বিলমাড়িয়া বাজার ও পল্লি গণহত্যা (লালপুর, নাটোর)
বিলমাড়িয়া বাজার ও পল্লি গণহত্যা (লালপুর, নাটোর) সংঘটিত হয় মে-জুন মাসে ৩ বার। তবে মূল হত্যাকাণ্ড ঘটে ১৫ই জুন। এতে কত লোক মারা যায় তার সঠিক হিসাব কারো জানা নেই। কারণ, তখন এলাকাটি ছিল নির্জন। গণহত্যার মুহূর্ত থেকে এলাকার মানুষ নিভৃত পল্লিতে গিয়ে আত্মগোপন করেছিল। ১৫ই জুন হাটের দিন (মঙ্গলবার) হাটের মসজিদ সংলগ্ন মাঠে লাশের স্তূপ পড়ে থাকতে দেখা যায়। ৮-১০ দিন ধরে লাশগুলো টানাটানি করে শেয়াল-কুকুরে খেয়েছে। গ্রামবাসীরা প্রথমবারের গণহত্যার পর ২১টি লাশ সনাক্ত করে গণকবর দেয়। বেওয়ারিশ লাশগুলো পড়েছিল বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে লালপুর উপজেলার বিলমাড়িয়া ইউনিয়নের বিলমাড়িয়া বাজার অবস্থিত। ১৫ই জুন সাপ্তাহিক হাটের দিন মৌলভী জামাল উদ্দিন রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে ডেকে আনে। তারা পাকিস্তানি বাহিনীকে জানায় যে, বিলমাড়িয়া গ্রামে ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা এসে আশ্রয় নেয়। গ্রামবাসী তাঁদের খাদ্য আর আশ্রয় দিয়ে সহযোগিতা করে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মৌলভী জামাল উদ্দিনের দেখানো পথ ধরে বিলমাড়িয়ার হাটের দিন এসে সমস্ত হাট ঘিরে ফেলে। অনেক মানুষ প্রাণভয়ে পালাতে থাকে। পাকিস্তানিরা পলায়নরত মানুষের ওপর নির্বিচারে মেশিনগান দিয়ে গুলি বর্ষণ করে। তারপর ধৃতদের গুলি করে হত্যা করে। চিকিৎসা পেলে সুস্থ হতেন এমন গুলিবিদ্ধদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে- খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এছাড়া, হাটের নিকটস্থ খেলার মাঠের উত্তর-পূর্ব কোণে ড্রেনের মধ্যে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে অনেককে। সমানে চলেছে লুটপাট। ঐদিন গণহত্যার পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী বাড়িগুলোতে অনেক নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। আগুনে পুড়েছে শতশত ঘরবাড়ি।
বিলমাড়িয়া বাজার ও পল্লি গণহত্যায় নিহতদের মধ্যে ২৭ জনের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন- মো. ইসমাইল হোসেন (পিতা ইয়াদালী, টেলাবপুর), জমশেদ আলী (পিতা রমজান আলী প্রামাণিক, বাথানবাড়ী), জামের আলী প্রামাণিক (পিতা গবরা প্রামাণিক, বাথানবাড়ী), ছাদের মোল্লা (পিতা সুববাজ মোল্লা, বাথানবাড়ী), খলিল মোল্লা (পিতা ইছর ডালি, টেলাবপুর), জামের আলী (পিতা আহম্মদ আলী, বাথানবাড়ী), মজিবর রহমান (পিতা ইদ্রীস সরকার, মোহরকয়া), মোয়াজ্জেম হোসেন (পিতা হারুন-অর রশিদ, মোহরকয়া), সিরাজ সরদার (পিতা ইংরাজ আলী সরদার, মোহরকয়া), নুরুননবী (পিতা ফাছু মিয়া, মোহরকয়া), ইছাহক আলী (পিতা সেকেন্দার আলী, মোহরকয়া), জুব্বার খাঁ (পিতা জানের খান, মোহরকয়া), মজু শেখ (পিতা মেরাজ শেখ, মোহরকয়া), সাবেদ স্বর্ণকার (পিতা ফাজিল স্বর্ণকার, চকবাদকয়া), বাহার সরকার (পিতা লয়েব উদ্দিন সরকার, চকবাদকয়া), আজিজুল হক (পিতা তাহের মণ্ডল, চকবাদকয়া), মকছেদ আলী (পিতা ফুলবাস প্রামাণিক, নাগশোকা), মসলেম আলী (পিতা মকছেদ আলী, মোহরকয়া), সেরাজ খলিফা (পিতা খায়ের উদ্দিন প্রামাণিক, মোহরকয়া), ফকির শা (পিতা ইদু শা, নাগশোকা), মজু শেখ (পিতা মেনার শেখ, চকবাদকয়া), হরিনারায়ণ মিস্ত্রী (পিতা কনুকন্দ হালদার, ডবলমাড়ীয়া), জসদা বেওয়া (পিতা কপি সরদার, বাথানবাড়ী), গবরা শা (পিতা জহরদী শা, নাগশোকা), জান বক্স মণ্ডল (পিতা কমেজ মণ্ডল, বাথানবাড়ী), কামেজ মণ্ডল (টেলাবপুর) ও মজির আলী (পিতা আলেপ মাঝি, গোলার দাঁড়)।
বিলমাড়িয়া বাজার ও পল্লি গণহত্যায় শহীদদের অনেককে গণকবর দেয়া হয়। সকল শহীদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। [সুমা কর্মকার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড