You dont have javascript enabled! Please enable it!

বার্মা ইস্টার্ন অয়েল কোম্পানি অপারেশন (নারায়ণগঞ্জ সদর)

বার্মা ইস্টার্ন অয়েল কোম্পানি অপারেশন (নারায়ণগঞ্জ সদর) পরিচালিত হয় ১৬ ও ১৮ই আগস্ট। বার্মা ইস্টার্নে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি শক্ত ঘাঁটি ছিল। এর চারদিকে পাকিস্তানি সেনাদের বাংকার ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় গোদনাইল বার্মা ইস্টার্ন তেল ডিপো থেকে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হত। এখান থেকে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জ্বালানি তেলও সরবরাহ করা হতো। এ অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি সেনাদের জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ করা। ১৪ই আগস্ট সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল ইউনিয়নের মো. ইসমাইলের নির্দেশে মোমতাজউদ্দীন ভূঁইয়া এলাকা রেকি করে একটি রিপোর্ট দেন। কমান্ডার মো. ইসমাইল হোসেনের নেতৃত্বে মো. সুন্দর আলী, মোমতাজ উদ্দিন ভূঁইয়া, মোহর আলী, রশিদ, বদরুদ্দিন, নূরুল ইসলাম, রেহানউদ্দীন রেহান প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা এ অপারেশনে অংশ নেন। ১৬ই আগস্ট রাত ১২টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা জালকুড়ি গ্রামস্থ তাঁদের ক্যাম্প থেকে যাত্রা করেন। বিল পার হয়ে ওয়াপদা ক্যানেল ধরে রমিজ ভূঁইয়ার বাড়ির পাশ দিয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধারা নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা সড়ক ক্রস করেন। তাঁরা মনা পাগলা ও বাদশা মেম্বারের বাড়ির পাশ দিয়ে রেললাইনের সামনে আসেন। সেখান থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কমান্ডার মো. ইসমাইলের বাড়িতে ওঠেন। এখান থেকে নৌকায় চড়ে বারেক ভূঁইয়ার বাড়িতে এসে অবস্থান নেন। এ বাড়িতে অপারেশনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে মো. সুন্দর আলী ট্যাংকের ভেতরে ঢুকে বোমা স্থাপন করার দায়িত্ব নেন। ২নং ঢাকেশ্বরী মিলের পাশ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সেন্ট্রাল অফিসের কাছাকাছি থেকে বার্মা ইস্টার্নের তেল ট্যাংকগুলো লক্ষ করে ৯৪ এনরিগা দিয়ে আঘাত করেন। ট্যাংকে লাগার পরও কোনো কাজ না হলে পটাশিয়াম মেঙ্গানেট ও গ্লিসারিন দিয়ে আগুন লাগানোর চেষ্টা করেন। এতে কাজ হয় ও ডিপোতে আগুন লাগে। কিন্তু বার্মা ইস্টার্নের শ্রমিকরা আগুন নিভিয়ে ফেলে।
এর দুদিন পর ১৮ই আগস্ট রাত ১২টায় মো. ইসমাইল হোসেনের নেতৃত্বে মো. সুন্দর আলী, মোমতাজ উদ্দিন ভূঁইয়া, মোহর আলী, রশিদ (ছোট), বদরুদ্দিন, নূরুল ইসলাম প্রমুখ জালকুড়ি গ্রাম থেকে বার্মা ইস্টান তেল ডিপোর কাছে আসেন। তেল ডিপোর তারের বেড়ার ৫০ গজ দূরে একদল পাকিস্তানি সেনা তেলের ট্যাংক পাহারায় ছিল। ২০ গজ দূরত্বে দুটি বাংকার থেকে পাকিস্তানি সেনারা মেশিনগান হাতে আসা-যাওয়া করছিল। এটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি দুঃসাহসিক অপারেশন। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও মুক্তিযোদ্ধা সুন্দর আলী লুঙ্গির পেছনে ২টি গ্রেনেড গুঁজে হাতে ৫৫ পাউন্ড বিস্ফোরক নিয়ে তারের বেড়া ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকে ক্রলিং করে ট্যাংকের কাছে চলে যান। বাইরে থেকে মো. ইসমাইল হোসেন এলএমজি হাতে এবং অন্য দুজন মুক্তিযোদ্ধা দুটি স্টেনগান নিয়ে আমগাছের ওপর উঠে তাঁকে কভার দেন, যাতে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করা যায়। মো. সুন্দর আলী পাকিস্তানি সেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে তেলের ট্যাংকের গোড়ায় ডেলিভারি পাইপের চতুর্দিকে বিস্ফোরক পেঁচিয়ে দেন। ফিরে এসে তিনি প্রেমাকড নিয়ে আবার তেলের ট্যাংকে যান। ট্যাংক থেকে ৫০ হাত লম্বা তার দিয়ে মো. ইসমাইল হোসেনের কাছে ফিরে আসেন। ইসমাইল হোসেন এলএমজি সুন্দর আলীর হাতে দিয়ে তাঁর পেছনে পজিশন নিতে বলে ফিউজে আগুন ধরিয়ে সবাইকে ফিরে যাবার নির্দেশ দেন। যেভাবে গিয়েছিলেন সেভাবেই সব মুক্তিযোদ্ধা ফিরতে শুরু করেন। এমন সময় শান্তি কমিটির সদস্য জিন্নত আলী মাতবর মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে পাকিস্তানি সেনাদের খবর দেয়৷
বিস্ফোরক স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানের দিকে যেতে থাকেন। স্টেনগান হাতে মুক্তিযোদ্ধা বদরুদ্দিন আগে-আগে যাচ্ছিলেন। অন্য মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে অনুসরণ করছিলেন। মো. ইসমাইল হোসেনের বাড়ি পেরিয়ে বাগমারা রেললাইনের ব্রিজে ওঠার পর তাঁদের লক্ষ করে পাকসেনারা গুলিবর্ষণ করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধা বদরুদ্দিন পাকিস্তানি সেনাদের গুলির জবাব দেন। একটু পরে বিকট শব্দে তেল ডিপোর ভেতরে ট্যাংকে বোমা বিস্ফোরিত হলে পাকিস্তানি সেনারা ভয়ে গুলিবর্ষণ বন্ধ করে। এ সুযোগে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে চলে যান। এ অপারেশন সফল হওয়ায় তেল ডিপোর ব্যাপক ক্ষতি হয়। পাকসেনারা জ্বালানি তেলের সংকটে পড়ে। [রীতা ভৌমিক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!