বিদ্যাকুট যুদ্ধ (নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
বিদ্যাকুট যুদ্ধ (নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) ২২শে সেপ্টেম্বর সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এ-যুদ্ধে ২৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য ও শতাধিক রাজাকার নিহত এবং বহুসংখ্যক হানাদার সদস্য আহত হয়। অপরদিকে হানাদার বাহিনীর গোলার আঘাতে কয়েকজন নিরীহ গ্রামবাসী আহত হন।
নবীনগর উপজেলার বিদ্যাকুটের বনবিহারী বর্মণের বাড়ির একতলা প্রাসাদে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প স্থাপন করেন। এ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন গ্রুপ কমান্ডার এস এম ইউছুফ ও বিদ্যাকুট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ-এর সাধারণ সম্পাদক মো. আ. হাফিজ। ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য ছাত্র- যুবকরা এ ক্যাম্পে একত্রিত হতেন, আবার ট্রেনিংপ্রাপ্ত দূর- দূরান্তের মুক্তিযোদ্ধারা বিদ্যাকুটে ট্রানজিট ক্যাম্প হিসেবে নিরাপদ স্থান মনে করে স্বল্পকালীন অবস্থান ও বিশ্রাম নিয়ে যার-যার অঞ্চলে চলে যেতেন। হানাদার বাহিনীর কাছে খবর ছিল বিদ্যাকুট মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সুরক্ষিত ঘাঁটি। হানাদাররা এ ক্যাম্প আক্রমণ করার জন্য বিভিন্ন স্থানে সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে থাকে। অপরদিকে এ ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের যাতায়াতের সুবিধার্থে সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম-এর নির্দেশে সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন বিদ্যাকুটের আশপাশের এলাকায় তৎপরতা বৃদ্ধি করেন।
পার্শ্ববর্তী এলাকায় মুক্তিবাহিনির ১০-১২টি দলের অতর্কিত হামলায় পাকবাহিনী তাদের প্রচুর সৈন্য ও রসদ হারাতে থাকে। ক্রমান্বয়ে পুরো এলাকায় মুক্তিসেনারা পাকিস্তানি সেনাদের মনে ত্রাসের সৃষ্টি করেন। বিদ্যাকুট হাইস্কুল মাঠের পূর্ব-দক্ষিণে সকল মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁদের সংবাদদাতাদের (গুপ্তচর) নিয়ে প্রত্যহ বিকেলে যুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল ও তিতাস নদী দিয়ে পাকহানাদার বাহিনীর রসদ সরবরাহকারী নৌযান কীভাবে ধ্বংস করা যায় ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতো। প্রাসাদের একটি কক্ষে মাইনসহ অন্যান্য বহনযোগ্য অস্ত্রশস্ত্র মজুদ রাখা হতো। অন্যান্য কক্ষে মুক্তিযোদ্ধারা নিজ-নিজ অস্ত্র নিয়ে রাতে বিশ্রাম নিতেন। স্থানীয় ও আশপাশের গ্রামের কিছু লোকজন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচর বাহিনী গঠিত হয়েছিল।
২২শে সেপ্টেম্বর গ্রুপ কমান্ডার এস এম ইউছুফ সহযোদ্ধা শ্রমিক নেতা আ. রউফ (মেরকুটা), ইউছুফ আলী (আমিনপুর), মো. শাহজাহান মোল্লা (বিদ্যাকুট), চাঁন মিয়া (রসুলপুর) প্রমুখকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি রামচরাইলে (বর্তমানে সেলিমনগর) অবস্থান করেন। হানাদার বাহিনী এ খবর জানতে পেরে রাত ৮টার দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে মর্টারের গোলা ছোড়ে। কিন্তু তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে উত্তর দিকের বাড়িতে পড়লে ইউছুফ আলী, ধন মিয়ার ২ পুত্র মো. শাহজাহান (১২) ও আ. মালেক (১০) নিহত এবং তার ৮ বছরের কন্যা হেলেনা, পুত্র হানিফ ও কন্যা জোবেদা আহত হয়। এ ঘটনা দ্বারা মুক্তিযোদ্ধারা বুঝতে পারেন অচিরেই হানাদার বাহিনী বিদ্যাকুট গ্রাম আক্রমণ করবে। কমান্ডার এস এম ইউছুফ গুপ্তচর আমিনপুরের আলী মিয়ার কাছ থেকে জানতে পারেন হানাদার বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নয়নপুর খেয়াঘাট থেকে নৌকায় করে তাদের দোসরদের নিয়ে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সঙ্গে-সঙ্গে তিনি কমান্ডার বকুল (চরিলাম), কমান্ডার হিমাংশু দত্ত (ছদ্মনাম ইকবাল, কালিকচ্ছ, সরাইল), কমান্ডার শহীদুল্লাহ (নাটঘর) ও আর্মি সাপ্লাই কোরের রিয়াজুল হাই চৌধুরীকে নিয়ে আলোচনায় বসে হানাদার বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের ছাত্রনেতা কমান্ডার হুমায়ুন কবীর তাঁর বাহিনী নিয়ে রাতের বেলা বিদ্যাকুটে প্রবেশ করেন। ইতোমধ্যে বিদ্যাকুটের উত্তর দিকে আইল্লাপুকুর ও উত্তর পাড়া মসজিদের পাশে মুক্তিযোদ্ধারা বাংকার তৈরির কাজ দ্রুত সম্পন্ন করেন।
কমান্ডার এস এম ইউছুফ ও কমান্ডার হুমায়ুন কবীর, মুক্তিযোদ্ধা মো. হোসেন, মাসুম (পৈরতলা) প্রমুখ বিদ্যাকুটের বিষ্ণু মাঝিকে নিয়ে নৌকাযোগে কালিসীমা গ্রামে কমান্ডার হুমায়ুন কবীরের মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। সাক্ষাৎ শেষে বিদ্যাকুটের দিকে রওনা হওয়ার সময় তাঁরা দেখতে পান উত্তর রসুলপুরের দক্ষিণ দিক দিয়ে অনেকগুলো নৌকায় করে হানাদার বাহিনী রাজাকারসহ বিদ্যাকুট আক্রমণের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসছে। ২৩শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পূর্বে কমান্ডার এস এম ইউছুফ ও কমান্ডার হুমায়ুন কবীরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বিদ্যাকুট গ্রামে পৌছেন। সেখানে পৌঁছে তাঁরা আর্মি সাপ্লাইকোরের সদস্য রিয়াজুল হাইয়ের নেতৃত্বে একটি দলকে বিদ্যাকুট উত্তর পাড়ার মসজিদের পাশে এম্বুশ করার নির্দেশ দেন। অন্য কমান্ডাররা নিজ-নিজ দল নিয়ে আইল্লাপুকুরের বিভিন্ন স্থানে পূর্বে তৈরি করা ট্রেন্স ও ব্যাংকারে অস্ত্রশস্ত্রসহ এম্বুশ করেন। এদিন তাদের সম্ভাব্য যুদ্ধের কোড নাম ছিল ‘রাম-লক্ষ্মণ’। হানাদার বাহিনী রামচরাইল জিয়াউল হক সরকারের বাড়ির পুকুর পাড়ে মর্টার স্থাপন করে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিভ্রান্ত করার জন্য বিদ্যাকুট মাদ্রাসা ও গ্রামের পূর্বদিক দিয়ে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। হানাদার বাহিনীর সবগুলো নৌকা হাওর পেরিয়ে আইল্লাপুকুরে প্রবেশ করে। কমান্ডার এস এম ইউছুফ ফায়ার করার নির্দেশ দেয়ার সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের ওপর শতশত রাউন্ড গুলি নিক্ষেপ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে হানাদাররা আর্তচিৎকার করতে থাকে। এর মধ্যে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাল্টা মর্টার শেল নিক্ষেপ করে। রাত ১২টার দিকে যুদ্ধ শেষ হয়। এ-যুদ্ধে ২৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য ও শতাধিক রাজাকার নিহত এবং বহুসংখ্যক হানাদার সৈন্য ও রাজাকার আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডুবসাঁতার দিয়ে পার্শ্ববর্তী চরিলাম গ্রামে, কেউ-কেউ নৌকায় করে অন্য গ্রামে আশ্রয় নেন।
হানাদার বাহিনী পরের দিন ২৪শে সেপ্টেম্বর সকালে বিদ্যাকুট বাজার ও গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়। যাকে সামনে পায় তাকেই তারা হত্যা করে। তারা বিদ্যাকুট বাজারের উত্তর পাশে এক বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এ খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হতে থাকেন। বাজারে আগুনের লেলিহান শিখা দেখে মহেশপুরের কমান্ডার সুবেদার আ. মজিদ ও গ্রুপ কমান্ডার তফাজ্জল হোসেন তাঁদের দলবল নিয়ে মেরকুটা গ্রামে অবস্থান নেন। তঁরা দুদিক দিয়ে বিদ্যাকুটে পাল্টা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে মেরকুটা থেকে এক গ্রুপ এবং বিদ্যাকুটের পূর্ব-উত্তরে কুড়িঘর থেকে অপর এক গ্রুপ। মেরাতলী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা ও অন্য একজন মুক্তিযোদ্ধা কলাগাছের ভেলার মধ্যে মর্টার স্থাপন করে সাঁতার কেটে বিদ্যাকুটের পূর্ব-দক্ষিণ দিক দিয়ে বন বাবুর বাড়ির কাছে স্নানরত রাজাকারদের ওপর আক্রমণ করেন। সুবেদার আব্দুল মজিদের নেতৃত্বে একটি দল বিদ্যাকুটের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবেশ করে কয়েকটি পিস্তলের গুলি ছোড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের এ আচমকা আক্রমণে হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং গোকর্ণঘাটে ফিরে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা দুপুর ২টায় যুদ্ধ শেষ হলে বিদ্যাকুটে প্রবেশ করেন। এ-যুদ্ধে হানাদারদের অনেক অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। বর্ষা শেষে বিদ্যাকুট যুদ্ধের স্থানে হানাদার বাহিনীর ব্যবহৃত আরো অনেকগুলো অস্ত্র পাওয়া যায়, যা পরবর্তীতে থানায় জমা দেয়া হয়। [মো. শাহজাহান সোহেল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড