বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৩শে অক্টোবর, মঙ্গলবার, ৬ই কার্তিক, ১৩৮০
বিশ্বের কলঙ্কজনক ইতিহাসের নায়ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার নেতৃবৃন্দের কদর্য মুখোশ দিন দিন ন্যাক্কারজনকভাবে উন্মোচিত হয়ে উঠছে। বিশ্বের ন্যূনতম বিবেক সম্পন্ন মানুষ মাত্রেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কদর্যতা দেখে তথাকথিত সভ্যতা ও শিক্ষা সম্পর্কে আজ মুখর। ইতিহাসের বিকৃত রাষ্ট্র নায়কদের ন্যায় আমেরিকার রাষ্ট্রনায়করা আজ পরিগনিত হয়েছে। নেতাদের ব্যক্তির চরিত্র থেকে শুরু করে গোটা রাষ্ট্রীয় জীবনে দুর্নীতি প্রবেশ করেছে। অগণতান্ত্রিক ও মানবেতর কাজের হোতা আজ তারা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই নৈতিক ও মানবিক অধঃপতনের শেষ কোথায় তা বিশ্বের সকল মানুষের কাছে একটা বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। আমেরিকার শক্তির দর্প বিশ্বযুদ্ধের কাল থেকেই অতিমাত্রায় শুরু হয়েছে। এরপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরুদ্ধে তারা হুমকি হিসেবে নিজেদেরকে আবির্ভূত করেছে। কোথাও সরকারি কোথাও পরোক্ষভাবে আমেরিকা যুদ্ধ বাধিয়েছে। গত দুই দশক ধরে মার্কিন সাম্রাজ্যে কদর্য চেহারা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। বিশ্বের যেখানে শান্তিকামী সরকার ও স্বাধীনতাকামী জনগণ সচেতন হয়ে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে সেখানেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রত্যক্ষ ওপরোক্ষভাবে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে আঁতাত করে অথবা মদদ দিয়ে বাধা সৃষ্টি করছে। এর ফলে যেমন মৃত্যু ঘটেছে গণতন্ত্রের তেমনি বিশ্বের শান্তি অগ্রগতি হয়েছে ব্যাহত। এছাড়া লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানির ঘটনা তো রয়েছেই।
বর্তমান পর্যায়ে এসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও তার নেতৃবৃন্দের অধঃপতনজনিত কদর্যতা আরো বেশি করে সুস্পষ্ট হয়েছে। আব্রাহাম লিংকনের স্বপ্নের আমেরিকার ভাইস-প্রেসিডেন্ট আজ চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত। বনবাদী কাঠামোর মধ্যে থেকেও একদা আমেরিকার নেতৃবর্গের প্রতি বিশ্বের মানুষের ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা ছিল। আব্রাহাম লিংকন, বেঞ্জামিন, ফ্রাঙ্কলিন, জর্জ ওয়াশিংটন, জেফারসন ও রুজভেল্টের মতো নেতাদের প্রতি মানুষের সকল বিতরকের উর্ধ্বেও একটি শ্রদ্ধাবোধ ছিল। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের কঠোর প্রবক্তা হয়েও এদের চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব আজকের আমেরিকার নেতাদের চাইতে অনেক শ্রেয় ও মহিমান্বিত ছিল। এদের জীবনে আর যাই হোক চুরি বা কেলেঙ্কারির মতো বিশ্বের সারা জাগানো ঘটনার অবতারণা হয়নি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরাসরি সৈন্য গোয়েন্দা পাঠিয়ে আজকের মার্কিন সরকার যে সকল মানবেতর ঘটনার নায়ক হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করেছেন তার নজির সভ্য ইতিহাসে মেলেনা। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি বিষয়টিতে বর্তমানে প্রেসিডেন্ট এত বেশি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ভাবে জড়িত যে সকল প্রকার বিকল্প বাঁচার পথ তৈরি করেও তিনি আজ নাস্তানাবুদ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছেন। ওয়াটারগেট তদন্ত মামলার সর্বশেষ পর্যায় এখন তদন্তকারী কে পদচ্যুত ও সে কারণে অ্যাটর্নি জেনারেল ও তার সরকারের পদত্যাগের মধ্যে এসে উপনীত হয়েছে। ওদিকে কয়েকদিন পূর্বে ট্যাক্স ফাঁকি দেবার দায়ে অভিযুক্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট কে বাদ দিয়ে নতুন ভাইস-প্রেসিডেন্ট মনোনীত করা হয়েছে। এহেন কলঙ্কজনক ঘটনা আমেরিকার কদর্য চেহারা বাস্তব প্রকাশ। অথচ মার্কিন ধনবাদী মহলে পত্র-পত্রিকাগুলো বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নগামী দেশ সম্পর্কে যে সকল মন্তব্য মূলক রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে তা যেমন হাস্যকর তেমনি অদূরদর্শিতার পরিচায়ক।
এশিয়ার উন্নয়নমুখী প্রায় সবগুলো দেশি উত্তরাধিকারসূত্রে একটি পুঁজিবাদী অসৎ সমাজব্যবস্থা হাতে পেয়েছে। ফলে যে দুর্নীতি আজও রয়েছে তা মোটেই নতুন তৈরী নয়। এর বিরুদ্ধে এসকল উন্নয়নকামী দেশ আজ পরিকল্পিতভাবে সংগ্রামরত এবং সকল দেশ একদিন সমাজবাদী অর্থনীতিতে উত্তোলন করার জন্য সকল দুর্নীতি কাটিয়ে উঠবেই। কিন্তু আজও একথা সত্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, ভাইস-প্রেসিডেন্ট যে ন্যক্কারজনক কলঙ্কে কলঙ্কিত তা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোন রাষ্ট্রনায়ক এ জীবনে নেই। এদিক দিয়ে তথাকথিত সভ্যতা, শিক্ষা ও গণতন্ত্রের দেশ আমেরিকার তুলনায় আমরা এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাংশে মানুষ অনেক বেশি গণতান্ত্রিক সভ্য শান্তিকামী। ভিয়েতনামের মাটি থেকে যে চরম শিক্ষা আমেরিকাকে পেতে হয়েছে তার তুলনা নেই। আমরা আশাবাদী আরবদের মরুভূমি থেকেও তেমনি শিক্ষা তাদেরকে গ্রহণ করতে হবে। নিজের হাতে নিজের শাস্তি পুরস্কারের নামাবলী পর। কেমন হাস্যাম্পদ তেমনী কলঙ্কজনক গণতন্ত্রের নামে বড় মুখে কথা বলা তা। আমরা উন্নয়নকামী সংগ্রামরত মানুষ আর যাই হোক সভ্যতা, সংস্কৃতি ও শিক্ষার বড়াই করে চুরির ইতিহাস রচনা করি না। আমাদের বিচার করবার সেই দিব্য দৃষ্টি জানিনা সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন নেতাদের আজও আছে কিনা।
জলপুলিশ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন
নদী মাতৃক সারা বাংলাদেশে জলপুলিশ বিভাগের পুলিশের সংখ্যা হচ্ছে সর্বমোট ১৯২ জন। এই সংখ্যার মধ্যে ১জন হচ্ছেন ইন্সপেক্টর, ১৭ জন এ এস আই, ৪জন হেড কনস্টেবল এবং বাকি ১৪৫ জন হলেন সাধারণ পুলিশ। আর জলপুলিশ বিভাগ নাম এই সংস্থায় কয়েকটি দেশি নৌকা ছাড়া কোন জলযান নেই-এই ছিল গতকালকের বাংলার বাণীতে প্রকাশিত একটি খবর। গত পরশু বাংলার বাণীতে প্রকাশিত আর একটি প্রতিবেদন অনুসারে দেখা যায় ১৯৭২ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ১৯৭৩ সালের ৩১শে আগস্ট পর্যন্ত এই বিশ মাসে (ছ’শ’ দিনে) বিভিন্ন অভিযোগে দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা হচ্ছে ১,৪২,৪৯৭। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ২৩৭টিরও বেশী (প্রতি ছ’মিনিট পর পর একটি করে) মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য ধারায় মামলা দায়ের হয়েছে ৬৮,৪৩১টি।
স্থানীয় একটি দৈনিকে গতকাল প্রকাশিত তথ্য অনুসারে ১৯৭২ সালে প্রতিমাসে খুন, ডাকাতি, রাহাজানি সহ বিভিন্ন অপরাধ ঘটেছে গড়ে ৩১৮১টি। সেক্ষেত্রে ১৯৭৩ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে অপরাধ ঘটেছে গড়ে ৪০৮১টি। অর্থাৎ প্রতি মাসে অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এক হাজারেরও বেশি। নদী পথে লঞ্চ ডাকাতি, নৌকা ডাকাতি কিংবা ছিনতাই ইত্যাদি ঘটনাগুলো উল্লেখিত তথ্যের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলে আমাদের ধারণা।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে উল্লিখিত তথ্যের বাহিরেও অনেক ঘটনার রয়ে গেছে যা পুলিশের খাতায় লিপিবদ্ধ হয়নি। সুতরাং এ থেকেই একটা স্পষ্ট ধারণা করা যায় দেশের আইন শৃংখলার অবস্থা কিরূপ। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে জলপথে বিশেষ করে ডাকাতি, ও ছিনতাই বৃদ্ধি পেয়েছে।
গত পনেরোই অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের সোনালী ব্যাংকের জৈনিক কর্মচারী টাকাসহ শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় হয়ে ব্যাংকের ডকইয়ার্ড শাখায় যাবার পথে ছিনতাইকারীরা স্টেনগান উঁচিয়ে আড়াই লক্ষ টাকা ছিনতাই করে। অনুরূপ ঘটনা এবং নদীপথে ডাকাতির খবর ইদানিং অহরহ ঘটছে এমন খবর দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিয়মিত পাওয়া যাচ্ছে। অথচ নদীমাতৃক দেশের বর্তমান জলপুলিশ বিভাগটিকে বস্তুতঃ একটি প্রহসনের প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না।
এমতাবস্থায় আমরা মনে করি অনতিবিলম্বে জলপুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন এবং সঙ্গে সঙ্গে জল পুলিশ বাহিনীকে পর্যাপ্ত আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, জলযান ইত্যাদিতে সজ্জিত করা উচিত। এছাড়া তাদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী করে তুলে গ্রাম-গ্রামান্তরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে নদী পথে নিয়োজিত করে বর্তমান অবস্থা মোকাবিলা করতে হবে। নদীপথে এজন্য ‘মোবাইল পুলিশ ফাঁড়ি’ স্থাপন করা যেতে পারে বলে আমরা মনে করি। আমাদের নদীমাতৃক দেশের জলপুলিশ বিভাগের প্রতি সংশ্লিষ্ট দপ্তর সত্বর পূর্ণদৃষ্টিপাত করে জলপথে সংগঠিত ডাকাতি, ছিনতাই, চোরাকারবারি ইত্যাদি দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন-সরকারের প্রতি আমাদের এটাই প্রত্যাশা।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক