You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.20 | বুড়িঘাট যুদ্ধ (নানিয়ারচর, রাঙ্গামাটি) - সংগ্রামের নোটবুক

বুড়িঘাট যুদ্ধ (নানিয়ারচর, রাঙ্গামাটি)

বুড়িঘাট যুদ্ধ (নানিয়ারচর, রাঙ্গামাটি) সংঘটিত হয় ২০শে এপ্রিল। এতে মুন্সী আব্দুর রউফ, বীরশ্রেষ্ঠ সহ ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অন্যদিকে পাকবাহিনীর ৩টি নৌযান ডুবে যায় এবং তাদের বেশকিছু সৈন্য নিহত হয়। মেজর মীর শওকত আলী, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে বুড়িঘাট এলাকায় একটি প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করা হয়। ব্যূহটি ছিল এরূপ- ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান ১০০ সৈন্য নিয়ে বুড়িঘাটে, ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের ১০০ সৈন্য নিয়ে খাগড়াছড়িতে, লে. মাহফুজ ১০০ সৈন্য নিয়ে বরকলে এবং সুবেদার মুত্তালিব ১০০ সৈন্য নিয়ে কুতুকছড়িতে ১৬ই এপ্রিল তাঁদের নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান নেন।
১৪ই এপ্রিল চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের আহ্বানে পাকিস্তানি বাহিনী রাঙ্গামাটি আসে। পরদিন ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের তাঁর বাহিনী নিয়ে খাগড়াছড়ি রেস্টহাউজে অবস্থানরত এক প্লাটুন পাকসেনাকে আক্রমণ করেন। এতে হানাদারদের কমান্ডিং অফিসার সহ ২০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। বাকিরা পালিয়ে যায়। কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের হেডকোয়ার্টার্সে ফিরে আসেন। ১৭ই এপ্রিল প্রায় ২০ জন পাকিস্তানি সেনার একটি দল কাপ্তাই হ্রদে লঞ্চযোগে রেকি করতে বের হয়। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান তাঁর দল নিয়ে ওঁৎ পেতে ছিলেন। লঞ্চটি তাঁদের গুলির আওতায় আসামাত্র মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন। এতে লঞ্চটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এবং অধিকাংশ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এ-সময় ২ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
মেজর মীর শওকত আলী জানতে পারেন যে, রাঙ্গামাটি থেকে পাকিস্তানি বাহিনী নানিয়ারচর হয়ে মহালছড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তিনি ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ ও ছাত্র-যুবকদের সমন্বয়ে একটি গ্রুপ তৈরি করেন। এ গ্রুপটিকে ১৯শে এপ্রিল নানিয়ারচরে পাকিস্তানি বাহিনীকে বাধা দেয়ার জন্য প্রেরণ করা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা বুড়িঘাট এলাকার চেঙ্গী খালের পারে অনেকগুলো বাংকার তৈরি করেন। এ দলটি নানিয়ারচর বাজারে এলে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তিলক চন্দ্র চাকমা মুক্তিযোদ্ধাদের রাতের খাবারের ব্যবস্থা করেন। স্থানীয় লোকজন এতে সহযোগিতা করে। রাতের খাবার খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ-কেউ দোকানে, কেউ-কেউ বোটে, কেউবা আবার স্থানীয়দের কারো-কারো ঘরে রাত্রি যাপন করেন। পরদিন ২০শে এপ্রিল ভোরবেলা সকল মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে বুড়িঘাটে যান। সেখানে পরপর তিনটি টিলায় মুক্তিযোদ্ধারা পজিশন নেন। প্রথম টিলায় ৯-১০ জন যোদ্ধাসহ মুন্সী আব্দুর রউফ অবস্থান নেন। দ্বিতীয় টিলায় ছিলেন সুবেদার মীর আমির হোসেনসহ কয়েকজন। তৃতীয় টিলায় লে. খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে আরেকটি দল। সর্ব পেছনে কভারিং ফায়ার দেয়ার জন্য একটি গ্রুপকে প্রস্তুত রাখা হয়।
পাকিস্তানি সেনাদের একটি কোম্পানি ৩ ইঞ্চি মর্টার ও ভারী অস্ত্র নিয়ে ৩টি লঞ্চ ও ২টি স্পিডবোট বোঝাই করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষাব্যূহে ঢুকে পড়ে। তারা প্রতিরক্ষাব্যূহে ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা ফায়ারিং শুরু করেন। শত্রুবাহিনী পাল্টা গুলি ছোড়ে। হানাদারদের কিছু সদস্য চেঙ্গী খালের পূর্বপ্রান্তে উঁচু একটি স্থানে নেমে মর্টার বসায়। শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ। শত্রুদের ২টি লঞ্চ ও ১টি স্পিডবোট গুলির আঘাতে পানিতে ডুবে যায়। শত্রুবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে কিছুটা পেছনে ফিরে পাহাড়ের আড়ালে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর পুনরায় তারা সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করে। তাদের মর্টারের গুলি নিক্ষিপ্ত হতে থাকে। একদিকে হানাদারদের ভারী অস্ত্র, অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি ফুরিয়ে আসা – এমনি অবস্থায় দলের কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দেন। অন্যরা নির্দেশ অনুযায়ী সরে গেলেও মুন্সী আব্দুর রউফ হালকা মেশিনগান হাতে অসীম সাহসের সঙ্গে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। এর ফলে অবশ্য সহ-মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদপসরণ সহজ ও নিরাপদ হয়। সহযোদ্ধারা মুন্সী আব্দুর রউফকে সরে যাওয়ার জন্য বারবার চিৎকার করতে থাকেন।
কিন্তু তিনি মেশিনগান চালাতে থাকেন আর অন্যদের নিরাপদ স্থানে চলে যেতে বলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ খাল-হ্রদ সাঁতরে পাশের ঝোপে, কেউবা গাছ বা পাহাড়ের আড়ালে আশ্রয় নেন। এক পর্যায়ে তাঁর সাহায্যকারীরাও তাঁকে ফেলে চলে আসেন। তিনি একাই মেশিনগান চালাতে থাকেন। এ- সময় প্রচণ্ড মর্টার শেলিং হতে থাকে। মর্টারের শেল মুন্সী আব্দুর রউফের অবস্থানের কাছে বিস্ফোরিত হয়। এতে তাঁর শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে এলে পাকিস্তানি হানাদাররা তাদের বাকি যানবাহনযোগে রাঙ্গামাটি হেডকোয়ার্টার্সে ফিরে যায়। যুদ্ধে পাকবাহিনীর ৩টি নৌযান ডুবে যায় এবং তাদের বেশকিছু সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের বহনকারী সবগুলো বোটও ধ্বংস হয়ে যায়। অপরদিকে মুন্সী আব্দুর রউফ ছাড়া আরো ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁদের দুই পাহাড়ের মাঝে লতাপাতা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। এ-যুদ্ধে এনডু এন বাড়ৈ (রাঙ্গুনিয়া কলেজের ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের ছাত্র) আহত হন। তাঁকে মহালছড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখান থেকে রামগড় হাসপাতাল, তারপর আগরতলা জিবি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
দয়াল কৃষ্ণ চাকমা- নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা একটি আমগাছের উঁচু ডালে বসে এ-যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখছিলেন। যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা চলে যাওয়ার সময় দয়াল চাকমাকে ঐ অবস্থায় দেখতে পান। রবার্ট রোনাল্ড পিন্টু নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তাকে গাছ থেকে ডেকে নামান। মুক্তিযোদ্ধারা মহালছড়ি ফিরে যাবার পথ না চেনায় দয়াল কৃষ্ণ চাকমা তাঁদের নিজ বাড়িতে নিয়ে যান এবং যথাসাধ্য আপ্যায়ন করেন। তারপর তিনি তাঁদের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে মহালছড়ি যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেন।
পরদিন সকালে দয়াল কৃষ্ণ চাকমা ঐ টিলায় গিয়ে দেখতে পান একজন মুক্তিযোদ্ধার ছিন্নভিন্ন দেহ ছড়িয়ে- ছিটিয়ে পড়ে আছে। তিনিই হলেন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ। তিনি বাড়ি থেকে কোদাল নিয়ে এসে গর্ত করে দেহাবশেষগুলো কবরস্থ করেন। আর কবরের চারপাশে চারটি খুঁটি গেড়ে দেন। এভাবে সংরক্ষিত হয় বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের কবর, যা ২৬ বছর পর আবিষ্কৃত হয়। পরবর্তীতে সরকারের উদ্যোগে এখানে সমাধিসৌধ নির্মিত হয়েছে। [ইয়াছিন রানা সোহেল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড