মুক্তিযুদ্ধে বিরল উপজেলা (দিনাজপুর)
বিরল উপজেলা (দিনাজপুর) জেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে ভারতীয় সীমান্তে অবস্থিত। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এ উপজেলার মানুষও মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ আহুত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হঠাৎ ১লা মার্চ স্থগিত ঘোষণা করায় বিরলের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। অতঃপর দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র মানুষের ওপর পাকবাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ডের খবর বিরলে এসে পৌঁছলে তাদের বিক্ষোভ চরমে ওঠে। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে গণহত্যা শুরু হলে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ যুদ্ধের সূচনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বিরল উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচিত হয়।
২৮শে মার্চ দিনাজপুর ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স কুঠিবাড়িতে ৩০ জন পাঠান-পাঞ্জাবি ইপিআর-এর বিরুদ্ধে ২৫ জন বাঙালি ইপিআর লড়াই করে কুঠিবাড়িটি দখল করে নেন। এরপর তাঁদের কয়েকজন অস্ত্র নিয়ে বিরলে চলে আসেন এবং এখান থেকেই মূলত দিনাজপুরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য বিরল থানায় আওয়ামী লীগ-এর নেতৃত্বে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। কমিটির আহ্বায়ক করা হয় বিরল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ফজলুর রহমানকে। এর সদস্যদের মধ্যে অধ্যাপক মজিবর রহমান, আনোয়ার আলী, মেহেদুল, ইদ্রিস আলী, আবদুল আজিজ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য প্রাথমিক প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হয় প্রাক্তন সৈনিক আব্দুল জব্বার, বিরল থানার একজন এসআই ও রামপুরের (ভারত) একজন আনসার কমান্ডারকে। বিরল হাইস্কুল মাঠে রাইফেল চালানোর স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণে স্থানীয় যুবকদের অনেকে অংশ নেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ উপজেলায় উপর্যুক্ত নেতৃবৃন্দ সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। আর কমান্ডারের ভূমিকার পালন করেন জর্জ দাস (প্রাক্তন সৈনিক), আব্দুল জব্বার (প্রাক্তন সৈনিক), মো. মজিবর রহমান, মো. আবুল কাশেম অরু এবং মোহাম্মদ আলী সরকার।
১৩ই এপ্রিল বিকেলে পাকবাহিনী দিনাজপুর শহরে প্রবেশ করে। এর একদিন পর ১৬ই এপ্রিল তারা বিরল অভিমুখে রওনা দিলে বিরল বাজারের সন্নিকটে আব্দুল মালেক নামে একজন মুক্তিযোদ্ধার নেতৃত্বে সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিরোধের চেষ্টা করে। কিন্তু এতে ব্যর্থ হয়ে তারা পিছু হটে। প্রতিরোধ করতে গিয়ে আব্দুল মালেক আহত হন। পরে তাঁকে ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরে একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পাকসেনারা বিরল বাজারে পৌঁছে তাদের দোসরদের সঙ্গে নিয়ে বাজারের দোকানপাট ও আশপাশের কয়েকটি বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে দিনাজপুর ফিরে যায়। এর ৩-৪ দিন পর আবার তারা বিরলে এসে থানা হেডকোয়ার্টার্সে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে|
বিরল উপজেলায় পাকবাহিনীর সহযোগী ব্যক্তিরা হলো- মাহবুব আলম (পিতা আমিনউদ্দিন, মির্জাপুর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), আবদুল জলিল (কাজীপাড়া), নইমুদ্দীন ওরফে নমোকামার (রামপুর), মৌলানা মোব্বাসউদ্দীন (আকরগ্রাম), মো. ওয়াছে (রামপুর), আফতাবউদ্দীন (গোপালপুর), শাহ মোহাম্মদ (রবিপুর), জয়নালউদ্দীন (জগতপুর), সোলায়মান আলী (বৈদ্যনাথপুর), মো. আব্দুল বারী (বালান্দোর), সুরমান আলী (রামচন্দ্রপুর), সরিফউদ্দীন (ওকড়া), শহিরউদ্দীন আহাম্মদ (খোপড়াগ্রাম), সরিয়তুল্লাহ দরজী (মোখলেসপুর), মোহাম্মদ ইবরাহিম (আজিমপুর), ইমদাদুল হক (আজিমপুর), আহসান আলী (বানগ্রাম), মোহাম্মদ এরফান আলী (হাছিটা), তজিউদ্দিন ওরফে গণেশ (ভারাডাঙ্গী), মফিজুর রহমান (বিরল; রাজাকার কমান্ডার), আনুিল ইসলাম বটু (আমুলিয়া) এবং হাফিজউদ্দিন (দোগাছী)।
বিরল উপজেলায় পাকবাহিনী অনুপ্রবেশের পর এখানকার বিভিন্ন গ্রামে একাধিক হত্যা, গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়। তন্মধ্যে ভান্ডারা গণহত্যা পশ্চিম রাজারামপুর গণহত্যা ও বহলা গণহত্যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভান্ডারা গণহত্যা সংঘটিত হয় এপ্রিলের শেষদিকে পাকসেনা ও স্থানীয় রাজাকারদের দ্বারা। এদিন ভান্ডারা গ্রামের ৮ জনকে হত্যা করে ঘটনাস্থলেই তাদের কবর দেয়া হয়। তাই এ স্থানটি ভান্ডারা গণকবর নামে পরিচিত। পশ্চিম রাজারামপুর গণহত্যা সংঘটিত হয় ১৯শে মে ভোররাতে। এ-সময় রাজাকারদের সহায়তায় একদল পাকসেনা গ্রামটি ঘিরে ফেলে এবং ১৮ জনকে ধরে নিয়ে যায়। একই সময়ে তারা পার্শ্ববর্তী গ্রামের আরো ৭ জনকেও ধরে নিয়ে যায়। পরে জানা যায় যে, তুলাই নদীর তীরে তাদের হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়। বহলা গণহত্যা সংঘটিত হয় ১৩ই ডিসেম্বর। এদিন বহলা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকসেনারা পিছু হটে পালিয়ে যাওয়ার সময় বহলা গ্রামের ৩৭ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। নিহতদের যে-স্থানে কবর দেয়া হয়, সেটি বহলা গণকবর নামে পরিচিত। এছাড়া পাড়ীপুকুর, ভোক্তাহার ও ভারাডাঙ্গীতে আরো তিনটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। পাড়ীপুকুর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে। এ সময় পাকসেনারা গোপালপুর গ্রামের তিনজন এবং পাকুড়া গ্রামের দুজনকে ধরে নিয়ে রেল লাইনের পার্শ্ববর্তী পাড়ীপুকুর নামক একটি পুকুরের পাড়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন- হরমুজ আলী (পিতা হেদেল মোহাম্মদ, গোপালপুর), মজিরউদ্দিন (পিতা বরকত উল্লাহ, গোপালপুর), সফিউদ্দিন (পিতা নশো মোহাম্মদ, গোপালপুর), তমিজউদ্দিন (পিতা হাসান মাহমুদ, পাকুড়া) এবং মসিরউদ্দিন (পিতা জামালউদ্দিন, পাকুড়া)। ভোক্তাহার হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় বিরল রেলওয়ে স্টেশনের এক কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ভোক্তাহার নামক একটি বিলের ধারে। এখানে পাকসেনারা ধর্মদহ গ্রামের আব্দুস সাত্তারহ আরো তিনজনকে ধরে এনে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে এবং একই গর্তে মাটিচাপা দেয়। ভারাডাঙ্গীতে হিন্দু সম্প্রদায়ের তিনজনকে হত্যা করা হয়। নিহতরা হলেন- জিতেন্দ্রনাথ (পিতা গলিচান), গলিচান (পিতা মুকুন্দ বর্মণ) এবং ফুলেশ্বর রায় (পিতা প্রিয়তম বর্মণ)। মে মাসে সেনগ্রাম গণহত্যা সংঘটিত হয়। এতে ৬ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান।
বিরল উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি যুদ্ধ হয়- বগুলাখাড়ীর যুদ্ধ। ১৩ই ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন ইদ্রিস ও লেফটেন্যান্ট সাইফুল্লাহর নেতৃত্বে সংঘটিত এ যুদ্ধে দুশজন মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। এ-যুদ্ধে ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ২৫ জন আহত হন। ১৪ই ডিসেম্বর বিরল উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- সিপাহি আব্দুল মজিদ, বীর বিক্রম (পিতা হাজী আদার মোহাম্মদ, রামচন্দ্রপুর)।
বিরল উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— যৌগ্য চন্দ্র রায় (পিতা জংলু রাম রায়, শহরগ্রাম), আব্দুল মালেক (পিতা জহর মোহাম্মদ, রামচন্দ্রপুর), কিরেন্দ্র নাথ রায় (পিতা ভুন্দরী রায়, খোদ শিবপুর), শ্রীনারায়ণ (পিতা মুকুন্দ মোহন্ত, দক্ষিণ রামপুর), বিজয় কুমার রায় (পিতা মংলু চন্দ্র রায়, ঠনঠনিয়াপাড়া), রইসউদ্দিন (পিতা মো. তসিরউদ্দিন, ঝারপুকুরিয়া), আফাজউদ্দিন (পিতা হাসিমউদ্দিন সরকার, রামচন্দ্রপুর), তৈমুর রহমান (পিতা গিয়াসউদ্দীন, কামদেবপুর), সামসুল হক (পিতা মজিরউদ্দীন, বসন্তপুর), মো. মনসুর আলী (পিতা নব মোহাম্মদ, ধজিরপাড়া), বিনয় চন্দ্র রায় (পিতা দেবেন্দ্র নাথ রায়, পাইকপাড়া), সামসুদ্দিন আহাম্মদ (পিতা চেমঠু মোহাম্মদ, গোপালপুর), আব্দুল লতিফ (পিতা সামসুদ্দিন, কামদেবপুর), মজিবুর রহমান (পিতা মহিরউদ্দিন, তেঘরা মহেশপুর), আব্দুল জলিল মিঞা (পিতা ইসমাইল মিঞা, রঘুনাথপুর) এবং আবুল কাশেম (পিতা হাসেন আলী, হরিপুর)।
উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে উপজেলা চত্বরের সম্মুখে একটি স্মৃতিসৌধ, বহলা গ্রামের গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে বহলায় একটি স্মৃতিসৌধ, উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে দিনাজপুর-বিরল রাস্তা-সংলগ্ন খোসালডাঙ্গায় মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ এবং পশ্চিম রাজারামপুর গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে ২০১৩ সালে ফুলবাড়িহাট স্কুল-সংলগ্ন স্থানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। [এম এ কাফি সরকার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড