বালিয়াবাড়ি যুদ্ধ (করিমগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ)
বালিয়াবাড়ি যুদ্ধ (করিমগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ) সংঘটিত হয় দুবার – ১২ই আগস্ট ও ৯ই ডিসেম্বর। প্রথম যুদ্ধে ৩ জন রাজাকার নিহত হয় এবং দ্বিতীয় যুদ্ধে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
কিশোরগঞ্জ ও করিমগঞ্জ থেকে মরিচখালী, পানাহারসহ ভাটি এলাকার সিংপুর ও নিকলীর সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বালিয়াবাড়ি ব্রিজটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে হানাদার বাহিনী তাদের যোগাযোগ অক্ষুণ্ন রাখার জন্য ব্রিজটিতে পাহারার ব্যবস্থা করে। ব্রিজের পাশে জয়কা ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে স্থাপন করা হয় রাজাকারদের একটি শক্তিশালী ক্যাম্প। এ ক্যাম্পে পাকসেনা ও রাজাকার মিলে প্রায় অর্ধশত জনকে ব্রিজ পাহারার কাজে নিয়োজিত করা হয়। রাজাকার বাহিনী ব্রিজ পাহারার নামে এলাকার নিরীহ মানুষদের ওপর প্রায়শই অত্যাচার- নির্যাতন চালাত। এসব খবর বিভিন্ন মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছায়। তাঁরা ব্রিজটির গুরুত্ব অনুধাবন করে হানাদার বাহিনীর সহজ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে বালিয়াবাড়ি ব্রিজের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেয়ার তৎপরতা শুরু করেন। এরই অংশ হিসেবে ১১ই আগস্ট ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা পার্শ্ববর্তী গুণধর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন আহম্মদ ওরফে মাখন মিয়ার বাড়িতে অবস্থান নিয়ে অপারেশনের পাকিল্পনা প্রণয়ন করেন। পারিকল্পনা মোতাবেক ১২ই আগস্ট রাত ১টার দিকে তাঁরা ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের পূর্বপার্শ্বস্থ খালের ঢালে পজিশন নেন। গ্রুপ কমান্ডার ডা. আব্দুল কাদির (টামনি আকন্দপাড়া, গুজাদিয়া)-এর নির্দেশ পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা অতির্কিতে রাজাকারদের ক্যাম্প লক্ষ্য করে ব্রাশ ফায়ার করেন। এতে ক্যাম্পে অবস্থানরত রাজাকাররা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে ৩ জন রাজাকার নিহত হয়। অপর রাজাকাররা কিছুক্ষণের মধ্যে পাল্টা প্রাতিরোধ গড়ে তোলে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান লক্ষ করে মুহুর্মুহু গুলি ছুড়তে থাকে। রাতের অন্ধকারে শুরু হয় দুপক্ষের মধ্যে প্রবল যুদ্ধ, যা বিরতিহীনভাবে সারারাত চলে। ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ ফুরিয়ে আসে। ফলে ভোরের দিকে তাঁরা পানাহার গ্রামের দিকে পশ্চাদপসরণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশন ব্যর্থ হলে চেয়ারম্যান মাখন মিয়া আত্মরক্ষার জন্য গ্রাম ছেড়ে পালাতে গিয়ে পার্শ্ববর্তী মদন গ্রামে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। রাজাকাররা তাকে ধরে এনে কিশোরগঞ্জ আর্মি ক্যাম্পে সোপর্দ করে। এরপর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
বালিয়াবাড়ির এ অপারেশনে অংশ নেন কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন ১১নং সেক্টরের গ্রুপ কমান্ডার ডা. আব্দুল কাদির, মো. হাবিবুর রহমান (গুজাদিয়া পালৈকান্দা), মো. আব্দুল মালেক (নওবাইদ), এ বি সিদ্দিক (সিন্দ্রিপ), শঙ্কর চন্দ্র সরকার (আশুতিয়াপাড়া), ধনরঞ্জন সরকার ওরফে ধনাই (আশুতিয়াপাড়া), মো. আবু আনিস ফকির (গুজাদিয়া আতকাপাড়া) প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা।
৯ই ডিসেম্বর নিকলী ও বাজিতপুর থানার একদল মুক্তিযোদ্ধা বালিয়াবাড়ির রাজাকার ক্যাম্পে দ্বিতীয় দফা আক্রমণ পরিচালনা করেন। এ আক্রমণকেও পাকবাহিনী ও রাজাকাররা সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করে। ফলে দু-পক্ষের মধ্যে সংঘটিত হয় প্রবল সম্মুখ যুদ্ধ। এ-যুদ্ধে নিকলী থানাধীন কারপাশা গ্রামের মো. আনোয়ারুল হক (পিতা মনিরউদ্দিন) এবং মো. নূরুল ইসলাম নামে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। নিকলী থানাধীন নগর গ্রামের সুখেন্দু রায় (পিতা নবদ্বীপ রায়) এবং কুর্শা গ্রামের সৈয়দ আমিনুল হক ওরফে ইকবাল (পিতা সৈয়দ জহুরুল হক ওরফে আক্কেল মিয়া) নামে দুজন মুক্তিযোদ্ধা প্রতিপক্ষের গুলিতে আহত হয়ে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। ঘাতক দল তাঁদের কিশোরগঞ্জ নিয়ে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে। কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার লতিবপুর গ্রামের মো. নূরুল হক ওরফে শাবান মিয়া (পিতা হাজী আ. খালেদ) নামের এক মুক্তিযোদ্ধাও এ-যুদ্ধে শহীদ হন।
বালিয়াবাড়ির দ্বিতীয় যুদ্ধে অংশ নেন মতিউর রহমান, বীর বিক্রম (নিকলী), মহিউদ্দিন, কফিলউদ্দিন, তমিজউদ্দিন, মোজাম্মেল হক খান রতন, ফাইজুল হক খান মাখন (ভাটিনানশ্রী), গ্রুপ কমান্ডার গিয়াসউদ্দিন খান কিরণ (ভাটিনানশ্রী), আফতাব উদ্দিন খান ছেনু (বীরুয়াইল), মো. ইদ্রিস আলী (দামপাড়া), আমিরউদ্দিন (মজলিশপুর), রিয়াজুল ইসলাম খান বাচ্চু (নিকলী), ফারুক আহমেদ খান (ভাটিনানশ্রী), গোলাম কিবরিয়া খান খসরু (ভাটিনানশ্রী), গ্রুপ কমান্ডার হাবিবুর রহমান ঠাকুর (ইটনা), আনোয়ার কামাল (নগুয়া, কিশোরগঞ্জ), ফজলুর রহমান (মহরকোণা, নিকলী), আ. রশিদ (ষাইটধার), আরব আলী (বড়হাটি), নেপাল দেবনাথ (ষাইটধার), ইজ্জত আলী (দামপাড়া), আরব আলী (দামপাড়া), নেপাল দেবনাথ (ষাইটধার), হারিছ মিয়া (মহরকোণা), আহম্মদ আলী (টিক্কলহাটি), মো. শাহাবুদ্দিন (ষাইটধার, অষ্টগ্রাম যুদ্ধে শহীদ), আব্দুল হেকিম (ষাইটধার, শহীদ), আব্দুল মালেক (পূর্বগ্রাম, শহীদ), জাহাঙ্গীর আলম ভূঞা (ধোবাজুরা, মিঠামইন), রফিকুর রহমান ভূঞা (ধোবাজুরা), মজিবুর রহমান ভূঞা (ধোবাজুরা), সাদেকুর রহমান (ঘাগড়া, মিঠামইন), ব্রজেন্দ্ৰ চন্দ্র দেবনাথ (ঘাগড়া), মো. আলাউদ্দিন (চমকপুর, মিঠামইন), ফরিদ আহমদ (ইসলামপুর, মিঠামইন), শাহাবউদ্দিন আহমদ (টেঙ্গুরিয়া, নিকলী), মজিদ আলী হাজী (সিংপুর, নিকলী), খুর্শিদউদ্দিন (সিংপুর, নিকলী), অজিমউল্লাহ (সিংপুর, নিকলী) প্রমুখ। [সালেহ আহমেদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড