মুক্তিযুদ্ধকালীন পত্রিকা ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ (বরিশাল সদর)
বিপ্লবী বাংলাদেশ (বরিশাল সদর) মুক্তিযুদ্ধকালীন একটি পত্রিকা। মুক্তিযোদ্ধা নূরুল আলম ফরিদসহ বরিশালের কয়েকজন উদ্যোগী তরুণের প্রচেষ্টায় ৯ম সেক্টর থেকে আগস্ট মাস থেকে এটি প্রকাশিত হয়।
মে মাসে বরিশালের মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র আর সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ৫০ জনের একটি দল সুন্দরবনের নদী-নালা আর দুর্গম পথ অতিক্রম করে ভারতের চব্বিশ পরগণার হাসনাবাদে গিয়ে পৌঁছান। তাঁরা সেখানে একটি প্রশিক্ষণ অভ্যর্থনা কেন্দ্র গড়ে তোলেন। জুলাই মাসের শেষদিকে এ ক্যাম্পে নূরুল আলম ফরিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ হোসেন (কালু ভাই)-এর। দুজনে একটি পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ তখন বিপ্লবের রণাঙ্গন। এ থেকে পত্রিকার নামকরণ করা হয় বিপ্লবী বাংলাদেশ। সম্পাদক হন নূরুল আলম ফরিদ, কর্মাধ্যক্ষ ইউসুফ হোসেন, ফটোগ্রাফার তৌফিক ইসলাম দীপু ও মানস। পত্রিকার নামের ডিজাইনের জন্য ইউসুফ হোসেন কালু ভাই কলকাতার মনোহর পুকুর লেনে বাংলাদেশের শিল্পী অশোক দা-র ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ‘ক্যানভাসে’ যান। তিনি পত্রিকাটির ডিজাইন করে দেন। ক্যানভাসে ভারতীয় শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদদের আড্ডা ছিল। তাঁরা পত্রিকাটি প্রকাশের ব্যাপারে সর্বপ্রকার সহযোগিতার আশ্বাস দেন। কলকাতার রিপন স্ট্রিটের ক্রান্তি প্রেস থেকে ৪ঠা আগস্ট বিপ্লবী বাংলাদেশ পাক্ষিক হিসেবে প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এ সংখ্যা ছাপা হয় ৫ হাজার কপি। ছাপার পর পত্রিকাটি ৯নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স হাসনাবাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শিবির, অপারেশন ক্যাম্প এবং বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে পৌঁছে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা বিপ্লবী বাংলাদেশ হাতে পেয়ে উল্লসিত হন। তাঁদের কাছে এ যেন একটি বিজয়ী রণাঙ্গন। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের মাসিক ৭৫ টাকা ভাতার একটি অংশ পত্রিকার জন্য ব্যয় করতেন, যাতে এর প্রকাশনা অব্যাহত থাকে। ইতোমধ্যে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সাংবাদিক মিন্টু বসু বিপ্লবী বাংলাদেশ-এ যোগ দেয়ায় এটি নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। পত্রিকার প্রথম সংখ্যার শিরোনাম ছিল ‘ঘরে ঘরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’। এর সম্পাদকীয় শিরোনাম ছিল “বিশ্ববিবেকের কাছে আবেদন’। ২৯শে আগস্ট পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয় ‘মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর যতই দিন যাচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধাদের জয় তত সুনিশ্চিত হয়ে উঠছে’। ৪র্থ সংখ্যা থেকে পত্রিকাটিতে নিয়মিত ‘মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরি’ শিরোনামে নিবন্ধ লেখা হতো। এসব নিবন্ধ বার্তা সম্পাদক মিন্টু বসুই বিভিন্ন জনের নামে লিখতেন।
কলকাতার রিপন স্ট্রিটের আরএসপি-র ক্রান্তি প্রেস থেকে ছাপা হলেও ‘চাঁপা প্রেস, বাংলাদেশ’ এ ছদ্মনাম প্রিন্টার্স লাইনে থাকত। এক পর্যায়ে মুজিবনগর সরকার-এর নিকট থেকে বিপ্লবী বাংলাদেশ ডিক্লারেশন লাভ করে। প্রকাশের পরপরই এ সম্বন্ধে পশ্চিমবঙ্গের সাপ্তাহিক কম্পাস মন্তব্য করে, ‘পত্রিকাটি স্বাধীনতা যুদ্ধে একটি দূরপাল্লার কামানের চেয়ে বেশি কাজ করছে’। পশ্চিমবঙ্গের সত্যকাম সেনগুপ্ত, মঞ্জু চট্টোপাধ্যায়, দিলীপ কুমার দাস, শৈলেন্দু বিকাশ মৈত্র, অচিন্ত্য কুমার ঘোষ, পশ্চিমবঙ্গের সমতট পত্রিকার সম্পাদক অর্ঘ্য্যকুসুম দাশগুপ্ত, অধ্যাপক পরিতোষ রায়চৌধুরী, মোহাম্মদ আব্দুল হাফিজ, অবাঙালি সাহিত্যিক অধ্যাপক রমেশ কুমার বিল্লোরে, কবি অনুপা চক্রবর্তী, পশ্চিমবঙ্গের সাপ্তাহিক গণবার্তা-র সম্পাদক অধ্যাপক বীরেশ ভট্টাচার্য, কবি-সাহিত্যিক অধ্যাপক বিষ্ণু দাস, কবি অধ্যাপিকা মীরা দে, অধ্যাপক জিষ্ণু দে প্রমুখ বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাহিত্যিক নিয়মিতভাবে এ পত্রিকায় লিখতেন। সত্যকাম সেনগুপ্ত ছিলেন বিপ্লবী বাংলাদেশ-এর স্থানীয় (পশ্চিমবঙ্গ) ব্যুরো প্রধান। বিপ্লবী বাংলাদেশ-এর কলকাতাস্থ -ঠিকানা ছিল- ২২/২৬ মনোহরপুকুর রোড, কলিকাতা|
কলকাতা থেকে ১৯৭১ সালের ২৬শে ডিসেম্বর পর্যন্ত পত্রিকাটির ১৯টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এরপর ৩০শে ডিসেম্বর বরিশাল থেকে এটি নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৯১ সালের ৯ই জুলাই থেকে বিপ্লবী বাংলাদেশ সাপ্তাহিক থেকে দৈনিকে রূপান্তরিত হয়ে এখনো চলমান রয়েছে। [মনিরুজ্জামান শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড