You dont have javascript enabled! Please enable it! বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব - সংগ্রামের নোটবুক

বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব

বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব (১৯৩০-১৯৭৫) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সহধর্মিণী, তাঁর জীবনের সুখ-দুঃখের চিরসাথী, ৭৫-এর ১৫ই আগস্ট পবিরারের উপস্থিত অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে একদল ঘাতক-খুনি দ্বারা সংঘটিত নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার, ‘বঙ্গমাতা’ নামে খ্যাত দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এক মহিয়সী নারী।
নিকটজনদের কাছে বেগম ফজিলাতুননেছার নাম ছিল রেনু। গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমান জেলা) টুঙ্গিপাড়ার সম্ভ্রান্ত শেখ পরিবারে ১৯৩০ সালের ৮ই আগস্ট তাঁর জন্ম। পিতার নাম শেখ জহিরুল হক ও মাতার নাম হোসনে আরা। ৩ বছর | বয়সে তিনি পিতৃহারা এবং ৫ বছর বয়সে মাতৃহারা হন। 5 এরপর দাদা শেখ কাশেমের হেফাজতে মাত্র ২ বছর থাকার পর তিনিও মৃত্যুবরণ করেন। বেগম ফজিলাতুননেছার বয়স যখন ৩ বছর, তখন ১২/১৩ বছর বয়সী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁরা সম্পর্কে ছিলেন চাচাতো ভাই-বোন। দাদার মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধুর পিতা- মাতার কাছে থেকেই তিনি বড় হন।
বেগম ফজিলাতুননেছার লেখাপড়া পারিবারিকভাবে সম্পন্ন হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের সুযোগ না পেলেও, তিনি ছিলেন বেশ বুদ্ধিদীপ্ত, অত্যন্ত দায়িত্ববান ও ধৈর্যশীল রমণী। সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না হওয়া বা কখনো প্রকাশ্যে না এলেও, তিনি খুবই রাজনীতি সচেতন ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে তাঁর প্রভাব অপরিসীম। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী (ইউপিএল 8 ২০১২) গ্রন্থ থেকে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বেগম ফজিলাতুননেছা সম্বন্ধে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও অজানা তথ্য জানা যায়। বঙ্গবন্ধুর এ আত্মজীবনীমূলক মহামূল্যবান গ্রন্থ ཟ রচনার পেছনেও মূল প্রেরণা ও উৎসাহ ছিল তাঁরই। এ সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, “বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবন। কাহিনী।… আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে দিয়ে গিয়েছিল… রেনু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১)
পাকিস্তানের ২৪ বছরের মধ্য ১২ বছরই বঙ্গবন্ধুর কারাগারে কাটে। কারাগারের বাইরের পুরো সময় তিনি বাঙালির জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তাই, পারিবারিক জীবন বলতে যা বুঝায়, বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে তার বিন্দুমাত্রও ছিল না। এমন অবস্থায় ফজিলাতুননেছা মুজিব সংসারের হাল ধরেন; ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে যান; বঙ্গবন্ধুর বিএ পরীক্ষার সময় (১৯৪৭) উৎসাহ দান ও যত্ন নিতে কলকাতা ছুটে যান; ৫০-এর দশকের শুরুতে যখন সপরিবারে ঢাকায় আসেন, তখন অতি কষ্টে বাড়িভাড়া করে থাকেন। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সর্বপ্রকার সহযোগিতা প্রদান করেন। তাঁর হাতখরচের জন্য টাকা জোগাড় করে গোপনে তা তাঁকে দিয়েছেন; সম্মেলনের অতিথিদের খাবারের বন্দোবস্ত করার জন্য টুঙ্গিপাড়া থেকে গোপালগঞ্জ এসেছেন; বঙ্গবন্ধু বারবার গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে তাঁর প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র স্যুটকেসে প্রস্তুত করে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবের উল্লিখিত ত্যাগ সম্বন্ধে লেখেন, ‘রেনু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা-পয়সা জোগাড় করে রাখত যাতে আমার কষ্ট না হয়।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১২৬) বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেগম মুজিব শুধু সর্বপ্রকার সহায়তা দানই করেননি, তাঁর কারাবন্দি থাকাকালীন চরম দুর্দিনে অন্তরালে থেকে দল পরিচালনায় কিংবা রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করেন। এক্ষেত্রে ৬৬-র ৬-দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ৭১-এর সাতই মার্চের ভাষণ- প্রসঙ্গ প্রণিধানযোগ্য ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ‘আমাদের বাঁচার দাবী : ৬ দফা’ নামে বাঙালির জাতীয় মুক্তির সনদ ঘোষণা করেন। তাঁর এ ৬- দফা কর্মসূচির মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের হাত থেকে বাঙালির স্বাধীনতা লাভ। প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান সেটি ভাল করেই বুঝতে পারে। তাই, ৬-দফাভিত্তিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে সে অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগের হুমকি দেয়। ৬-দফা প্রচারের ৩ মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। একনাগাড়ে প্রায় ৩ বছর তিনি কারাবন্দি থাকেন। বন্দি অবস্থায় তাঁকে ১ নম্বর আসামি করে দায়ের করা হয় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা, যা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে তখন পারিচিতি ছিল।
আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ওপর নেমে আসে চরম নির্যাতন-নিপীড়ন। কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এমন এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব দলের নেতা-কর্মীদের খোঁজ- খবর রাখা, ৬-দফা কর্মসূচির পক্ষে প্রচারপত্র ছাপাতে সংসারের খরচ থেকে টাকা বাঁচিয়ে, এমনকি নিজ গহনা বিক্রি করে সে টাকা পার্টির কাজে দেয়া ইত্যাদি ভূমিকা পালন করেছেন। ৬৯-এ আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থানের এক পর্যায়ে আইয়ুব সরকার বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেয়ার প্রস্তাব করলে, নিঃশর্ত মুক্তি ছাড়া কোনো কিছুতে সম্মত না হতে তিনি বঙ্গবন্ধুর নিকট খবর পৌঁছান। শেষ পর্যন্ত আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে নিয়ে আইয়ুব সরকার বঙ্গবন্ধুসহ সকল অভিযুক্তকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
৭১-এর মার্চ মাস ছিল বাঙালি জাতির জন্য এক যুগসন্ধিক্ষণ ৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ ও এর প্রধান বঙ্গবন্ধুর হাতে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা নির্বাচনের রায় মেনে নিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে ( অপারেশন সার্চলাইট )। এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দেন। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ৭ই মার্চ তিনি বাঙালিদের উদ্দেশে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য নিয়ে ঢাকার রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)-এ বিক্ষোভে উত্তাল জনতার এক মহাসমুদ্রে এসে হাজির হন (সাতই মার্চের ভাষণ)। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে কী বলবেন, এ নিয়ে আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটিতে দীর্ঘ আলোচনা হয়। নানাজন বঙ্গবন্ধুকে এ ব্যাপারে তাঁদের নিজেদের মতো করে সাজেশন দিতে থাকেন। এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবের যে পরামর্শ, তা শেখ হাসিনার লেখা থেকে জানা যায়—
…সমগ্র দেশের মানুষ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সবার ভাগ্য আজ তোমার ওপর নির্ভর করছে অনেকে অনেক কথা বলতে বলেছে … তুমি নিজে যেভাবে যা বলতে চাও নিজের থেকে বলবে। তুমি যা বলবে সেটিই ঠিক হবে। বঙ্গবন্ধু যেন বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবের পরামর্শমতো যে কথা বলা উপযুক্ত মনে করেছেন, তা-ই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর ভাষণে সেদিন বলেছেন। তাঁর সামনে লিখিত আকারে কোনো কিছুই ছিল না। হৃদয়ের গহিন থেকে সব কথা উঠে এসেছে। বেগম মুজিবের উল্লিখিত পরামর্শ যে কত বাস্তব, প্রাজ্ঞ ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি সন্তানদের নিয়ে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় গ্রহণ শেষে পাকিস্তানি সেনা প্রহরায় ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কের একতলা একটি বাড়িতে অবরুদ্ধ অবস্থায় দিন কাটান। এর ভেতরও দুই পুত্র শেখ কামাল ও শেখ জামাল-কে মুক্তিযুদ্ধে পাঠান। ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের দিন নিজ হাতে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে তা পুড়িয়ে দেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্যাতিতা নারীদের স্বাধীনতোত্তর কালে নানাভাবে সাহায্যদানসহ তিনি তাদের পুনর্বাসনে ভূমিকা রেখেছেন (নারী নির্যাতন)।
বেগম ফজিলাতুননেছা শুধু বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক এক মহিয়সী নারী। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রাম বা স্বাধীনতা অর্জনে তাঁর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ঘাতক-খুনিদের নির্মম বুলেট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের উপস্থিত অন্য সদস্যদের সঙ্গে কেড়ে নেয় এ মহিয়সী নারীর জীবন। কিন্তু বাঙালি জাতির ইতিহাসে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী (ঢাকা, ইউপিএল ২০১২); মুহাম্মদ শামসুল হক, আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দি, (চট্টগ্রাম, ইতিহাসের খসড়া ২০০৯), আব্দুর রাজ্জাকের সাক্ষাৎকার দ্রষ্টব্য; শেখ হাসিনা, ‘ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ : কিছু স্মৃতি’, আব্দুল ওয়াহাব (সম্পাদিত), বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ : ইতিহাস ও তত্ত্ব (ঢাকা, মাওলা ব্রাদার্স ২০১৪); অধ্যাপক মমতাজ বেগম ও মফিদা বেগম, স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলার নারী (ঢাকা, হাক্কানী পাবলিশার্স ২০১৮)

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড