বিজয়পুর ব্রিজ বধ্যভূমি (কুমিল্লা সদর দক্ষিণ)
বিজয়পুর ব্রিজ বধ্যভূমি (কুমিল্লা সদর দক্ষিণ) কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলায় অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়।
কুমিল্লা জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলার বারপাড়া ইউনিয়নে কুমিল্লা-চাঁদপুর সড়কে অবস্থিত বিজয়পুর ব্রিজটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ ব্রিজের মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে কুমিল্লার সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচলে বিঘ্ন ঘটাতে মুক্তিবাহিনী বিজয়পুর ব্রিজ, রেল ব্রিজসহ ৩টি ব্রিজ ভেঙ্গে দেয়। পাকিস্তানি বাহিনী গুংগাইজুরি খালের ওপরের বিজয়পুর ব্রিজ মেরামত করে। ব্রিজ ভাঙ্গার কারণে ক্ষুব্ধ পাকিস্তানি বাহিনী ব্রিজের পাশের ভবানীপুর ও দুর্গাপুর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় এবং ব্রিজের পাশে ক্যাম্প স্থাপন করে। তারা আশপাশের গ্রাম এবং নানা স্থান থেকে মানুষ ধরে এনে খালের পাড়ে হত্যা করত। এজন্য নিহতদের সঠিক সংখ্যা পাওয়া কঠিন।
২৫শে মে বারপাড়া গ্রামের যতীন্দ্র চন্দ্র পাল, দীনবন্ধু পাল ও নিত্যানন্দ পালকে হাত পেছনে বেঁধে গুলি করে হত্যার পর ঘরের ভেতর রেখে আগুন জ্বালিয়ে দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। ২ দিন পর পোড়া দেহগুলো লোকজন এসে মাটিচাপা দেয়। আফসারউদ্দিন (দুর্গাপুর) চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। একাত্তর সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর ইপিআর, আনসার ও মুক্তিবাহিনীকে সংগঠিত করে বিজয়পুর হাইস্কুল মাঠে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। মুক্তিযোদ্ধা আফসারউদ্দিনকে ১৫ই আগস্ট পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে যায় এবং তাঁদের বাড়িতে লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দেয়।- তাঁর মা ছকিনা বেগম ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে মারা যান। আফসারউদ্দিনকে বারপাড়া ইউনিয়ন পরিষদে আটকে রেখে হত্যা করা হয়।
বিজয়পুর ব্রিজের নিচেই ছিল বধ্যভূমি। এখানে প্রতিরাতেই চলত হত্যাযজ্ঞ। পানিতে ভেসে যেতো অসংখ্য লাশ। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, অসংখ্য মানুষকে গাড়িতে করে নিয়ে এসে রাতের আঁধারে হাত পেছনে বেঁধে ব্রিজের ওপর দাঁড় করিয়ে ফেলে দিত হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা। কোথাও-কোথাও লাশ জমিতে আটকে যেত। শেয়াল-কুকুরে লাশ টানাটানি করত। ভবানীপুরের তৈয়ব আলীকে ধানক্ষেতে গুলি করা হয়। তার লাশ ৩ দিন জমিতে পড়েছিল। রাতের আঁধারে গ্রামের লোকজন লাশ কবর দেয়। এখানে গণহত্যার শিকার হন শ্রীদাস চন্দ্র পাল (গাংকুল), দিলু মিয়া (বারপাড়া), আম্বিয়া বেগম (লোলবাড়িয়া), ছকিনা বেগম (দুর্গাপুর) ও নুরুজ্জামান (দীঘলগাঁও)। জুন-আগস্ট মাসে বিজয়পুর ব্রিজের নিচে অসংখ্য গণহত্যা ঘটে।
বিজয়পুর ব্রিজ বধ্যভূমিটি অবহেলায় পড়ে আছে। ২০১১ সালে বারপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. হুমায়ুন কবির একটি চারকোনা দেয়াল নির্মাণ করে ১৩ জন শহীদের নাম লিপিবদ্ধ করেন। দেয়ালটি এখন বিনষ্ট হয়ে গেছে। শহীদের নামগুলোও মুছে গেছে। [মামুন সিদ্দিকী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড