You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে বুড়িচং উপজেলা (কুমিল্লা)

বুড়িচং উপজেলা (কুমিল্লা) কুমিল্লা জেলার ১৬টি উপজেলার মধ্যে বুড়িচং উপজেলার অবস্থান জেলা সদরের উত্তর ও পশ্চিম প্রান্তে। ১৯৭১ সালে ভারতীয় সীমান্তবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে গঠিত এ থানা পরবর্তীতে বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া নামে দুটি থানায় বিভক্ত হয়। উপজেলা ব্যবস্থা চালু হলে ৮টি ইউনিয়ন নিয়ে বুড়িচং উপজেলা গঠিত হয়। এ উপজেলার মাঝখান দিয়ে গোমতী নদী প্রবাহিত। বুড়িচং উপজেলার দক্ষিণে কুমিল্লা সদর, পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, উত্তরে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা এবং পশ্চিমে চান্দিনা ও দেবিদ্বার উপজেলা। এ উপজেলার ওপর দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক চলে গেছে। বুড়িচং উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট অবস্থিত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর আহ্বানে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে এডভোকেট সিরাজুল হক এমএনএ, অধ্যাপক মো. খোরশেদ আলম এমএনএ এবং বুড়িচং থানা থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য মো. আমীর হোসেনের নেতৃত্বে থানা আওয়ামী লীগ-এর নেতৃবৃন্দ সভা-সমাবেশ করেন এবং বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ-এ উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁরা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য জনগণকে উজ্জীবিত করেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কুমিল্লা সেনানিবাস ও পুলিশ লাইনসহ বিভিন্ন স্থানে অতর্কিতে নিরীহ বাঙালিদের ওপর বর্বর আক্রমণ চালায়। সেনানিবাস থেকে পালিয়ে আসা আহত অনেক বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও জওয়ানকে আশ্রয় ও চিকিৎসা দিয়ে স্থানীয় জনগণ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। জেলা সদরের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের অধিকাংশই স্থানীয় জনগণের সহায়তায় ত্রিপুরায় গমন করেন। তাঁরা সীমান্ত-সংলগ্ন রাজাপুর ও বাকশীমুল ইউনিয়নের জনগণ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সহায়তায় ভারতের অভ্যন্তরে ক্যাম্প স্থাপন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য যুবকদের উদ্বুদ্ধকরণ ও ক্যাম্পে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং শরণার্থীদের নিরাপদে ভারতের আশ্রয় শিবিরে প্রেরণের ব্যবস্থা করেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বুড়িচং থানার পার্শ্ববর্তী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের গোমতী-১ ক্যাম্পে ক্যাম্প প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মো. আমীর হোসেন এমপিএ, হাতিমারা ক্যাম্পে ডেপুটি ক্যাম্প প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আবুল বাশার চেয়ারম্যান এবং বক্সনগর ক্যাম্পে ডেপুটি ক্যাম্প প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক মো. ইউনুস। বুড়িচং থানার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মো. আবু তাহের। বিএলএফ কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এডভোকেট আবদুল মতিন খসরু।
মার্চ মাসের শেষদিকে বুড়িচং থানার শংকুচাইল গ্রা অবস্থিত ইপিআর ক্যাম্পে বাঙালি সৈনিকরা স্থানীয় জনগণের সহায়তায় ৭ জন পাকিস্তানি ইপিআর সৈনিককে হত্যা করে ক্যাম্পটি দখল করেন। এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে রাজাপুর রেলস্টেশন সংলগ্ন পাইকোঠা গ্রামে পাকিস্তানি সৈন্যবাহী ট্রেন উড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধারা রেললাইনে ডিনামাইট পুঁতে রাখেন। কিন্তু ট্রেন আসার কিছুক্ষণ আগেই ডিনামাইটটি বিস্ফোরিত হয়। এরপর পাকিস্তানি সৈন্যরা ট্রেন থেকে নেমে আশপাশের অসংখ্য বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়।
কুমিল্লা সেনানিবাস সংলগ্ন হওয়ার কারণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বুড়িচং উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে প্রায় সময়েই টহলে গিয়ে ভীতি প্রদর্শন করত। হিন্দুপ্রধান এলাকাগুলোতে তাদের তৎপরতা বেশি ছিল। বুড়িচং থানায় পাকবাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করত। স্বাধীনতাবিরোধী মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামীর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গ শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে সহযোগিতা করে এবং বাঙালিদের হত্যা ও নির্যাতনে অংশ নেয়। তারা এ উপজেলায় কয়েকটি গণহত্যা সংঘটিত করে।
সেগুলোর মধ্যে আনন্দপুর গণহত্যা, সাতগাঁও গণহত্যা, আজ্ঞাপুর গণহত্যা, চাঁনগাছা গণহত্যা, গোবিন্দপুর গণহত্যা ও সাদকপুর গণহত্যা উল্লেখযোগ্য।
আনন্দপুর গণহত্যা সংঘটিত হয় ২৮শে মে। এ গণহত্যায় ৯ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। সাতগাঁও গণহত্যা সংঘটিত হয় ১৮ই জুন। এতে একই পরিবারের ৪ জন মানুষ নিহত হন।
আজ্ঞাপুর গণহত্যা সংঘটিত হয় আগস্টের প্রথম সপ্তাহে। এতে ৫ জন নিরীহ মানুষ শহীদ হন। চাঁনগাছা গণহত্যা সংঘটিত হয় ১৪ই আগস্ট। এতে ১০ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। একই দিন কোরপাই গ্রামের ৩ জনকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হত্যা করে। গোবিন্দপুর গণহত্যা সংঘটিত হয় ১৭ই সেপ্টেম্বর। এতে ৫ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। সাদকপুর গণহত্যা সংঘটিত হয় ২৫ই সেপ্টেম্বর। এতে ১০ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। একই দিন গোবিন্দপুর গ্রামে ৪ জন এবং কোমাল্লা গ্রামে ১ জন বাঙালিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা হত্যা করে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বুড়িচং থানার রেললাইন সংলগ্ন ফকির বাজার, খাড়েরা, বাকশীমুল, পাইকোঠা, রাজাপুর, মাশরা মনোহরপুর, কালিকাপুর, আজ্ঞাপুর, চড়ানল, পাঁচড়াসহ অন্যান্য গ্রামের অসংখ্য বাড়িঘর জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বুড়িচং থানার বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঙালিদের ধরে এনে বুড়িচং থানায় বন্দি করে রেখে নির্যাতন করা হতো। বুড়িচং উপজেলার কালিকাপুরে একটি বধ্যভূমি আছে|
মুক্তিযুদ্ধকালে বুড়িচং উপজেলা ছিল ২নং সেক্টরের অধীন ই সালদা নদী সাব-সেক্টর ও মতিনগর সাব-সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। এ-দুটি সাব-সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন যথাক্রমে মেজর আবদুস সালেক চৌধুরী এবং লেফটেন্যান্ট দীদারুল আলম। ই এঁদের নেতৃত্বে এ উপজেলায় একাধিক যুদ্ধ হয়েছে। সেসবের মধ্যে ৫টি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হলো- পাঁচড়ার যুদ্ধ, বুড়িচং থানা অপারেশন, রামনগর যুদ্ধ, জালালপুর যুদ্ধ ও চড়ানলের যুদ্ধ। পাঁচড়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৩ই জুন। এতে ১১ জন পাকসেনা নিহত ও ১২ জন আহত হয়। বুড়িচং থানা অপারেশন পরিচালিত হয় ১৪ই জুন। এতে ৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত ও ১ জন নিখোঁজ হন। রামনগর যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৮ই অক্টোবর। এতে ১৬ জন পাকসেনা ও ১৪ জন রাজাকার নিহত হয়।
জালালপুর যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৯ই অক্টোবর। এতে ৩৫ জন পাকসেনা নিহত ও ৫ জন বন্দি হয়। অপরপক্ষে ট মুক্তিবাহিনীর ১ জন সদস্য শহীদ, ২ জন আহত এবং ১ জন বন্দি হন। চড়ানলের যুদ্ধ সংঘটিত হয় অক্টোবরের মাঝামাঝি। এতে ৭ জন পাকসেনা নিহত ও তাদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। অপরপক্ষে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৬ই ডিসেম্বর বুড়িচং উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. মঈনুল হোসেন, বীর উত্তম (পিতা মো. কালা মিয়া, কুসুমপুর) ও মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব, বীর প্রতীক (পিতা হায়দার আলী, শ্রীমন্তপুর)।
বুড়িচং উপজেলার যেসব শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা গেছে, তাঁরা হলেন- মো. মইনুল হোসেন (২০শে সেপ্টেম্বর কসবা উপজেলার সাহেব বাড়ি যুদ্ধে শহীদ), শহীদুল ইসলাম (পিতা রোছমত আলী, পাচোরা, রাজাপুর), আব্দুল মতিন (পিতা ইউসুব আলী, চড়ানল, রাজাপুর), মো. আবুল হাসেম (পিতা জুলফিকার আহমেদ, বাকশীমুল), আব্দুল হক (পিতা আকবর আলী, মাসরা, বাকশীমুল), ছাফর আলী (পিতা আব্দুল রহমান, কংশনগর, ভারেল্লা), ফজলুল হক (পিতা হাজী বজলুর রহমান, পুর্নমতি, বুড়িচং সদর), আব্দুল মালেক (পিতা চান মিয়া, ইছাপুরা, ষোলনল), এম এ হাসেম (পিতা আলী মিয়া, শোন্দ্রম, ভারেল্লা), হুমায়ুন কবির (পিতা আব্দুল জব্বার, বাজেবাহেরচর, ময়নামতি), মো. অহিদুর রহমান (পিতা মো. আব্দুল মালেক, পশ্চিমসিং, ভারেল্লা), সিপাহি আব্দুর মজিদ (পিতা মো. আলী মিয়া, কালাকচুয়া, ময়নামতি), আজগর আলী সরকার (পিতা নাজিমুদ্দিন সরকার, ফরিজপুর, ময়নামতি), আব্দুল মালেক (পিতা ইয়াকুব আলী, মাধুবপর, বাকশীমুল), আব্দুস ছোবান (পিতা বশির আহমেদ, পাবরা, রাজাপুর), ওয়ছিন উদ্দিন (পিতা আফছার উদ্দিন, বারিশ্বর, রাজাপুর), আব্দুস সাত্তার (পিতা আব্দুল মজিদ, গিলাতলা, রাজাপুর), আব্দুল জব্বার (পিতা আনু মিয়া, আজ্ঞাপুর, বাকশীমুল), মফিজুর রহমান (পিতা আমির উদ্দিন, এতবারপুর, ময়নামতি), কেরামত আলী (পিতা মো. সোনা মিয়া, শোন্দ্ৰম, ভারেল্লা) ও মনিরুজ্জামান (পিতা মীর আকবর আলী, নিমসার, মোকাম)।
বুড়িচং উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। চড়ানল যুদ্ধে শহীদ আলমগীরের সমাধিতে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। বুড়িচং উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সে একটি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। আজ্ঞাপুর মোর্শেদা বেগম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্মারক স্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। শহীদ হুমায়ূন কবিরের নামে ভারেল্লা ইউনিয়নে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। [আবু ছালেক মো. সেলিম রেজা সৌরভ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!