মুক্তিযুদ্ধে বিলাইছড়ি উপজেলা (রাঙ্গামাটি)
বিলাইছড়ি উপজেলা (রাঙ্গামাটি) পাহাড়-ঝরনা পরিবেষ্টিত এবং কাপ্তাই হ্রদের তীরে অবস্থিত। রাইক্ষ্যাং এ উপজেলার প্রধান নদী। কাপ্তাই হ্রদের পানি এসে এর সঙ্গে মিশেছে। রাঙ্গামাটি জেলার সর্বদক্ষিণে অবস্থিত এ উপজেলার আয়তন ৭৪৫.৯২ বর্গকিলোমিটার। এটি রাঙ্গামাটি জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম উপজেলা। ১৯৭৬ সালে বিলাইড়ি থানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৮৩ সালে এটি উপজেলায় রূপান্তরিত হয়। এ উপজেলার উত্তরে জুরাছড়ি উপজেলা ও রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা, পশ্চিমে কাপ্তাই ও রাজস্থলী উপজেলা, দক্ষিণ-পশ্চিমে বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি উপজেলা এবং পূর্বে মায়ানমার ও ভারতের মিজোরাম প্রদেশ।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এ উপজেলায় রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ি ঝরনা। ১৯৭১ সালে বিলাইছড়ি কোতোয়ালি থানার অধীনে ছিল। একটি মাত্র ইউনিয়ন ছিল রাইক্ষ্যাং ইউনিয়ন। এ রাইক্ষ্যাং ইউনিয়নই বর্তমান বিলাইছড়ি উপজেলা। চাকমা, ত্রিপুরা, মার্মা, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখোয়া প্রভৃতি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস এ উপজেলায়। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এ উপজেলার লোকসংখ্যা ছিল ৪ থেকে ৫ হাজারের মতো।
বিলাইছড়ির লোকসংখ্যা ছিল কম। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিক পাঞ্জাবীরা এখানে বাঁশ, কাঠ ও পাথরসহ বিভিন্ন ব্যবসা করত। কাপ্তাই পেপার মিলের কাঁচামাল হিসেবে বাঁশ এখান থেকেই নেয়া হতো। ফারুয়া, শুক্কুরছড়ি, ধুপশীল, ছাক্রাছড়ি, বিলাইছড়ি, দীঘলছড়ি, ডেবারমাথা প্রভৃতি স্থানে পাঞ্জাবী ব্যবসায়ীরা অবাধে ব্যবসা করতে থাকে। পাঞ্জাবী ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বাঙালি ব্যবসায়ী ও বাঙালি জনগণ ব্যবসার কাজে নিয়োজিত থাকায় তখন বিলাইছড়ি ব্যবসা-বাণিজ্যে সরব ছিল।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিলে সারাদেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু ছিল কাপ্তাই। বিলাইছড়ি উপজেলা কাপ্তাইয়ের নিকটবর্তী হওয়ায় যে-কোনো তথ্য দ্রুতই এ উপজেলার লোকজন পেয়ে যেত। সারাদেশের মতো কাপ্তাই উপজেলাও যখন বিক্ষোভে উত্তাল, তখন এর উত্তাপ বিলাইছড়িতেও ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে শুরু থেকেই এখানকার লোকজন আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। মিছিল-সমাবেশ হতো না বটে, তবে এলাকার সব বয়সের মানুষ এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করত। যুদ্ধ অত্যাসন্ন দেখে আওয়ামী লীগ-এর নেতারা একটি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেন।
১০ই এপ্রিল কালুরঘাটের পতনের পর দলে-দলে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা কাপ্তাই ও রাজস্থলী হয়ে বিলাইছড়ির দিকে আসতে থাকেন। প্রথম দফায় আসেন ৩০-৪০ জন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন পাকসেনাদের গুলিতে আহত। স্থানীয় লোকজন তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে। কয়েকদিন থাকার পর তাঁরা ভারতের দিকে চলে যান। এপ্রিলের শেষের দিকে কয়েক দফায় পুলিশ, ইপিআর ও মুক্তিযোদ্ধারা এসে সীমান্তের দিকে চলে যান। স্থানীয় লোকজন তাঁদের সীমান্তে যাওয়ার সহজ পথ দেখিয়ে দিয়ে সহযোগিতা করত। এছাড়াও যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রতিদিন চট্টগ্রামের পটিয়া, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, আনোয়ারা ও চন্দনাইশ থেকে শরণার্থীরা রাজস্থলী হয়ে বিলাইছড়ির দিকে আসতে থাকে। স্থানীয় লোকজন তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে এবং সীমান্ত পাড়ি দেয়ার পথ দেখিয়ে দেয়।
২৬শে মার্চ যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ থেকেই মহকুমা প্রশাসক এম আবদুল আলী সীমান্ত থেকে ইপিআর-দের ক্লোজ করে নেন। যুদ্ধ অত্যাসন্ন দেখে এখানকার লোকজন উপজেলায় যাতে শত্রুবাহিনী প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য করণীয় ঠিক করতে মিটিং করে। তবে এখানে কোনো প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ হয়নি।
এপ্রিলের ৬-৭ তারিখের দিকে বিলাইছড়ি উপজেলায় প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। এলাকার বয়স্ক লোকজন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও নেতা পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য তেমন কেউ ছিলেন না। কিন্তু এলাকার মুরুব্বিরা যুবকদের নিয়ে একটি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেন। এর আহ্বায়ক ছিলেন লেদু মিয়া সওদাগর (পরবর্তীতে সে পাকিস্তানিদের দালালে পরিণত হয়)। সুলতান সওদাগর, প্রভাত কান্তি বড়ুয়া, শাক্য প্রিয় বড়ুয়া, মনা বড়ুয়া, রবীন্দ্র বড়ুয়া, রাসহরি দে, প্রেমহরি দে, হিমাংশু, বিমল দাশ, রবীন্দ্র লাল চাকমাসহ প্রায় ৩০-৩৫ জনকে নিয়ে জোরাম এ কমিটি গঠন করা হয়। এর অধিকাংশই ছিল ছাত্র-যুবক। প্রতিরোধ কমিটির কাজ ছিল এলাকা পাহারা দেয়া, এলাকায় নতুন লোক এলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা। প্রতিরাতে যুবকরা লাঠি ও বাঁশি নিয়ে পাহারা দিত কোথাও কোনো রকমের সন্দেহজনক কিছু দেখলে বাঁশি বাজিয়ে অপর দলকে এবং এলাকার লোকজনদের সতর্ক করত। দিনের বেলা মুরুব্বিরা চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। এখানকার কোনো তথ্য কেউ পাকিস্তানিদের কাছে পৌঁছাচ্ছে কি-না সে ব্যাপারওে প্রতিরোধ কমিটির সদস্যরা খবরাখবর রাখতেন। প্রতিরোধ কমিটির যুবকরা দুটি পতাকা তৈরি করে একটি বাংলাদেশের, অপরটি পাকিস্তানের। আগে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা যখন বোটযোগে এদিকে আসতেন, তখন তাঁরা বাজারে ভিড়তেন না। দূরে-দূরে থাকতেন। যখন যুবকদের ২০-৩০ জন নদীর পাড়ে গিয়ে বাংলাদেশের পতাকা দেখাত আর ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিত, তখন তাঁরা বোট তীরে ভেড়াতেন। বাংলাদেশের পতাকা দেখেই তাঁরা বুঝতেন এখানে শত্রুবাহিনী নেই। তাঁরা যুবক ও স্থানীয় মুরুব্বিদের সঙ্গে কথা বলতেন। বিলাইছড়িতে ইপিআর সদস্যরা আসার আগে ৩-৪ জন অচেনা লোক বাজারে ঘোরাফেরা করছিল। ১২ই এপ্রিল রাত ৮-৯টার দিকে ইপিআর-দের প্রথম গ্রুপটি বিলাইছড়িতে আসে। তাঁরা সংখ্যায় ছিলেন ৩০-৪০ জনের মতো। পরদিন দুপুরে দুজন ইপিআর সদস্য বাজারে একজন লোককে চ্যালেঞ্জ করেন। লোকটি ছিল আসলে বিহারি। তার নাম আব্বাস। সে কাঠ ব্যবসায়ী। তাকে নিয়ে ইপিআর সৈন্যরা যখন কমান্ডারের কাছে রওনা হন, তখন সে পালানোর জন্য কোমর থেকে পিস্তল বের করে গুলি ছোড়ে। কিন্তু গুলি কারো গায়ে লাগেনি। গুলির শব্দ শুনে অপর ইপিআর সৈন্যরা ছুটে আসেন এবং লোকটিকে ধরে ফেলেন। পরে সে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে যে, সে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী এবং বিলাইছড়ি উপজেলায় কারা পাকিস্তানের পক্ষে আর কারা বিপক্ষে তা জানতে সে এখানে এসেছে। সে এ তথ্যও দেয় যে, বাজারের লেদু মিয়া সওদাগর তাকে এনেছে। এরপর ইপিআর-রা লেদু সওদাগরের দোকানে তল্লাশি চালিয়ে তার কেরানি ইউনুসের কাছ থেকে স্থানীয় কয়েকজনের নামের একটি তালিকা উদ্ধার করেন। তাতে উপজেলার ২৫ জনের নাম লেখা ছিল। তাদের মধ্যে প্রতিরোধ কমিটির সদস্য আর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা- সমর্থকদের নাম ছিল। লেদু সওদাগর এ তালিকার একটি কপি ইতোমধ্যে পাকিস্তানিদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে বলে স্বীকার করে। ইপিআর সদস্যরা বুঝতে পারেন যে, স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের হত্যার জন্য এক বড় ধরনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তখন তাঁরা দালাল বিহারি আব্বাস, লেদু সওদাগর ও তার কেরানি ইউনুসকে গুলি করে হত্যা করে লাশ হাসপাতালের পাশে গর্ত করে পুঁতে রাখেন। তাঁদের গুলি করার শব্দে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যেহেতু যুবকরা সারারাত পাহারায় থাকত, তাই তারা প্রায় সবাই ঘুমিয়ে ছিল। গুলির শব্দে তারাও হতচকিত হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে জানাজানি হয় যে, ইপিআর-রা গুলি করে পাকিস্তানি দোসরদের হত্যা করেছেন।
যাদের নাম চরদের কর্তৃক তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল এবং পাকিস্তানিদের হাতে চলে গিয়েছিল, তাদের কয়েকজনের বাড়িতে গিয়ে ইপিআর সদস্যরা তাদের দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এ ঘটনার দিন রাতেই ইপিআর- রা সীমান্তে চলে যান। পরের দিন ১৪ই এপ্রিল আরো একটি ইপিআর দল বাজারে আসে। স্থানীয়দের অনেকেই এ দলটির সঙ্গে সীমান্তে পাড়ি জমায়। প্রতিরোধ কমিটির যুবকরাও যে যার মতো সরে পড়েন।
এপ্রিলের শেষের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় বিলাইছড়ি উপজেলা দখলে নেয় এবং ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে।
ব্যবসায়ী লেদু সওদাগর ছিল আওয়ামী লীগের সমর্থক। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সে গোপনে পাকিস্তানিদের হয়ে কাজ করতে থাকে। উপজেলায় কারা কারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করছে সেসব তথ্য সে গোপনে পাকিস্তানিদের কাছে পৌঁছে দিত। এমনকি পাকিস্তানিদের বিলাইছড়ি আসার ক্ষেত্রেও গোপনে সে ও তার সহযোগীরা ভূমিকা পালন করে।
বিলাইছড়ি সদরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন ক্যাম্প স্থাপন করে, তখন রাজাকার বাহিনীর প্রধান ছিল কাদের মৌলভী। স্থানীয় উপজাতীয়দের অনেকে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। অনেক রাজাকার পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সমতল এলাকায় গিয়ে রণাঙ্গনে যুদ্ধও করে। তখন তাদের অনেকের ন মৃত্যু হয়। চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের নির্দেশে স্থানীয় হেডম্যান ও কার্বারীরা শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। এছাড়াও স্থানীয় উপজাতীয় যুবকদের নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী সংগঠন ‘হিল রাজ’ গঠন করা হয়। এসব রাজাকার, হিল রাজ ও শান্তি কমিটির সদস্যরা টি অস্ত্রকাঁধে ঘোরাফেরা করত। তারা স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সাধারণ न লোকজনদের টাকা-পয়সা ও মালামাল লুট করে নিয়ে যেত। , বিহারি কাইয়ুম খান ও রাজাকার প্রধান কাদের মৌলভী শান্তি র কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় সাবিত্রী নামে এক পাহাড়ি তরুণীসহ দুজনকে ক্যাম্পে এনে দুসপ্তাহের মতো বন্দি করে রাখে এবং ধর্ষণ করে। এছাড়া পাকিস্তানি সেনারা রাজাকারদের সহায়তায় বেশ কয়েকজন নারীকে ক্যাম্পে এনে ধর্ষণ করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্তমান বিলাইছড়ি মডেল হাইস্কুল প্রাঙ্গণে ছিল বিশিষ্ট বাঙালি ব্যবসায়ী আহমদ আলী সওদাগরের বাসা। পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তায় রাজাকার ও তাদের সহযোগীরা ঐ বাসাসহ বিলাইছড়ির বিভিন্ন স্থানে লুট করে অনেক মূল্যবান সরঞ্জামাদি নিয়ে যায়। তারা আহমদ আলী সওদাগরের নিজস্ব ব্যবহৃত দ্রুতগতির ২টি স্পিডবোট পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। এমনি অবস্থায় আহমদ আলী সওদাগর পাকিস্তানি বাহিনীর ভয়ে বিলাইছড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান।
ইউনিয়ন পরিষদ ক্যাম্প ছিল পাকিস্তানি সেনাদের র নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির।
বিলাইছড়ির ফারুয়া-সুখছড়ির মোহনায় পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ছিল। সেখানে পাঞ্জাবী, রাজাকার ও আলবদরসহ প্রায় ২৫০ জন অবস্থান করত। তাদের ব্যবহারের জন্য ছিল কয়েকটি গানবোট। আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে পাইলট মান্নানসহ মুক্তিবাহিনীর একটি দল। পাহাড়ি এলাকায় পথ হারিয়ে রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি বাহিনীর ফারুয়া ক্যাম্পের অভ্যন্তরে এসে পড়ে। এ-সময় বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা ই পড়ে নৃশংসভাবে শহীদ হন। এ ঘাঁটিতে সুলতান আহমদ কুসুমপুরীর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারাও এভাবেই একবার আক্রান্ত হয়েছিলেন। সুবেদার টি আলী এখানেই শহীদ হন এবং সুলতান আহমদ কুসুমপুরী ও চন্দনাইশের আবু ইসলাম আহত হন।
ডিসেম্বরের প্রথম দিকে বিএলএফ পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরের ল উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম অঞ্চল মুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এ-সময় চট্টগ্রাম, ঢাকা, কুমিল্লা ও নোয়াখালীর অসংখ্য বিএলএফ সদস্য রাঙ্গামাটি হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। এ অপারেশনে নেতৃত্ব দেন ভারতীয় জেনারেল ওবাম। সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন বিএলএফ-এর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার শেখ ফজলুল হক মণি পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে চট্টগ্রামের বাইরে থেকে যাঁরা নেতৃত্ব দেন, তাঁরা হলেন- ঢাকার হাশিম উদ্দিন খান পাহাড়ি, কুমিল্লার খুরশীদুল আলম, নাজমুল আহসান পাখি, মনিরুল হক চৌধুরী প্রমুখ। চট্টগ্রামের এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী (আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মেয়র), নুরন্নবী চৌধুরী, রাজু (ডলফিন) ও সালাহউদ্দিন হারুনের নেতৃত্বে কয়েক হাজার বিএলএফ যোদ্ধা একই সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করেন।
হাশিম উদ্দিন খান পাহাড়ির নেতৃত্বে দেড় থেকে দুশ মুক্তিযোদ্ধা রাঙ্গামাটি এবং সালাহউদ্দিন হারুনের নেতৃত্বে দেড়শর মতো মুক্তিযোদ্ধা কাপ্তাই দিয়ে চট্টগ্রামের দিকে আসতে থাকেন। দেমাগ্রী দিয়ে ৩ কলামে ভাগ হয়ে একটি দল নিয়ে ঢোকেন এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, ডলফিন, নাজিম উদ্দিন আহমদ রাজু ও মিরেশ্বরাইয়ের কবির উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। এ দলে ছিলেন প্রায় ৫শ মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। হাশিম উদ্দিন খান পাহাড়ির দলটি আসার পথে পাঞ্জাবী ও মিজো বাহিনীর যৌথ আক্রমণের শিকার হয় এবং এতে ৮- ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সীতাকুণ্ডের হামিদ আহত হয়ে পঙ্গু হয়ে যান। যুদ্ধে পাঞ্জাবী ও মিজোরা পিছু হটে। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ফারুয়ায় অবস্থানরত ছদ্মবেশী পাঞ্জাবীরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে টহলরত গানবোটযোগে ফারুয়া থেকে বরকলের দিকে এগোনোর সময় মুক্তিবাহিনীর মহিউদ্দিন গ্রুপের ওপর আচমকা আক্রমণ করে। এতে বেশকিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। চার ঘণ্টা যুদ্ধশেষে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে।
পাকিস্তানি সেনারা ১লা ডিসেম্বর বিলাইছড়ি সদর থেকে চলে যায়। কিন্তু ফারুয়ায় তখনো মিজো বাহিনী ও রাজাকারদের অবস্থান ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কাপ্তাই থেকে মিত্রবাহিনীর একটি দল গানবোটে করে ফারুয়া যাওয়ার পথে সেখানে অবস্থানরত মিজো বাহিনী অতর্কিতে দলটির ওপর আক্রমণ করে। তারা বরকলে মিত্রবাহিনীর আক্রমণে রাইক্ষ্যাং নদী দিয়ে ফারুয়ার দিকে আসছিল। ভারতীয় সৈন্যরাও পাল্টা আক্রমণ করেন। এ-সময় দুপক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। এতে উভয় পক্ষের ১০-১২ জন হতাহত হয়। ২২শে ডিসেম্বর সর্বশেষ মিজো বাহিনী ও রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে এবং এদিনই বিলাইছড়ি উপজেলা সম্পূর্ণরূপে হানাদারমুক্ত হয়। [ইয়াছিন রানা সোহেল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড