You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.26 | বুরুঙ্গা গণহত্যা (ওসমানীনগর, সিলেট) - সংগ্রামের নোটবুক

বুরুঙ্গা গণহত্যা (ওসমানীনগর, সিলেট)

বুরুঙ্গা গণহত্যা (ওসমানীনগর, সিলেট) সংঘটিত হয় ২৬শে মে। এতে বুরুঙ্গা ও এর পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামের ৭৮ জন নিরীহ মানুষকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় দালালদের সহায়তায় একত্রিত করে উপর্যপরি গুলি করে ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে। পাকবাহিনীর এক ক্যাপ্টেনের নির্দেশে তারা নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। নিহতদের মধ্যে ৭২ জনকে বুরুঙ্গা গণকবরএ সমাহিত করা হয়।
বুড়ি নদীর পশ্চিম তীরে বুরুঙ্গা গ্রামে অবস্থিত বাজারের সঙ্গে বুরুঙ্গা প্রাইমারি স্কুল ও বুরুঙ্গা হাইস্কুল। ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হাইস্কুলের বর্তমান নাম বুরুঙ্গা ইকবাল আহমদ হাইস্কুল এন্ড কলেজ। মুক্তিযুদ্ধের সময় বুরুঙ্গা গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এটি উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার গ্রাম হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক মানুষ নিরাপত্তার জন্য এখানে এসে আশ্রয় নেয়। এ গ্রামের আব্দুল আহাদ চৌধুরী ওরফে ছাদ উদ্দিন ও তার সহযোগীরা ২৫শে মে একদল পাকসেনাকে এলাকায় নিয়ে আসে। তারা বুরুঙ্গা বাজারে সভায় মিলিত হয়ে ঘোষণা করে যে, চলাফেরা স্বাভাবিক করার জন্য সবাইকে পরিচয় পত্র দেয়া হবে। পরিচয় পত্র নেয়ার জন্য আশপাশের প্রতিটি গ্রামের সকল পুরুষকে ২৬শে মে সকালে বুরুঙ্গা হাইস্কুলে সমবেত হতে বলা হয়। পরদিন সকাল ৮টার পর থেকে এলাকাবাসী একে- একে স্কুল প্রাঙ্গণে সমবেত হতে থাকে। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অফিসার ক্যাপ্টেন নূর উদ্দিন খানের নেতৃত্বে একদল সৈন্য কয়েকজন স্থানীয় দালালসহ সেখানে উপস্থিত হয়। সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানি হানাদাররা প্রথমে উপস্থিত লোকজনকে স্কুলের দক্ষিণ দিকের টিনশেড ঘরে নিয়ে যায়। আটককৃতদের মধ্যে বুরুঙ্গায় আত্মীয় বাড়িতে আসা সিলেট বারের আইনজীবী রামরঞ্জন ভট্টাচার্যসহ সাদিপুর ও অন্যান্য এলাকার বেশ কয়েকজন ছিলেন। বাজার থেকে রশি এনে আটককৃতদের বাঁধা হয়। বাঁধার সময় হাইস্কুলের সহপ্রধান শিক্ষক প্রীতিরঞ্জন চৌধুরী ও রানু মালাকার নামের এক যুবক (দুজনই বুরুঙ্গার বাসিন্দা) পেছনের একটি জানালা খুলে পালানোর সময় তাদের লক্ষ করে গুলি ছোড়া হয়। দুপুর ১২টায় পাকহানাদাররা বিদ্যালয়ের সামনের চত্বর ঘিরে রেখে কয়েকটি এলএমজি মোতায়েন করে। তারপর সবাইকে কয়েকটি গ্রুপে বেঁধে সেনাবেষ্টিত চত্বরে নিয়ে যায়। এক সময় ক্যাপ্টেন নূর উদ্দিন খানের নির্দেশে পাকিস্তানি হানাদাররা এলএমজি-র ব্রাশ ফায়ার করে। মুহূর্তের মধ্যে নিরস্ত্র, নিরীহ ও অসহায় প্রায় মানুষের আর্তনাদে কেঁপে ওঠে পবিত্র শিক্ষাঙ্গন। রক্তে লাল হয়ে যায় বিদ্যালয়ের সবুজ চত্বর। অল্পক্ষণেই রক্তের স্রোতে ঢলে পড়া মানুষের আর্তনাদ থেমে যায়। তাদের কেউ- কেউ তখনো জীবিত থাকলেও মৃতের ভান করে নির্জীব অবস্থায় শুয়ে থাকেন। সকলের মৃত্যু নিশ্চিত মনে করে হানাদাররা বিদ্যালয় চত্বর ত্যাগ করার সময় এডভোকেট রামরঞ্জন ভট্টাচার্যকে চেয়ার থেকে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে পেছন থেকে গুলি করে। সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর মৃত্যু হয়। হানাদাররা চলে গেছে ভেবে আহতদের একজন শব্দ করে ইশ্বরের নাম উচ্চারণ করেন। তা শুনে হানাদাররা আহতদের লক্ষ করে পুনরায় গুলি করতে শুরু করে। তাতেও নিশ্চিত না হয়ে বাজার থেকে দুই টিন কেরোসিন এনে লুটিয়ে পড়ে থাকা মানুষগুলোর ওপর ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনের লেলিহান শিখায় দগ্ধ হয়ে অনেকে প্রাণ হারান। মানুষ পোড়ার গন্ধ আর আহত মানুষের আর্তচিৎকারে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। এ দৃশ্য দেখে হায়েনার দল পৈশাচিক আনন্দে উল্লাসিত হয়ে বেলা ১টার দিকে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।
প্রথম পর্যায়ে এলএমজি-র গুলির সময়ে শ্রীনিবাস চক্রবর্তী (পিতা নিকুঞ্জ বিহারী চক্রবর্তী, বুরুঙ্গা) ছিলেন সকলের পেছনে। তাঁর হাতে গুলি লাগে। গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মরার মতো পড়ে থাকেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে গুলি লাগে তাঁর পিঠে। এ সময়ও তিনি মরার মতো পড়ে থেকে জীবনে রক্ষা পান শ্রীনিবাস চক্রবর্তী বেঁচে গেলেও তাঁর বাবা নিকুঞ্জ বিহারী চক্রবর্তী ও ছোট ভাই নবম শ্রেণির ছাত্র নিত্যরঞ্জন চক্রবর্তী নিহত হন। ২৬শে মে সংঘটিত এ নির্মম গণহত্যায় মোট ৭৮ জন নিহত হন। তন্মধ্যে ৭২ জনের নাম জানা গেছে। এ হত্যাযজ্ঞ থেকে আহত হয়ে পেয়ারাপুরের গোপেন্দ্র কুমার দেব, ঠাকুর মণি সরকার; বুরুঙ্গার শ্রীনিবাস চক্রবর্তী, রঞ্জিত দেব, অধীর মালাকার; হাজিপুরের জীতেন্দ্র বৈদ্যসহ ৮-১০ জন মানুষ বেঁচে যান। রঞ্জিত দেব পঙ্গু অবস্থায় দু-তিন মাস বিনা চিকিৎসায় বেঁচে থাকার পর মৃত্যুবরণ করেন। আরো দেখুন বুরুঙ্গা গণকবর। [মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড