You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে বালাগঞ্জ উপজেলা (সিলেট)

বালাগঞ্জ উপজেলা (সিলেট) ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারাদেশের ন্যায় বালাগঞ্জের জনতাও বুঝতে পারে যে, বাঙালিদের স্বাধিকার অর্জন সহজ পথে সম্ভব হবে না। এজন্য আন্দোলন করতে হবে, এমনকি যুদ্ধও করতে হতে পারে। তাই বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে তারা অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সঙ্গে-সঙ্গে এ খবর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে বালাগঞ্জের ছাত্র-জনতা মুক্তিযুদ্ধের জন্য তৈরী হয়ে যায়।
জেনারেল এম এ জি ওসমানী – এমএনএ-র নির্দেশে মুক্তিকামী মানুষ মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নেয়। প্রথম পর্যায়ে মেজর সি আর দত্ত, বীর উত্তম- এবং দেওয়ান ফরিদ গাজীর নেতৃত্বে লুৎফুর রহমান, আক্তার আহমদ, শাহ আজিজুর রহমান, আশরাফ আলী, ইনামুল হক চৌধুরী, ধীরেন্দ্র কুমার দে, আজিজুল কামাল, মছব্বির বেগ, শফিকুর রহমান, দয়াময় দাস, তাহের মিয়া, মনির উদ্দিন, আব্দুল মতিন, নীহারেন্দু ধর, আব্দুল বারী, সমুজ আলী, জবেদ আলী, সিকন্দর আলী, আমান উদ্দিন, মো. কামাল, লালা মিয়াসহ ৫০-৬০ জনের একটি দল ভারতের ইকোয়ানে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়। পরবর্তীতে আরো একাধিক দল ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়।
স্থানীয়ভাবে বালাগঞ্জ উপজেলায় শুরুতে প্রধানত জেনারেল ওসমানীর পরামর্শ ও নির্দেশেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। লুৎফুর রহমান, আক্তার আহমদ, শাহ আজিজুর রহমান, আশরাফ আলী, ইনামুল হক চৌধুরী, নিম্বর আলী, ফুল মিয়া প্রমুখ তাঁকে সহায়তা করেন।
বালাগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিল থানা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান চৌধুরী। এছাড়া মৌলভী ফজলুর রহমান, নূর উদ্দিন, গৌছুর রহমান চৌধুরী, আব্দুল মজিদ, আব্দুল খালিক, রুস্তম আলী, সাইফ উদ্দিন, আব্দুল লতিফ (আলীপুর), রুস্তম চৌকিদার (তেরআস্তি), আব্দুল খালিক, চিকন মিয়া (কিয়ামপুর), সুরুজ মিয়া (কলারাই), আখতারুজ্জামান (বঙ্গপুর), বদরুল আলম জায়া সরদার (কারমাপুর), গৌছ মিয়া (বুরুঙ্গা) প্রমুখ পাকসেনাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। এদের সহযোগিতায় রাজাকার বাহিনী গঠিত হয় এবং তারাও পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতায় অংশ নেয়। বালাগঞ্জে ক্যাম্প স্থাপনের পর থেকেই পাকবাহিনী রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে হত্যা, গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে। এ উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। হানাদারদের হাতে যাঁরা শহীদ হন, তাঁদের অধিকাংশই হিন্দু। হানাদার ও তাদের দোসররা বালাগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে নৃশংস গণহত্যা চালায়। ১৯শে মে -গালিমপুর গণহত্যায় ৩২ জন, ২৬শে মে পেয়ারাপুর গণহত্যায় ৮০ জন, ১৮ই জুলাই সুরিকোনা গণহত্যায় ২২ জন এবং আদিত্যপুর গণহত্যায় ৬৩ জনসহ এ উপজেলায় সহস্রাধিক ব্যক্তি শহীদ হন। ২৮শে মে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা গালিমপুর গ্রামে ঢুকে বহু বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রধান ফজলুর রহমান চৌধুরীর সহযোগিতায় পাকসেনারা বালাগঞ্জ বাজারে নির্যাতনকেন্দ্র স্থাপন করে। এখানে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজনদের ধরে এনে নির্যাতন চালায়। এ-কাজে তাদের সহযোগিতা করে মৌলভী ফজলুর রহমান, নূর উদ্দিন, আব্দুল আহাদ চৌধুরী, গৌছুর রহমান চৌধুরী, আব্দুল মজিদ, রুস্তম আলী, সাইফ উদ্দিন প্রমুখ।
পাকবাহিনী এ-দেশীয় দালালদের সহায়তায় বালাগঞ্জে নির্বিচারে গণহত্যা চালায় এবং নিহতদের বিভিন্ন স্থানে গণকবর দেয়। এরকম তিনটি গণকবর হলো আদিত্যপুর গণকবর, পেয়ারাপুর গণকবর ও গালিমপুর গণকবর।
অবস্থানগত দিক থেকে সিলেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হলো বালাগঞ্জ। একে হানাদারমুক্ত করার জন্য ২রা ডিসেম্বর সকালে ভারতের সীমান্তবর্তী রাতছড়া থেকে ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল রওনা করে। দলে ছিলেন ধীরেন্দ্র কুমার দে, আজিজুল কামাল, মছব্বির বেগ, শফিকুর রহমান, দয়াময় দাস, তাহের মিয়া, মনির উদ্দিন, আব্দুল মতিন, নীহারেন্দু ধর, আব্দুল বারী, সমুজ আলী, জবেদ আলী, সিকন্দর আলী, আমান উদ্দিন, লালা মিয়া প্রমুখ। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পথিমধ্যে ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধা পার্শ্ববর্তী মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলায় অবস্থান নেন। ১৪ জনের অন্য দলটি ৪ঠা ডিসেম্বর রাতে ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও এলাকা থেকে ইলাশপুর রেলসেতুর নিকট অবস্থান নেয়। পরদিন ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা ফেঞ্চুগঞ্জের দিকে অগ্রসর হলে পাকসেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে পাকসেনারা পরাজিত হয়ে বেশকিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেলে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের উভয় দল ৬ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বালাগঞ্জ থানাসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান নেয় এবং থানাভবন অবরুদ্ধ করে রাখে। ৭ই ডিসেম্বর বালাগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মইনুল হোসেন চৌধুরী, বীর বিক্রম (পিতা নুরুল হোসেন চৌধুরী, শিওরখাল) ও ইনামুল হক চৌধুরী, বীর প্রতীক (পিতা বশিরুল হক চৌধুরী, সুলতানপুর)।
বালাগঞ্জ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মনু মিয়া (দেওয়ান বাজার ইউনিয়ন; সিলেটের টিলাঘর যুদ্ধে শহীদ)। বালাগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বালাগঞ্জ বাজারে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মিত হয়েছে। [অহী আলম রেজা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!