বিটঘর গণহত্যা (সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
বিটঘর গণহত্যা (সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) সংঘটিত হয় ৩১শে অক্টোবর। এতে ৮০ জন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সরাইল থানাধীন পানিশ্বর (উত্তর) ইউনিয়নের বিটঘর গ্রাম ছিল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন একটি এলাকা। বর্ষাকালে নৌকা ব্যতীত এ গ্রামে পৌঁছানো একেবারেই অসম্ভব ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিশ্বরোড থেকে আনুমানিক ৭ কিলোমিটার উত্তরে, আশুগঞ্জ থেকে ১২ কিলোমিটার পূর্বে এবং মেঘনা নদী থেকে ২ কিলোমিটার পূর্বে এ গ্রামের অবস্থান। গ্রামের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে উত্তর- দক্ষিণে একটি খাল রয়েছে। খালটি ফকিরবাড়ি খাল বা ছোট খাল নামে পরিচিত|
কষ্টকর যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে বিটঘর গ্রামটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিরাপদ স্থান। মাঝে-মধ্যে
রাজাকার মনু মিয়ার নেতৃত্বে ৪০-৫০ জন রাজাকার এ গ্রামে হানা দিত। মুক্তিযোদ্ধারা কোনো-কোনো সময় তাদের প্রতিরোধ করতেন। অক্টোবরের শেষদিকের কোনো এক রাতে মনু মিয়ার নেতৃত্বে রাজাকাররা বিটঘর বড়ইবাড়ি আক্রমণ করলে অল্পসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু রাজাকারদের গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা বিরাম আলী আহত হয়ে সীতাহরণ গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন।
অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে সকাল ১১টার দিকে রাজাকার মনু মিয়া পাঞ্জাবি এক অফিসারকে নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় বিটঘর গ্রামে ঢুকে জনৈক মহিলার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করলে মহিলাটি মনু মিয়ার কানে কামড় দিয়ে দৌড়ে পালানোর সময় পাঞ্জাবি অফিসার ও মনু মিয়া অস্ত্র রেখে মহিলাটিকে ধরার জন্য পেছন-পেছন দৌড় দেয়। মহিলার চিৎকারে গ্রামের ১০-১২ যুবক ধর্ষকদের ধাওয়া করে। মনু মিয়া পালাতে পারলেও পাঞ্জাবি অফিসার বিটঘরের দক্ষিণে সীতাহরণ গ্রামে ধরা পড়ে। মুহূর্তে হাজারো গ্রামবাসী জড়ো হয়ে উত্তেজিত অবস্থায় পাঞ্জাবি অফিসারকে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে টুকরো-টুকরো করে ফেলে। ততক্ষণে মনু মিয়া কালীকচ্ছ ঘাঁটিবাড়িতে পাঞ্জাবি ক্যাম্পে (বর্তমান বিজিবি ক্যাম্প) গিয়ে খবর দেয়। দুপুর তখন আনুমানিক ২টা। খবর শোনামাত্র একজন মেজর ও একজন কর্নেল মনু মিয়ার প্রতি ভীষণ ক্ষেপে যায়। সুচতুর মনু মিয়া তাদের ভাঙ্গা-ভাঙ্গা উর্দুতে কী যেন বলে। ফলে ঐ দুই পাকসেনা শান্ত হয়ে যায়। তারপর ঐদিন সন্ধ্যায় মনু মিয়া কালীকচ্ছ গ্রামের ৩ জন নারীকে তাদের হাতে তুলে দেয়। তারা তাদের কুমিল্লা ক্যান্টমেন্টে নিয়ে যায়।
৩১শে অক্টোবর সকাল বেলা সরাইলের পশ্চিম এলাকায় সৈনিক হত্যার প্রতিশোধ নিতে সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশুগঞ্জ থেকে দুই শতাধিক পাকসেনা এসে বিটঘর গ্রামটি ঘিরে ফেলে। পার্শ্ববর্তী গ্রামের রাজাকাররা পথ দেখিয়ে তাদের নিয়ে আসে। তারা গ্রামের ঘরে-ঘরে তল্লাশি চালিয়ে নিরীহ গ্রামবাসীদের ছোট খালের পূর্ব পাশে জড়ো করে। তারপর ৮- ১০ জন করে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করতে থাকে। কাউকে- কাউকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। লাইন থেকে দৌড়ে পালিয়ে মন্তাজ উদ্দিন, আশকর আলী ও সফর আলী বেঁচে যান। এ ঘটনায় গ্রামের প্রতিটি পরিবারেরই একাধিক লোক নিহত হন, নির্যাতিত হন গ্রামের আরো অনেক নারী-পুরুষ। ঘটনার পর বেঁচে যাওয়া গ্রামবাসী এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোকজন এসে নিহতদের লাশ দাফন করে।
বিটঘর গ্রামের মালেকা খাতুন (৬৭), ছেলামত আলী (৫৬), আবদুর রইছ মিয়া (৭৫), পেশকার খাতুন (৬৫), আছিয়া খাতুন (৬৪), ফুলবানু (৬৫), নূরজাহান বেগম (৫৫), জোবেদা খাতুন (৬০), উম্মে হানি (৭০), রাফিয়া খাতুন (৬৫) প্রমুখের কারো স্বামী, কারো পিতা, কারো ছেলে, কারো ভাই এ নৃশংস গণহত্যার শিকার হন। বিটঘর গ্রামে প্রায় সব সময়ই মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ছিল। গ্রামবাসী নিজেরা না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়েছে। গণহত্যায় নিহতদের লাশ দাফন করতে ২-৩ দিন লেগেছিল, কারণ লাশগুলো বিভিন্ন সময়ে ভেসে উঠছিল।
বিটঘর গণহত্যায় যেসব রাজাকার পাকসেনাদের সাহায্য করে, তারা হলো- সরাইল ঠাকুর বাড়ির মুজাহিদ কমান্ডার মতিন ঠাকুর, গুনারার আবদুল হাই রাজাকার, ছোট দেওয়ান পাড়ার ইদন মিয়া ওরফে ইদন রাজাকার, সৈয়দটুলার মনু মিয়া, সরাইল দেওয়ান বাড়ির গেদু মিয়া, বিটঘরের আবদুল হেকিম প্রমুখ৷
বিটঘর গণহত্যা ছিল নির্মম ও হৃদয়বিদারক। এতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার মালিহাতা গ্রামের ৪ জন, বুধল গ্রামের ১ জন, সরাইল উপজেলার শান্তিনগর গ্রামের ২ জন, সীতাহরণ গ্রামের ১ জন, নাইলা গ্রামের ১১ জন এবং বিটঘর গ্রামের ৬১ জনসহ মোট ৮০ জন শহীদ হন। ২৯শে অক্টোবর সরাইল থানা অপারেশন ও ৩০শে অক্টোবর সীতাহরণ গ্রামে পাকিস্তানি সৈনিক হত্যার প্রতিশোধে বিটঘর গণহত্যা ঘটে।
বিটঘর গণহত্যায় শহীদরা হলেন- আবু বকর (পিতা জয়নাল আবেদীন, ইউপি সদস্য), হাবিবুর রহমান (পিতা মো. রহিম উদ্দিন, কৃষক), আবদুস সামাদ (পিতা অহেদ আলী, কৃষক), ইদ্রিস আলী (পিতা অহেদ আলী, কৃষক), হোসেন আলী (পিতা মন্তাজ আলী, কৃষক), অমৃত দেবনাথ (পিতা অবনি দেবনাথ, ব্যবসায়ী), শামছুদ্দিন (পিতা আব্দুল আলী, কৃষক), মিরাজ আলী (পিতা আবদুল হাসিম, কৃষক), আব্দুল মিয়া (শ্রমিক), আবু আহাম্মদ (পিতা আব্দুল আলী, কৃষক), করম আলী (পিতা জব্বর আলী, ব্যবসায়ী), মফিজ উদ্দিন (পিতা জয়নুদ্দিন, ব্যবসায়ী), দরবেশ আলী (পিতা আব্দুর রশিদ, ব্যবসায়ী), সিদ্দিক আলী (পিতা আব্দুর রশিদ, ব্যবসায়ী), বোরহান উদ্দিন (পিতা হাফিজ উদ্দিন, ছাত্র), নূর হোসেন (পিতা মুন্সী নাঈম উদ্দিন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী), হামদু মিয়া (পিতা আব্দুল লতিফ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী), নান্নু মিয়া (পিতা আব্দুল লতিফ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী), জজ মিয়া (পিতা আব্দুল লতিফ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী), শামসু মিয়া (পিতা জিন্নত আলী, কৃষক), লাবু মিয়া (শ্রমিক), আব্দুল মোত্তালিব (পিতা বুধাই মিয়া, শ্রমিক),সমশের আলী (পিতা লাল মাহমুদ, শ্রমিক), আব্দুল বারিক (পিতা জুরু মিয়া, শ্রমিক), আবুল হোসেন (পিতা সৈয়দ আলী, শ্রমিক), আব্দুস ছোবহান (পিতা সৈয়দ আলী, শ্রমিক), আব্দুস ছাত্তার (পিতা আব্দুল হামিদ, ব্যবসায়ী), আব্দুল মজিদ (পিতা আনছার আলী, ব্যবসায়ী), রহমত আলী (পিতা আব্দুল মজিদ ওরফে আবু মিয়া, কৃষক), বকস আলী (পিতা আব্দুল হাসিম, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী), রমজান আলী (পিতা আব্দুল হাসিম, শ্রমিক), ছমিরউদ্দিন (পিতা আমির উদ্দিন, কৃষক), আব্দুল হেলিম (পিতা হাফিজ উদ্দিন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী), আবুল বাশার (পিতা আব্দুল বারেক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী), আব্দুল অদুদ (পিতা রমিজ আলী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী), ফালু মিয়া (পিতা সুরুজ আলী, শ্রমিক), সোনা মিয়া (পিতা আবদুল কাদির, শ্রমিক), চান মিয়া (পিতা আবদুল কাদির, কৃষক), আব্দুল মোতালিব (পিতা মজব আলী, শ্রমিক), জমশিদ মিয়া (পিতা আব্দুল রইছ, কৃষক), আলেক খাঁ (পিতা জয়নাল আবেদীন, ব্যবসায়ী), মমরিছ খাঁ (পিতা জয়নাল আবেদীন, ব্যবসায়ী), সোবান মিয়া (পিতা আইন উল্লাহ, কৃষক), মুসলিম উদ্দিন (পিতা কাছু মিয়া, কৃষক), উমর আলী (পিতা কাইম উল্লাহ, শ্রমিক), পটু মিয়া (পিতা আব্দুল গণি, শ্রমিক), আবদুল জলিল (পিতা চান্দ আলী, কৃষক), মুর্তুজ আলী (কৃষক), মাহফুজ মিয়া (পিতা আব্দুল হাসিম, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী), ইউসুফ আলী (পিতা আব্দুল খালেক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী), শুকুর মাহমুদ (পিতা আব্দুল খালেক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী), দারু মিয়া (পিতা আব্দুল খালেক, কৃষক), ইসলাম উদ্দিন (পিতা আব্দুল খালেক, কৃষক), হালিম মিয়া (কৃষক), আব্দুল মজিদ (পিতা আব্দুল করিম, শ্রমিক), আব্দুল গফুর (পিতা দানিস মিয়া, শ্রমিক), রসত আলী (পিতা আব্দুল আলী, কৃষক), আব্দুল মন্নাফ (পিতা ইসমাইল, কৃষক), আব্দুল মজিদ (কৃষক), আব্দুল হেকিম (পিতা সেকান্দর আলী, কৃষক), আব্দুল আলী (চাকরিজীবী), নুরু মিয়া (পিতা আলীমউদ্দিন, নাইলা; কৃষক), আব্দুর রশিদ (পিতা মাছুন আলী, নাইলা; কৃষক), খুরশিদ আলী (পিতা মাছুন আলী, নাইলা; কৃষক), আবদুর রউফ (পিতা মাছুন আলী, নাইলা; ব্যবসায়ী), বাদশা মিয়া (নাইলা, কৃষক), আব্দুল মোত্তালিব (পিতা আব্দুল হেকিম, নাইলা; কৃষক), আব্দুল জব্বার (পিতা সৈয়দ আলী, নাইলা; কৃষক), বুদাই মিয়া (পিতা বাদশা মিয়া, নাইলা; কৃষক), নুরু মিয়া (পিতা আব্দুর রহমান, নাইলা; ব্যবসায়ী), আব্দুল ছোবান (নাইলা, ব্যবসায়ী), মো. সোনা মিয়া (পিতা কালা গাজী, নাইলা; কৃষক), মন্তাজ আলী (পিতা জুর আলী, মালিহাতা; কৃষক), মন্নর আলী (পিতা জুর আলী মালিহাতা; কৃষক), নুর মিয়া (পিতা ছুরত আলী, মালিহাতা; কৃষক), আবদুল কাহহার (পিতা আবদুল হামিদ, মালিহাতা; কৃষক), আবদুর রহিম (পিতা সমুজ আলী, বুধল; কৃষক), মকসুদ আলী (পিতা সৈয়দ আলী, শান্তিনগর; কৃষক), মনজুর আলী (পিতা সৈয়দ আলী, শান্তিনগর; কৃষক) এবং আব্দুল মান্নাফ (পিতা ইসমাইল মিয়া, সীতাহরণ; কৃষক)। [মানবৰ্দ্ধন পাল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড