You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিনোদপুর গণহত্যা (শিবগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ)

বিনোদপুর গণহত্যা (শিবগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ) সংঘটিত হয় ৬ ও ৭ই অক্টোবর। এতে মোট ২৯ জন সাধারণ মানুষ নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হন।
শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ- সমর্থকের সংখ্যা ছিল বেশি। ১৫ই আগস্টের পর পাগলা নদীর পশ্চিম অঞ্চল শত্রুমুক্ত হলে ডাক্তার মঈন উদ্দিন আহমেদ এমপিএ ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ২০শে আগস্ট বিনোদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্প স্থাপন করেন। ৬ই অক্টোবরের পূর্বে এ ক্যাম্পের মাধ্যমে তিন শতাধিক যুবককে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ভারতে পাঠান। এ কারণে দখলদার বাহিনী বিনোদপুরকে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে মনে করত।
৬ই অক্টোবর ভোর ৪টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাপ্টেন শরিফ আহমদের নেতৃত্বে একদল পাকসেনা, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্য বাইগাতলা হাটের নিকট শিকারপুর পানি নিষ্কাশন প্রণালী পার হয়ে মেজর ইউনুস খানের নেতৃত্বাধীন যোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হয়। তারপর তারা কলাবাড়ি ও ধোবড়া দখল করে বিনোদপুরের দিকে অগ্রসর হয়। লছমানপুর গ্রামে পৌঁছে তারা গুলি ছোড়া শুরু করে। হানাদারদের আগমন ঠেকাতে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা বিনোদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের দোতলার ছাদে উঠে পাল্টা ফায়ার শুরু করেন। এমতাবস্থায় শত্রুসেনারা গ্রামের বিভিন্ন স্থানে পজিশন নেয়। এর মধ্যে ক্যাম্পে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধারা সরে পড়েন। ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা সীমান্তের দিকে চলে যান। এদিকে হানাদাররা দ্রুত বিদ্যালয়ের উত্তর-পূর্ব দিকের গ্রামে পৌঁছে যায়। তাদের সঙ্গে থাকা রাজাকাররা চামাটোলা, চাঁদশিকারী, এরাদত বিশ্বাসটোলা, কবিরাজটোলা প্রভৃতি গ্রামে গণগ্রেফতার শরু করে। এক সময় গ্রেফতারকৃতদের বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে জড়ো করা হয়। তারপর শিবগঞ্জের রাজাকার বাহিনীর প্রধান মোহা. মাহিদুর রহমান (পিতা সুবেদার বিশ্বাস, দাদনচক, আদিনা কলেজ; যুদ্ধাপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত) জড়ো করা লোকদের সম্পর্কে ক্যাপ্টেন শরিফ আহমদের সঙ্গে আলোচনা করে। আলোচনান্তে গ্রেফতারকৃতদের বিদ্যালয়ের খেলার মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায় এবং তার সহযোগী কমান্ডার মোহা. মোয়াজ্জেম হোসেন (পিতা কলিমুদ্দিন বিশ্বাস, বিশ্বনাথপুর, মনাকষা)-কে গুলি করার হুকুম দেয়। সে সারিবদ্ধ লোকদের ব্রাশ ফায়ার করে। এতে অজ্ঞাতপরিচয় ৫ জনসহ ১৭ জন শাহাদত বরণ করেন, বাকিরা প্রাণে বেঁচে যান। শাহাদত বরণকারী ৫ জন ব্যতীত অন্য ১২ জন হলেন- চাঁদশিকারীর মোহা. ফজলুর রহমান (পিতা হাসেম উদ্দিন মোল্লা), মোহা. আরিফুল ইসলাম (পিতা মোহা. ফজলুর রহমান), মোহা. আয়েশ উদ্দিন (পিতা কশিমুদ্দিন), মোহা. আজমল হক (পিতা কশিমুদ্দিন), মোহা. আফাদি মণ্ডল (পিতা খোসাল মণ্ডল), মোহা. দুঃখু মণ্ডল (পিতা মোহা. লিভুর্সি মণ্ডল), মোহা. ফিটু মিঞা, মোহা. রেজাউল করিম রাজ্জাক (পিতা মোহা. পাতু মণ্ডল), মোহা. পারুল হোসেন (পিতা বিলাত আলি), মোহা. গোলাপ আলি (পিতা মোহা. মুসাহাক বিশ্বাস), মোহাঃ সাইফুদ্দিন (পিতা আইয়ুব আলি মণ্ডল) এবং চামাটোলার মোহা. আফসার আলি (পিতা নেস মোহাম্মদ)।
এখানে ৪ জন আহত হন। তারা সকলে চাঁদশিকারীর অধিবাসী। তারা হলেন- মোহা. জিল্লুর রহমান (পিতা গিয়াস উদ্দীন), মোহা. মুখলেসুর রহমান (পিতা মোহা. হাসেম উদ্দিন মোল্লা), মোহা. আফসার আলি (পিতা মোহা. মন্তাজ আলি) ও মোহা. রইস উদ্দিন (পিতা মোহা. মিরাজ আলি)।
৬ই অক্টেবরের গণহত্যার পরপরই হানাদার বাহিনী মনাকষা অভিযানে অগ্রসর হয়। তবে বিনোদপুরের দখল ধরে রাখার জন্য তারা আফসার হোসেন চুটু (পিতা কুতুব উদ্দীন মোড়ল, সাতরশিয়া, মনাকষা), আব্দুল গফুর জোলা (কানসাট), মোহা. কুতুব উদ্দীন ওরফে কুবা কাতারী (হাসানপুর, মনাকষা), আব্দুল্লাহ (পিতা আব্দুল গফুর জোলা (কানসাট), মোশাররফ হোসেন মিনু ওরফে মেনা (বিশ্বনাথপুর, কানসাট)-সহ আরো কয়েকজন রাজাকারকে সেখানে রেখে যায়। এসব রাজাকার কয়েকটি গ্রামে অভিযান চালিয়ে কিছু লোককে ধরে এনে বিনোদপুর উচ্চ বিদ্যলয়ের একটি কক্ষে বন্ধ করে রাখে। ৬ই অক্টোবরের গণহত্যার হুকুমদাতা মোহা. মাহিদুর রহমান ও ব্রাশ ফায়ারকারী মোহা. মোয়াজ্জেম হোসেন ৭ই অক্টোবর কিছু রাজাকারকে সঙ্গে নিয়ে বিনোদপুর পৌঁছে। তারা কয়েকটি উপদলে বিভক্ত হয়ে চিহ্নিত কিছু গ্রামে অভিযান চালায় এবং কিছু লোককে গ্রেফতার করে বিনোদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে নিয়ে আসে। তারপর বিদ্যালয়ে পূর্বে বন্দি করে রাখা লোকদের নতুন করে গ্রেফতারকৃতদের সঙ্গে খেলার মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। এরপর মোহা. মাহিদুর রহমানের নির্দেশে মোহা. মোয়াজ্জেম হোসেন লাইনে থাকা লোকদের গুলি করে। এতে ১২ জন নিরপরাধ লোক নিহত হন। তারা হলেন- চাঁদশিকারীর তিন ভাই মোহা. এন্তাজ আলি, মোহা. তসলিম উদ্দিন ও মোহা. নজরুল ইসলাম (পিতা মোহা. ওয়াজেদ আলি), মোহা. সেনামুল হক (পিতা মোহা. আফজাল হেসেন), মোহা. কাতলু মণ্ডল (পিতা মোহা. হাসমত আলি মুনশি), আলকেশ আলি (পিতা মোহা. আব্দুর রহমান), মোহা. জালাল উদ্দিন (পিতা মোহা. মহিজুদ্দিন), মোহা. কশিমুদ্দিন (পিতা মোহা. হেনসান আলি মণ্ডল), মোহা. আজহার আলি (পিতা মোহা. আবুল হুসেন), কলিগঞ্জের মোহা. সেন্টু মিস্ত্রি (পিতা মোহা. হাসিমুদ্দিন), বিশ্বাসটোলার মোহা. গুদোড় আলি (পিতা মোহা. আসেদ আলি এরাদত) এবং মোহা. আকালু মণ্ডল কালু (পিতা জেরাত মণ্ডল। এদিন খুনিদের গুলিতে বেশ কয়েকজন আহত হন। তারা হলেন- চাঁদশিকারীর মোহা. জাকারিয়া (পিতা মোহা. ওয়াজেদ আলি), মোহা. মহবুল হক (পিতা আবুল হোসেন), আবুল হোসেন (মহবুল হকের পিতা), মোহা. আফজাল (পিতা মোহা. নিয়ামত মণ্ডল), মোহা. ফসি আলম সাটু (পিতা এন্তাজ আলি), একবরপুর পাঁকাটোলার মোহা. আব্দুল খালেক চুটু (পিতা আরজাদ আলি বিশ্বাস) প্রমুখ। বিনোদপুর ৬ ও ৭ই অক্টোবর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গণহত্যার শিকার ২৯ জন নিরপরাধ গ্রামবাসীর স্মরণে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। [তামিজ উদ্দীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!