বেশাইনখান গণহত্যা (ঝালকাঠি)
বেশাইনখান গণহত্যা (ঝালকাঠি) সংঘটিত হয় ২০শে জুন। ঝালকাঠি সদর উপজেলার অন্তর্গত বেশাইনখান গ্রামে স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা মুক্তিবাহিনী মানিক বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি ছিল। চব্বিশ সদস্যের এ বাহিনীর প্রধান ছিলেন রেজাউল করিম আজাদ ওরফে মানিক (ঢাকা কলেজের বিএ শ্রেণির ছাত্র)। তাঁর সহকারী ছিলেন তাঁরই অনুজ কীর্তিপাশা হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র মো. সাইদুল করিম (রতন)। দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে চব্বিশ জনের এই ক্ষুদ্র গেরিলা দলটি বিভিন্ন সময়ে পাকহানাদার বাহিনীর ওপর দুঃসাহসিক অভিযান চালায়।
জুন মাসের দিকে আটঘর-কুড়িয়ানা, ভীমরুলি, ডুমুরিয়া প্রভৃতি গ্রামের প্রায় ২০ হাজার নর-নারী পাকবাহিনীর ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে আটঘর-কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগানে আশ্রয় নেয়। মানিক বাহিনী তাদের ঘরবাড়ি রক্ষা এবং সহায়- সম্বলহীন মানুষদের যথাসম্ভব সহায়তা করত। ৮ই জুন পাকবাহিনী পেয়ারা বাগানের ১০ মাইল এলাকা জুড়ে কারফিউ জারি করে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এনে বাগান কাটতে শুরু করে। এ সংবাদ পেয়ে ১০ই জুন মানিক বাহিনী এক দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে পাকবাহিনীর একটি স্পীডবোট ও কয়েকটি রাইফেল হস্তগত করে। এ ঘটনার পর পাকবাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে মানিক বাহিনীর খোঁজ করতে থকে। স্থানীয় রাজাকাররা মানিক বাহিনীর গোপন ঘাঁটিগুলোর খবর সংগ্রহ করে হানাদার বাহিনীকে জানিয়ে দেয়। সেই খবরের ভিত্তিতে ২০শে জুন ভোররাতে প্রায় ৫০০ পাক হানাদার রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে মানিক বাহিনীর বেশাইনখান ঘাঁটিতে অভিযান চালায় এবং মানিক ও রতনসহ দলের ২৪ জনকেই আটক করে। হানাদাররা ঘটনাস্থলেই ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করে এবং মানিক ও রতনসহ ৮ জনকে জীবিত অবস্থায় ঝালকাঠি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তারা এ অঞ্চলের অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের অবস্থানসহ বিভিন্ন তথ্য আদায়ের জন্য আটককৃতদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন আজমত হায়াত মালিক তাঁদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েও কোনো তথ্য আদায় করতে না পেরে মানিক-রতনসহ সকলকে সুগন্ধাতীর বধ্যভূমি-তে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। সেদিন হানাদাররা বিভিন্ন স্থান থেকে এসে বেশাইনখান এলকায় আশ্রয় নেয়া শতাধিক নিরপরাধ মানুষকেও হত্যা করে।
হানাদারদের হাতে শহীদ মানিক বাহিনীর ২৪ জন মুক্তিযোদ্ধা হলেন: রেজাউল করিম আজাদ (মানিক), মো. সাইদুল করিম (রতন), মো. সালাহ উদ্দিন মজনু, মহেন্দ্ৰ নাথ হালদার, আব্দুস ছাত্তার বিএ, সৈয়দ আবু বকর (প্রাইমারি শিক্ষক), আবদুল করিম মোল্লা, হাবিবুর রহমান মোল্লা, আবদুল খালেক মোল্লা, আবদুর রহিম মোল্লা, ওয়াহাব আলী মোল্লা, আবদুল মান্নান, দলিল উদ্দিন, মোক্তার হোসেন, দেলোয়ার হোসেন, এনায়তে হোসেন, জহুর হোসেন, ইসমাইল হোসেন, আবদুল মালেক, মোবাশ্বের হোসেন, খলিলুর রহমান, আবদুল মজিদ মোল্লা, মোশারফ হোসেন ও রাশেদ আলী মোল্লা। স্বাধীনতার পর এঁদের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য বেশাইনখান গ্রামের নতুন নামকরণ করা হয় ‘মানিক নগর’। পরবর্তীতে সেখানে শহীদ স্মৃতি মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। ১৯৭২ সালে ঢাকা শহরের ১৮২নং নয়া পল্টনে প্রতিষ্ঠিত আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়টির নাম পরিবর্তন করে মানিক বাহিনীর কমান্ডারের স্মরণে ‘শহীদ মানিক আদর্শ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়’ রাখা হয়। এছাড়া ঐ এলাকার একটি সড়কের নামকরণ করা হয় শহীদ মানিক সড়ক। [শ্যামল চন্দ্র সরকার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড