You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে বিরামপুর উপজেলা (দিনাজপুর)

বিরামপুর উপজেলা (দিনাজপুর) ১৯৮৩ সালে ফুলবাড়ী, নবাবগঞ্জ ও হাকিমপুর উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত হয়। এর উত্তরে ফুলবাড়ী ও নবাবগঞ্জ উপজেলা, দক্ষিণে হাকিমপুর উপজেলা ও পশ্চিমবঙ্গ (ভারত), পূর্বে নবাবগঞ্জ ও হাকিমপুর উপজেলা এবং পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গ (ভারত) ও ফুলবাড়ী উপজেলা। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের সময় এ উপজেলাটি ফুলবাড়ী, নবাবগঞ্জ ও হাকিমপুর উপজেলার অধীনে ছিল, সেহেতু এ উপজেলার মুক্তিযুদ্ধ উল্লিখিত তিনটি উপজেলার অধীনেই পরিচালিত হয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচন উপলক্ষে গণসংযোগে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- বিরামপুর রেল স্টেশনে একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ-বঞ্চনা ও বৈষম্যের কথা তুলে ধরেন। তাঁর বক্তৃতা বিরামপুরের সর্বস্তরের জনগণকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। ফলে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সারাদেশের মতো এখানেও আওয়ামী লীগ- প্রার্থী মো. ওয়াকিল উদ্দিন মণ্ডল বিপুল ভোটে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ষড়যন্ত্র শুরু করলে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে স্বাধীনতার ডাক দেন। তাঁর ডাকে সারাদেশের সঙ্গে বিরামপুরের মুক্তিকামী জনগণও মুক্তিসংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়।
মো. ওয়াকিল উদ্দিন মণ্ডল এমএনএ এবং সরদার মোশাররফ হোসেন এমপিএ-এর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। নবাবগঞ্জ থানার আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. শফিউদ্দিন সরদার, সহ-সভাপতি মো. শাহ্ জলিলুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল জলিল মণ্ডল; হাকিমপুর থানার আওয়ামী লীগ সভাপতি কাজী আব্দুল মজিদ চৌধুরী, আব্দুল কুদ্দুস মুন্সী, ছাত্রনেতা হাসান চৌধুরী, মোখলেসুর রহমান; ফুলবাড়ী থানার অধ্যক্ষ মো. আব্দুল আজিজ, আওয়ামী লীগ সভাপতি ডা. মোজাফ্ফর আহমেদ, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা রূপনারায়ণ রায়, ছাত্র ইউনিয়ন-এর আজিজ বাবু, মনসুর আলী, ছাত্রলীগ-এর মোকছেদ আলী শাহ্, মঞ্জুর হোসেন, মোস্তাফিজার রহমান; বিরামপুর থানার ছাত্রনেতা মিজানুর রহমান ও শাহজাহান প্রমুখ যুবসম্প্রদায়কে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করতে থাকেন। সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হয়। চারদিকে লাঠিসোঁটা, তীর-ধনুক, বল্লমসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র সংগ্রহে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে নবাবগঞ্জ, ফুলবাড়ী ও হাকিমপুর থানার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আনসার, পুলিশ, ইপিআর ও অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। তারই অংশ হিসেবে এলাকার অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য ডা. কাশেম বিরামপুর হাইস্কুল মাঠে ছাত্র-যুবকদের যুদ্ধের কলাকৌশল বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন। একই সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও আনসার, পুলিশ, ইপিআর ও অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যদের যৌথ উদ্যোগে ফুলবাড়ী, নবাবগঞ্জ, হাকিমপুর ও বিরামপুর অঞ্চলে বিশাল গণপ্রতিরোধ বাহিনী গড়ে ওঠে।
২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবর বিরামপুর অঞ্চলে পৌঁছলে সর্বস্তরের জনগণ স্তম্ভিত হয়ে যায়। পাকিস্তানি বাহিনীর নীলনকশা অনুযায়ী সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টের অবাঙালি সৈন্যরা বাঙালি সৈন্যদের হত্যার ষড়যন্ত্র করে। তারা বিভিন্ন কায়দায় বাঙালি সেনাদের নিরস্ত্র করতে শুরু করে। কিন্তু বাঙালি সেনাসদস্যরা তা বুঝতে পেরে নিজেদের মধ্যে সংগঠিত হতে থাকেন। ৩১শে মার্চ মধ্যরাতে বাঙালি অফিসার মেজর মো. আনোয়ার হোসেনের ব্যারাকে পাকিস্তানি গোলন্দাজ বাহিনী অতর্কিতে হামলা চালায়। কিন্তু বাঙালি সৈন্যরা প্রস্তুত থাকায় মধ্যরাত থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত প্রচণ্ড গোলাগুলি করেও পাকবাহিনী ব্যারাকে প্রবেশ করতে পারেনি। পাকবাহিনী চারদিক থেকে ব্যারাক ঘেরাও করার চেষ্টা করলে মেজর আনোয়ার তাঁর বাহিনীসহ ফুলবাড়ী এসে ডিফেন্স দেন। পরদিন ১লা এপ্রিল সুবেদার রহমতুল্লাহ পাকিস্তানি মেজর সাফায়াত হোসেনকে হত্যা করে ফুলবাড়ীতে মেজর আনোয়ারের সঙ্গে যোগ দেন এবং ১০ই এপ্রিল ক্যাপ্টেন আশরাফ ও লে. মোখলেস তাঁদের কোম্পানি নিয়ে ফুলবাড়ীতে অবস্থান নেন। ১১ই এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী ফুলবাড়ী আক্রমণ করলে তুমুল সংঘর্ষ হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে বাঙালি সৈন্যরা টিকতে না পেরে বিরামপুরে এসে আশ্রয় নেন এবং নিজেদের সংগঠিত করতে থাকেন। পাকিস্তানি বাহিনী যাতে বিরামপুর দখল করতে না পারে সেজন্য বিরামপুরের বিভিন্ন রাস্তায় শক্তিশালী ডিফেন্স তৈরি করা হয়। ক্যাপ্টেন আশরাফের নেতৃত্বে বিরামপুর-ফুলবাড়ী রোড এবং মেজর আনোয়ারের নেতৃত্বে বিরামপুর-ঘোড়াঘাট রোডে ডিফেন্স বসানো হয়। এছাড়া লে. মোখলেসের কোম্পানিকে ডেপথ কোম্পানি হিসেবে রাখা হয়। ১৩ই এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী বগুড়া দখল করে পাঁচবিবি হয়ে হিলি দখলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলে বিরামপুরে অবস্থানরত তিন বাহিনী হিলিতে ডিফেন্স রচনা করতে এগিয়ে যায়। এ-সময় এলাকার ছাত্র- যুবকরা বিরামপুরের বিভিন্ন স্থানে সড়ক কেটে এবং সড়কে গাছ ফেলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। ১৮ই এপ্রিল দাউদপুর-বিরামপুর সড়ক দিয়ে দুজন বাঙালি সেনাসহ একজন পাকিস্তানি সেনা অফিসার গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় কাটা রাস্তায় তাদের গাড়ি আটকে যায়। এ খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় জনগণ লাঠিসোঁটা নিয়ে ছুটে এসে তাদের আক্রমণ করে। তারা পাকিস্তানি অফিসারকে হত্যা করে এবং বাঙালি সৈন্য দুজনকে নিরস্ত্র করে মো. ওয়াকিল উদ্দিন মণ্ডলরে নিকট হস্তান্তর করে। পরে অবশ্য এলাকার ক্ষুব্ধ জনগণ তাদেরও হত্যা করে। এভাবেই বিরামপুর এলাকায় সাধারণ জনগণ ও ছাত্র-যুবকরা পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাঙালি ও বিহারিদের মধ্যে বেশ কয়েকটি সংঘর্ষ হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে পাকিস্তানি বাহিনীর কর্মকর্তা খিজির হায়াত খানের নেতৃত্বে বিরামপুর ডাকবাংলোয় একটি সেনাক্যাম্প স্থাপিত হয়। এর কয়েকদিন পর পাকবাহিনী মাদিলা হাট, চিন্তামন চৌধুরীবাড়ি ও কেটরা বাজারে আরো তিনটি ঘাঁটি স্থাপন করে। খিজির হায়াত খান স্থানীয় বিহারিদের সহায়তায় বাঙালি নিধনের নীলনকশা প্রণয়ন করে। নীলনকশা বাস্তবায়নের জন্য তারা রাজাকার, আলবদর ও
শান্তি কমিটি গঠন করে। উপজেলার কয়েকজন কুখ্যাত রাজাকার হলো— মধু বিহারি (বিরামপুর সদর), লাল বিহারি (বিরামপুর সদর), মো. ইসহাক (বিরামপুর সদর), নাসির বিহারি (বিরামপুর সদর), সাবান বিহারি (বিরামপুর সদর), বয়েন উদ্দিন (শিবপুর, যোথবানী), কাইয়ুম উদ্দিন (শিবপুর, যোথবানী), জহির উদ্দিন (শিবপুর), আবুল চৌধুরী (একইর), সোবহান ফকির (একইর), আবু তাহের (একইর), ফজলার রহমান চেয়ারম্যান (ভেলারপাড়), কফিল উদ্দীন (ভেলারপাড়), শাহার উদ্দিন (চকশীলবান), কলিমুদ্দিন (চকশীলবান), ছলিমুদ্দিন (চকশীলবান), বগা (চাকুল, গোটগাছ), জাইদুল (চাকুল, গোটগাছ), মনছের আলী (চাকুল, গোটগাছ), আলাউদ্দিন মণ্ডল (চাকুল, গোটগাছ), কিয়ামুদ্দিন (কসবা, সাগরপুর), মোসলেম উদ্দিন (কসবা, সাগরপুর), হামিদা বেগম (কেটরাহাট), ইলি হাজী (দাউদপুর), আফাজ মণ্ডল (বেলুকুরিয়া) এবং ছলিম ফকির (শ্যামনগর)। এসব রাজাকার, আলবদর ও স্থানীয় বিহারিরা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মিলে তাণ্ডব শুরু করে।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর থেকেই বিরামপুর এলাকার কতিপয় পাকিস্তানপন্থী বাঙালি স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারা নিজেদের মধ্যে সংগঠিত হতে থাকে। ভেলারপাড়ের ফজলার চেয়ারম্যান, মতিহারের আব্বাস চেয়ারম্যান, বিসকিনি গ্রামের আব্দুস সাত্তার ও হায়াতপুরের আবুল মাস্টারের নেতৃত্বে বিরামপুর এলাকায় রাজাকার বাহিনী গড়ে ওঠে। ২৫শে মার্চের পর তারা ‘ইসলাম’ রক্ষার নামে এলাকার বয়স্কদের শান্তি কমিটিতে যোগ দেওয়ায় এবং যুবকদের ধরে এনে রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলে। রাজাকারদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য তাদের স্বল্প পরিসরে প্রশিক্ষণ দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়া হয়। এরপর তারা পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে নিরীহ গ্রামবাসীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শহর এলাকায় বিহারি এবং গ্রাম এলাকায় রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় নারকীয় কর্মকাণ্ড চালায়। তারা ফুলবাড়ী, বিরামপুর ও হিলি রেল লাইনের দুপাশের সকল গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। রাজাকার ও আলবদররা এলাকার যুবক ও নারীদের ধরে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। বিহারিরা বাঙালি নিধনে উন্মত্ত হয়ে ওঠে বিরামপুরে বিশুদ্ধ পানীয় জলের জন্য বেশ কয়েকটি ইঁদারা ছিল। সেগুলোর মধ্যে গরুহাটি কুয়া এবং ২নং ও ৪নং রাইস মিল ইঁদারা উল্লেখযোগ্য। বিহারিরা পাকিস্তানি আর্মির সহায়তায় বাঙালিদের ধরে এনে জবাই করে এসব ইঁদারায় ফেলে দিত। চাকু দিয়ে ছোট-ছোট শিশুদের পেট চিড়ে ভুঁড়ি বের করে ইঁদারায় ফেলে দিত। বিরামপুর রেল স্টেশনের পশ্চিম পাশে পূর্ব জগন্নাথপুরের ৪নং রাইস মিল ও বিরামপুর পাইলট স্কুলের পাশে ওয়াহেদ ওভারশিয়ারের বাড়ি ছিল বিরামপুর এলাকার নির্যাতনকেন্দ্র। যে-সকল যুবক ভারতে যেত, রাজাকাররা তাদের তথ্য সংগ্রহ করত এবং মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে তাদের পরিবারে হানা দিত। তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিত, গবাদিপশু নিয়ে যেত এবং তাদের পরিবারের নারীদের ধরে এনে পাকসেনাদের হাতে তুলে দিত তাদের মনোরঞ্জনের জন্য। বয়স্কদের গুলি করে হত্যা করত। বিশেষকরে, তারা হিন্দুদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুঠতরাজ করত এবং তাদের কাউকে পেলেই হত্যা করত। ফলে ছাত্র-যুবকরা ভয়ে এলাকা ছেড়ে যেতে শুরু করে। অনেকে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে অবস্থান নেয়, আবার অনেকে সীমান্তের ওপারে যুব অভ্যর্থনা কেন্দ্রের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটমেন্ট সেন্টারগুলোতে চলে যায়।
ভারতীয় সীমান্ত-সংলগ্ন একটি গ্রাম কুন্দনহাট। এখানে একটি হাট ছিল। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার হাট বসত। সীমান্ত সংলগ্ন হওয়ায় হাটের দিন ভারত থেকে শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধারাও এখানে বাজার করতে আসতেন। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে পাকসেনারা স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় এ হাটে নিরীহ মানুষদের ওপর গুলি চালায়। এতে ১৩ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। এ ঘটনা কুন্দনহাট গণহত্যা নামে পরিচিত।
বিরামপুর উপজেলায় দুটি বধ্যভূমি আছে— ১নং ও ২নং ইঁদারা বধ্যভূমি। এখানে যুদ্ধের নয়মাসে বিহারিরা শতাধিক বাঙালি যুবক ও শিশুকে হত্যা করে তাদের লাশ ইঁদারায় ফেলে দেয়।
১৭ই এপ্রিল শপথ পাঠের মধ্য দিয়ে প্রথম বাংলাদেশ সরকার বা মুজিবনগর সরকার-এর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস বৃদ্ধি পায় এবং তাঁরা বিশেষ উদ্দীপনার সঙ্গে সংগঠিত হতে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ের জন্য সারাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। রংপুর-দিনাজপুর নিয়ে গঠিত হয় পশ্চিম জোন-১। এ জোনের আওতায় দিনাজপুর অঞ্চলের আশেপাশে ভারতের অভ্যন্তরে যেসব ক্যাম্পে ফুলবাড়ী-বিরামপুর এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নেন এবং পরবর্তীতে সেখান থেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর একের পর এক আক্রমণ করেন, সেগুলোর মধ্যে গঙ্গারামপুর ক্যাম্প, প্রাণসাগর ক্যাম্প, ডালিমগাঁও ক্যাম্প, পতিরাম ক্যাম্প, হামজাপুর ক্যাম্প, বড়গ্রাম ক্যাম্প, ইলন্দর ক্যাম্প, কাটলা ক্যাম্প, খিয়ারমামুদপুর ক্যাম্প, আঙ্গিনাবাদ ক্যাম্প ও কামারপাড়া ক্যাম্প উল্লেখযোগ্য। কাটলা ক্যাম্প ও খিয়ারমামুদপুর ক্যাম্প বিরামপুর এলাকার কাছাকাছি হওয়ায় এ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা বিরামপুরের পাকিস্তানি ক্যাম্পগুলোতে ব্যাপক আক্রমণ চালান। তবে এদুটি ক্যাম্পে বিরামপুরসহ দিনাজপুরের অন্যান্য থানার মুক্তিযোদ্ধারাও ছিলেন। আবার বিরামপুরের মুক্তিযোদ্ধারা দিনাজপুরের অন্যান্য অঞ্চলেও যুদ্ধ করেন।
১৯শে এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী হিলি আক্রমণ করলে মেজর মো. আনোয়ার হোসেনের বাহিনীর সঙ্গে তাদের চারঘণ্টাব্যাপী তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে অনেক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয় এবং শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে। কিন্তু ২০শে এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী সংগঠিত হয়ে পুনরায় হিলি আক্রমণ করে। এদিন মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার হাফিজ, নায়েক সুবেদার করম আলী এবং নায়েক সুবেদার শফিউল্লাহ তাঁদের স্ব-স্ব কোম্পানি নিয়ে মেজর আনোয়ারের সঙ্গে যোগ দিলে পাকিস্তানি বাহিনী পুনরায় পিছু হটতে বাধ্য হয়। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর মর্টার ও শেলিংএ সীমান্তের ওপারে কয়েকজন ভারতীয় নাগরিক মারা গেলে ভারতীয় বিএসএফ- এর কর্নেল মুখার্জী, পশ্চিম দিনাজপুরের ডিএম এবং পুলিশ সুপারের অনুরোধে গভীর রাতে মেজর আনোয়ার বাহিনী হিলি থেকে ১৩ মাইল দূরে ভারতের কামারপাড়া নামক স্থানে কুরমাইল বেসিক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে প্রায় ২৫০ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ আশ্রয় গ্রহণ করেন। মো. ওয়াকিল উদ্দিন মণ্ডল, সরদার মোশারফ হোসেন, কাজী আব্দুল মজিদ চৌধুরীসহ মুক্তিযুদ্ধের অনেক সংগঠকও সেদিন ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধারা মো. ওয়াকিল উদ্দিন মণ্ডল এবং ক্যাপ্টেন আশরাফ আলীর নির্দেশে বিরামপুর ও হিলি সরকারি খাদ্যগুদাম থেকে রসদ হিসেবে ৪০০ বস্তা চাল নিয়ে যান। ২১শে এপ্রিল হিলি এবং পরবর্তীতে বিরামপুর, ফুলবাড়ী ও নবাবগঞ্জ পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে চলে যায়।
বিরামপুরের কেটরাহাটে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর একটি শক্তিশালী ক্যাম্প। ৪ ও ৫ই ডিসেম্বর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি গ্রুপ একযোগে আক্রমণ করে ক্যাম্পটি দখল করে। এতে ১৩ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়, অন্যদিকে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এটি কেটরাহাট যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ-যুদ্ধের পর জীবিত পাকসেনারা পালিয়ে গিয়ে পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয় এবং ৩-৪ ঘণ্টা পরে পাল্টা আক্রমণ করে ক্যাম্পটি পুনর্দখল করে। প্রথমবারের যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ হিসেবে পাকবাহিনী ২১শে আগস্ট রাজাকারদের সহায়তায় কেটরা গ্রামের পার্শ্ববর্তী কুন্দনহাটে গণহত্যা চালায়।
পাকিস্তানি সেনারা ১লা ডিসেম্বর থেকে বিরামপুর, ফুলবাড়ী ও নবাবগঞ্জের ছোট-ছোট ক্যাম্পগুলো সরিয়ে নিতে শুরু করে এবং নবাবগঞ্জের ভাদুরিয়া বাজারে একটি শক্তিশালী ক্যাম্প গড়ে তোলে। ৬ই ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর ট্যাংক বহর ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করে ফুলবাড়ী হয়ে বিরামপুরের দিকে অগ্রসর হয়। এ-সময় বিরামপুর সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে অবিরাম গোলাবর্ষণ চলছিল। কিন্তু মিত্রবাহিনীর আগমনের পর পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়। ফলে, এদিনই বিরামপুর উপজেলা পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হয়। বিরামপুর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— রিয়াজ উদ্দিন (পিতা জমির উদ্দিন, মামুদপুর), কাজী দারাজ (পিতা কাজী মো. আছির উদ্দিন, মামুদপুর), মো. হোসেন (পিতা মো. আনোয়ারুল হক, উত্তর ভগবতীপুর), মো. আইয়ুব হোসেন (পিতা ফসিউদ্দিন মণ্ডল, পূর্ব জগন্নাথপুর), মজিবর রহমান (পিতা মো. ইয়াকুব আলী, পূর্ব জগন্নাথপুর), মংলা কর্মকার (পিতা ষষ্ঠী কর্মকার, পূর্ব জগন্নাথপুর), আবুল কাশেম (পিতা ছবেত আলী ফকির, চরকাই), দেলোয়ার হোসেন (পিতা শাহ্ মামুদ হোসেন, চকদুর্গা), সৈয়দ আলী (পিতা মফিজ উদ্দিন, মোয়াপুকুর), মকবুল হোসেন (পিতা মনসুর আলী, মোয়াপুকুর), মোহাম্মদ আলী (পিতা মনসুর আলী, মোয়াপুকুর), মো. হাসান (পিতা মো. মনসুর রহমান, মোয়াপুকুর), আব্দুল জব্বার মুকুল (পিতা আব্দুর রহমান মোল্যা, বিরামপুর পূর্বপাড়া), আব্দুল জব্বার (পিতা ওমর উদ্দিন মণ্ডল, পুইনন্দা), মঈন উদ্দিন (পিতা আবুল হোসেন, মঙ্গলপুর), কাওসার উদ্দিন (পিতা কলিম উদ্দিন, বৈদ্যাহার), কওয়াব উদ্দিন (পিতা খলিল উদ্দিন, বৈদ্যাহার), শুকুর উদ্দিন (পিতা ছইমুদ্দিন, রাণীনগর), নূরুল ইসলাম (পিতা বিষু মণ্ডল, মল্লিকপুর), নঈম উদ্দিন (পিতা আব্দুল গফুর, মল্লিকপুর), আব্দুর রহিম (পিতা সুমার উদ্দিন মুন্সী, চাঁদপুর), সন্তোষ কুমার মহন্ত (পিতা চন্দ্ৰমোহন মহন্ত, শিমুলতলী), ফরায়েজ হোসেন (পিতা ফজর উদ্দিন মুন্সী, খোসালপুর), মজিবর রহমান (পিতা কফিল উদ্দিন, বিরামপুর), সারাজ উদ্দিন (পিতা মো. তছির উদ্দিন, দাউদপুর), রিয়াজ উদ্দিন (পিতা মো. গমির উদ্দিন, খিয়ারমামুদপুর), নজরুল ইসলাম (পিতা তছির উদ্দিন মণ্ডল, ভেরম), মো. হান্নান (পিতা আনোয়ারুল ইসলাম, বগলসাথিপুর) এবং মো. আইয়ুব আলী (পিতা ফমি উদ্দিন, জগন্নাথপুর)।
বিরামপুর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে বঙ্গবন্ধু ও ৪ জাতীয় নেতার প্রতিকৃতিসহ একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। এচাড়া পৌর এলাকার পূর্বপাড়া থেকে ডাক্তার সিরাজুলের বাড়ি পর্যন্ত সড়কের নাম রাখা হয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মুকুল সড়ক। [সৈয়দ রেদওয়ানুর রহমান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!