You dont have javascript enabled! Please enable it!

বারোআড়িয়া যুদ্ধ (বটিয়াঘাটা, খুলনা)

বারোআড়িয়া যুদ্ধ (বটিয়াঘাটা, খুলনা) সংঘটিত হয় ২০শে নভেম্বর। এতে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অপরপক্ষে ৪ জন রাজাকার – নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। বারোআড়িয়া রাজাকার ক্যাম্প মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।
বারোআড়িয়া গ্রামটি বটিয়াঘাটা সদর থেকে ১৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। এর তিনদিক নদীবেষ্টিত এবং একদিকে খাল। চারপাশে ওয়াপদা বাঁধ নির্মিত গ্রামটি ৪নং সুরখালি ইউনিয়নের অন্তর্গত। হিন্দু অধ্যুষিত এ গ্রামটির সঙ্গে খুলনাসহ আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চলের লঞ্চ যোগাযোগ ছিল ভালো। এখানকার লঞ্চঘাট এবং বাজার ছিল সুপরিচিত।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার মাস দেড়েক পরে এ অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। সেই সুযোগে এ অঞ্চলের রাজাকাররা হিন্দু সম্প্রদায় ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা ব্যাপকভাবে নারীধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালায়। রাজাকারদের অকথ্য অত্যাচারে এ এলাকা প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। এ খবর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে যায়। বারোআড়িয়ার কাছাকাছি পাইকগাছা উপজেলার তেতুলতলা গ্রামে মুজিব বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। এ ক্যাম্পের প্রধান ছিলেন শেখ কামরুজ্জামান টুকু। অন্যদিকে চণ্ডীপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল এবং এর প্রধান ছিলেন ডুমুরিয়ার নূরুল ইসলাম মানিক। মুক্তিযোদ্ধারা বারোআড়িয়া রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। ২০শে নভেম্বর (ঈদ-উল-ফিতরের আগের দিন) অপারেশনের দিন নির্ধারণ করা হয়। শেখ কামরুজ্জামান টুকু পাইকগাছা থেকে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে বারোআড়িয়া রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের জন্য রওনা দেন। অন্যদিকে বটিয়াঘাটা থেকে মুক্তিযোদ্ধা বিনয় কৃষ্ণ সরকারের নেতৃত্বে ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা বারোআড়িয়া পৌছান। এই দুই দলের মুক্তিযোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে বিনয় কৃষ্ণ সরকারকে অপারেশনের কমান্ডার নির্বাচন করেন এবং ডেপুটি কমান্ডারের দায়িত্ব দেন আব্দুল আজিজকে। মুক্তিযোদ্ধারা রাতের বেলায় কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে রাজাকার ক্যাম্পের চারপাশে অবস্থান নেন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ভবনটি উড়িয়ে দেয়ার জন্য ৪-৫ জনের একটি দল ভবনের নিচতলায় এক্সপ্লোসিভ লাগায়। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে এক্সপ্লোসিভ ব্যবহার করতে না পারায় ভবনটি ধ্বংস না হয়ে কিছুটা হেলে পড়ে। অবশ্য বিস্ফোরণের বিকট শব্দে রাজাকাররা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে তারা ভবনের দোতলায় অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। বাজারের দোকানঘর ও উন্মুক্ত স্থান থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করতে মুক্তিযোদ্ধাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। এদিকে পাইকগাছা হাইস্কুল ক্যাম্প থেকে রাজাকাররা পালিয়ে বারোআড়িয়া ক্যাম্পে আসায় রাজাকারদের শক্তি বৃদ্ধি পায়। প্রচণ্ড গোলাগুলির এক পর্যায়ে অভিযানের ডেপুটি কমান্ডার আব্দুল আজিজ এবং মুক্তিযোদ্ধা জ্যোতিষ গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। যুদ্ধ চলে পরদিন বেলা প্রায় ১টা পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত অপারেশন কমান্ডার বিনয় সরকার একাই অসীম সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকেন। ধানক্ষেতের ভেতরে দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে তিনি গুলি চালাতে থাকেন এবং চারজন রাজাকারকে হত্যা করতে সক্ষম হন। ইতোমধ্যে ডুমুরিয়া থেকে মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম মানিকের দল এ অপারেশনে যোগ দিলে রাজাকাররা বেশিক্ষণ টিকতে না পেরে ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বারোআড়িয়া রাজাকার ক্যাম্প মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের ৬টি রাইফেল উদ্ধার করেন। যে-সকল মুক্তিযোদ্ধা এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তাঁদের মধ্যে বজলুর রহমান, মুকুল বিশ্বাস, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, সামছুর রহমান, হরিপদ, চন্দ্রকান্ত, সন্তোষ, হরিচাঁদ, মিকির, ক্ষিতীশ, তপন, খোকন, লতিফ, দিদার, কাওসার, আলাউদ্দিন, মোবারক, ওমর আলী, রাজ্জাক মোলঙ্গী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। [শংকর কুমার মল্লিক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!