You dont have javascript enabled! Please enable it! বালিয়াহালট গোরস্থান সংলগ্ন বধ্যভূমি (পাবনা সদর) - সংগ্রামের নোটবুক

বালিয়াহালট গোরস্থান সংলগ্ন বধ্যভূমি (পাবনা সদর)

বালিয়াহালট গোরস্থান সংলগ্ন বধ্যভূমি (পাবনা সদর) পাবনা সদর থেকে ৩ কিমি দূরে অবস্থিত।এ বধ্যভূমিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার ও নকশালদের সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধকালে অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে নিমর্মভাবে হত্যা করে। অনেককে তাদের ওয়াপদা টর্চার সেন্টারে চরম নির্যাতন শেষে এখানে এনে হত্যা করা হয়। অনেকের লাশ বালিয়াহালট গোরস্থান, ঈদগাহ মাঠ ও নিকটস্থ রাইস মিলের পুকুরপাড়ে ফেলে রাখে। পাবনার ডিআইও-১ মীর্জা হাবিবুর রহমান বেগ ও আনসার এডজুট্যান্ট আবদুল বরকতকে গ্রেপ্তার করে এখানে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
২৮শে মার্চ পাবনার টেলিফোন ভবন, লস্করপুর, বিসিক এলাকা প্রভৃতি স্থানে যখন হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার প্রতিরোধযুদ্ধ চলছিল, তখন শহরের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত ডাকবাংলো এবং ওয়াপদা ভবনে অবস্থানরত ৭-৮ জন পাকসেনা আক্রান্ত হবার ভয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে। পথে তারা স্বাধীনতাকামী মানুষের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে জনতার ওপর ব্রাশ ফায়ার করতে করতে বালিয়াহালট গোরস্থানের ভেতর ঢুকে পড়ে। সারারাত যুদ্ধ চলার পর ভোর রাতে পাকসেনারা সাধারণ জনতার হাতে প্রাণ হারায়। ১১ই এপ্রিল পাকবাহিনী পাবনা শহরে প্রবেশ করে বিহারি ও এদেশীয় দালালদের মাধ্যমে পাবনায় ঐ পাকিস্তানি সেনাদের করুণ পরিণতির কথা জানতে পারে। তারা নূরপুর ডাকবাংলোতে বিচারিক দপ্তর স্থাপন করে। একই সময় বালিয়াহালট ব্রিজের কাছে চেকপোস্ট বসায়। চেকপোস্টের পাশে বাঙ্কার এবং ঘর তৈরি করে সেখানে পাকিস্তানি সৈন্য, রাজাকার ও নকশালরা মিলে সশস্ত্র অবস্থায় চব্বিশ ঘণ্টা পাহারায় থাকত। চেকপোস্ট থেকে একশ ফুট দূরে রাস্তার দুদিকে সাদা দাগ দিয়ে চিহ্নিত করা ছিল। বাস, গরুর গাড়ি, রিকশা বা সাইকেলসহ সকল প্রকার যানবাহন ঐ দাগের বাইরে থামিয়ে রেখে সবাইকে নেমে আসতে হতো। তারপর তাদের পায়ে হেঁটে চেকপোস্টের কাছে এসে লাইন ধরে দাঁড়াতে হতো। জিজ্ঞাসাবাদের পর রাজাকার অথবা নকশালরা যাদের শত্রু বলে চিহ্নিত করে দিত, সঙ্গে-সঙ্গে কালো কাপড়ে তাদের চোখ বেঁধে অমানুষিক অত্যাচার শেষে নির্মমভাবে হত্যা করে গোরস্থানের আশেপাশে লাশ ফেলে রাখা হতো। কয়েকদিন ধরে পচে-গলে মৃতদেহগুলো শেয়াল-কুকুরের আহারে পরিণত হতো। ৬ই মে রাত ১২টায় পাকিস্তানি সৈন্যরা পাবনার ডিআইও-১ মির্জা হাবিবুর রহমান বেগ এবং জেলা আনসার এডজুট্যান্ট আব্দুল বরকতকে শহরের একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে। কাবুলিওয়ালাদের সর্দার আব্দুল্লাহ খান তাদের চিনিয়ে দেয় এবং গ্রেফতারের ব্যাপারে সহায়তা করে। এ দুজনকে বালিয়াহালট বধ্যভূমিতে নিয়ে একটি তালগালছের সঙ্গে পা ওপরের দিকে বেঁধে প্রথমে বেয়নেট চার্জ, পরে গুলি করে হত্যা করা হয়।
অত্র এলাকায় ৭১-এ হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা নির্যাতন করে শতশত বাঙালিকে হত্যা করে। পাবনার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষদের ধরে হানাদার বাহিনী নিয়ে যেত ওয়াপদার টর্চার সেলে। সেখানে রাতের পর রাত তাদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করত। আধমরা অবস্থায় নিয়ে যেত বালিয়াহালট গোরস্থান সংলগ্ন বধভূমিতে। অনেক সময় গোরস্থানের মধ্যেই তাদের গুলি করে ফেলে রাখা হতো। হানাদাররা বালিয়াহালট ঈদগাহ মাঠে নিয়েও বহু মানুষকে হত্যা করে। মোজাহার আলীর রাইস মিলের পুকুরপাড়ে নারকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে বহুলোককে হত্যা করা হয়েছে। তারা কখনো-কখনো লাশগুলো গাছের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায়ই রেখে যেত। বেশিরভাগ লাশ শেয়াল, কুকুর ও শুকুন খেয়ে ফেলত। কোনো-কোনো সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এলাকার মানুষজন গোপনে দু-একটি লাশ মাটিচাপা দিত। প্রতিরাতেই পাকিস্তানি সৈন্যরা অনেক মানুষকে বালিয়াহালট বধ্যভূমিতে এনে হত্যা করত। রাতে যখন গুলি করে হত্যা করত, তখন মানুষের করুণ আর্তনাদ, কাকুতি-মিনতি আর চিৎকারে ঐ এলাকার বাতাস ভারী হয়ে উঠত। স্বাধীনতার পর এ অঞ্চলের ঝোপ-ঝাড়ের ভেতর অসংখ্য মানুষের কঙ্কাল পাওয়া যায়। এ বধ্যভূমিতে মানুষ হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আজগর হোসেন জায়েদী। পাবনা শহর থেকে ৩ কিমি দূরে বালিয়াহালট গোরস্থান সংলগ্ন বধ্যভূমি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার নির্মম সাক্ষী হয়ে আছে। [মো. ছাবেদ আলী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড