You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা (সুনামগঞ্জ)

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা (সুনামগঞ্জ) সুনামগঞ্জ শহর থেকে উত্তর-পশ্চিমে ১৫ কিমি দূরে অবস্থিত। দক্ষিণ বাদাঘাট, ধনপুর, পলাশ, ফতেহপুর এবং শলুকাবাদ এই ৫টি ইউনিয়ন নিয়ে এ উপজেলা গঠিত। ১৯৭৯ সালে বিশ্বম্ভরপুর থানা গঠিত এবং ১৯৮৩ সালে তা উপজেলায় রুপান্তরিত হয়। উপজেলার উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে সুনামগঞ্জ সদর ও জামালগঞ্জ উপজেলা, পূর্বে সুনামগঞ্জ সদর, পশ্চিমে তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলা। উপজেলার পূর্ব-দক্ষিণ দিক দিয়ে সুরমা নদী বয়ে গেছে। মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে গারো, খাসিয়া, হাজং, মনিপুরী, নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী নিয়ে হাওর বেষ্টিত এক পশ্চাৎপদ জনপদ বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা। মুক্তিযুদ্ধকালে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে নৌকা ও পায়ে হাঁটা ছাড়া কোনও বিকল্প ছিল না। ১৯৭০-এর নিবার্চনে এ আসন থেকে আওয়ামী লীগ মনোনিত প্রার্থী আব্দুজ জহুর মিয়া এমপিএ নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও যখন পাকিস্তানি সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের সুযোগ না দিয়ে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে, তখন সারা দেশের ন্যায় এখানকার মানুষও চরম বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ–এর পর আব্দুজ জহুর মিয়া এমপিএ-র নেতৃত্বে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় সুনামঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, টেকেরঘাট, সাচনাসহ বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হতে থাকে।
২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর এদিন বিকেলে সুনামগঞ্জ জেলা সদরসহ অন্যান্য থানায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২৭শে মার্চ সুনামগঞ্জ জেলাসহ বিভিন্ন উপজেলায় সর্বদলীয় স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ কমিটি গঠিত হয়। আব্দুজ জহুর মিয়া এমপিএ-র নেতৃত্বে গঠিত সংগ্রাম কমিটি বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। সংগ্রাম পরিষদের অন্য সদস্যরা হলেন— রমেন্দ্র রাম চক্রবর্তী, নূরুল হুদা, আবদুন নূর আকঞ্জি, গোলাম মোস্তফা, মোজাহিদ উদ্দিন আহমদ, আবু তাহের, আবুল হোসেন খান, আবদুল কুদ্দুস, ফতেহ আলী মজুমদার, আবদুছ ছত্তার প্রমুখ। সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আব্দুজ জহুর মিয়া এমপিএ-র তত্ত্বাবধানে ইপিআর সদস্য গনি হাবিলদার, আবু তালেব, আবদুল মোতালেব, আবু সুফিয়ান, মো. লাল মিয়া (কাঠাখালি), জবান আলী (মাছিমপুর) স্থানীয় আনসার ও পুলিশ সদস্যদের সমন্বয়ে ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি রাজাপাড়া নামক স্থানে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করেন। তাছাড়া ভাদেরটেক গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে হানাদার বাহিনী প্রতিরোধে ভূমিকা রাখেন। তাঁরা এ গ্রামে বাংকার তৈরি করে এর মধ্যে অবস্থান নিয়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ পরিচালনা করেন।
হাওর বেষ্টিত এলাকা হওয়ায় সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে সন্দেহভাজন কোনো নৌযান দেখা গেলে তা দ্রুত সুনামগঞ্জের কার্যালয়ে অবহিত করা হতো। ছাত্র- যুবকরা নদীর পাড় ও হাওরের পাড়ে বাংকার বানিয়ে অতন্দ্র প্রহরীর মতো পালাক্রমে রাত জেগে পাহারা দিত। মুক্তিযোদ্ধা মো. তাজ্জুত খান (বর্তমান উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান), মো. ওয়াহাব প্রমুখ ভারতের অভ্যন্তরে ‘ক্যাম্প এইট বেইজ’ নামে একটি ট্রেনিং সেন্টারে অন্যদের সঙ্গে ৩০ দিন ট্রেনিং গ্রহণ করেন।
২৫শে মার্চ মধ্যরাতে ঢাকায় নারকীয় গণহত্যা শুরুর পর লোকজন ঢাকা ছেড়ে যে যেদিকে পারে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। এ অবস্থায় এ উপজেলার লোকজনও ভারত সীমান্তে বালাট নামক স্থানে শরণার্থী শিবিরে চলে যায়। ভারতের বালাট ক্যাম্পে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও অসুস্থ লোকজনকে চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য ডাক্তার সতীশ চন্দ্র দাশ (ষোলঘর, সুনামগঞ্জ), ডাক্তার মকব্বির আলী (ষোলঘর, সুনামগঞ্জ), বাসন্তী নার্স (জেল রোড, সুনামগঞ্জ) প্রমুখ ও ভারত সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় একটি অস্থায়ী বেইজ হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়।
ঐ অস্থায়ী বেইজ হাসপাতালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, শরণার্থী শিবিরের লোকজন চিকিৎসা সেবা নিতে আসত।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় কমান্ডার হিসেবে ইপিআর সদস্য গনি হাবিলদার দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া আব্দুজ জহুর মিয়া এমপিএ, রমেন্দ্র রাম চক্রবর্তী, নূরুল হুদা, আবদুন নূর আকঞ্জি, গোলাম মোস্তফা, মোজাহিদ উদ্দিন আহমদ, আবু তাহের, আবুল হোসেন খান, আবদুল কুদ্দুস, ফতেহ আলী মজুমদার, আবদুছ ছত্তার, দেওয়ান কামাল রাজা, মনোয়ার বখ্ত, শাহজাহান বখ্ত, সুবাস বখ্ত, হোসেন বখ্ত, তাজ্জুত খান, আবদুল খালেক, হারিস উদ্দিন, আব্দুল কাদির, ব্রজ গোপাল শর্মা, শ্যামল বরণ আচারিয়া প্রমুখ সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন।
দেশের অন্য জায়গার মতো সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধা আবু তালেব, মোতালেব, জগৎজ্যোতি দাস- প্রমুখ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৫ ও ১৬ই মার্চ ইপিআর সদস্য গনি হাবিলদার-এর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা দুজন পাকিস্তানি সৈন্যকে বস্তাবন্দি করে রাজাপাড়ায় হত্যা করেন।
২৯শে এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে তারা উপজেলায় অবস্থান না করে সুনামগঞ্জ শহরের পুরাতন সার্কিট হাউসে ক্যাম্প স্থাপন করে। এখান থেকে তারা তাদের কর্মকা- পরিচালনা করত।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। শান্তি কমিটির প্রধান উদ্যোক্তা ছিল উপজেলার মো. সুন্দর আলী মোড়ল। তার নেতৃত্বে এখানে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। উপজেলার রাধানগরের মো. আপ্তাব উদ্দিনের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। শান্তি কমিটি এবং রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করত।
উপজেলায় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হবার পর এদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিভিন্ন গ্রামে নির্যাতন, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা হানাদারদের মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি-ঘর চিনিয়ে দিত। হানাদার বাহিনী উপজেলার উত্তর-পূর্ব দিকে ভারত থেকে বহমান চলতি নদী পাড় হয়ে নারায়ণ তলায় নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। এতে কয়েকজন গ্রামবাসী শহীদ হন।
সুনামগঞ্জ শহরের পুরাতন সার্কিট হাউস ও সুনামগঞ্জ কলেজ ক্যাম্প ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে নারী-পুরুষদের ধরে এনে এ ক্যাম্পে তাদের ওপর নির্যাতন করত।
উপজেলার উত্তরে ভারত সীমান্ত সংলগ্ন চিনাকান্দি বাজারের রাজাপাড়ায় একটি বধ্যভূমি আছে। নারায়ণ তলা গণহত্যায় শহীদদের একটি গণকবর রয়েছে।
উপজেলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরারং, চিনাউড়া, বইসেরপাড়, উরারখান্দা ও ভাদেরটেকে যুদ্ধ ও সংঘর্ষ হয়। এগুলোর মধ্যে ভাদেরটেক যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। ২৭শে আগস্ট, ৯ই সেপ্টেম্বর ও ২৬শে নভেম্বর সংঘটিত এ যুদ্ধে ২৬ জন পাকসেনা ও ৩ জন রাজাকার নিহত হয়। অপরদিকে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ কয়েকজন গ্রামবাসী শহীদ হন। যুদ্ধে হানাদার বাহিনী গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করে নারীনির্যাতন, লুণ্ঠন এবং অগ্নিসংযোগ করে।
উপজেলায় ২ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা যায়। তাঁরা হলেন- কাঠাখালি গ্রামের মো. লাল মিয়া ও মাছিমপুর গ্রামের জবান আলী|
নভেম্বর মাসের শেষদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর্যুপরি আক্রমণে হানাদার বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ৪ঠা ডিসেম্বর রাতের অন্ধকারে তারা পালিয়ে যায়। ৬ই ডিসেম্বর বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার উত্তরে ভারত সীমান্ত সংলগ্ন রাজাপাড়ায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। উপজেলা থেকে প্রায় ১০ কিমি পূর্ব-দক্ষিণ দিকে জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সুরমা নদীর ওপর নব নির্মিত সেতুটির নাম মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক (স্বাধীনতা পরবর্তীতে ৩ বার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত) আব্দুজ জহুর মিয়া এমপিএ-র নামানুসারে ‘আব্দুজ জহুর সেতু’ নামকরণ করা হয়েছে। [প্রমথ রঞ্জন চক্রবর্তী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!