায়। দখলদার বাহিনী স্থলভাগে উঠে মেশিনগান ও ৩ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর গুলি ও শেল বর্ষণ করতে থাকে। রাইফেল ও এলএমজিধারী হানাদার বাহিনীর সদস্যরা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে গ্রামে প্রবেশ করে। প্রথম দলটি মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের উত্তর দিকে ভাংগার ঘাট থেকে ঈদগাহ্ হয়ে, দ্বিতীয় দলটি আনর আলী গোদারাঘাট (বর্তমান বেলাব-ফরিদপুর আড়িয়াল খাঁ সেতু)-এর দক্ষিণ দিক থেকে এবং তৃতীয় দলটি নামা বাজার থেকে বেলাব বাজারের ভেতর দিয়ে পশ্চিমগামী রাস্তা বরাবর গ্রামে প্রবেশ করে নারী-পুরুষ- যুবক-বৃদ্ধ যাকে যে অবস্থায় পেয়েছে তাকে সে অবস্থায় নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে হত্যা করে। [এম আর মাহবুব]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড